Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

নিবন্ধনহীন দেড় লাখ ফার্মেসি


ইউএনভি ডেস্ক:

ক্লিনিক-হাসপাতালের পর এবার ওষুধের দোকানও চলছে লাইসেন্স ছাড়াই। সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ দোকানের নিবন্ধন নেই। এর মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার দোকান আছে যেগুলো খুবই নিুমানের। এ পরিস্থিতিতে করোনা মহামারী পুঁজি করে ঢাকাসহ সারা দেশের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে নতুন অসংখ্য ওষুধের দোকান। এগুলোও অধিকাংশই অবৈধ।


করোনাকালে নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম এবং বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা কয়েকগুণ বাড়ায় এসব দোকানের ব্যবসাও জমজমাট। তবে তদারকি না থাকায় নকল, ভেজাল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জাম বিক্রি হয় এসব দোকানে। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতি ব্যবসায়িক মনোভাব এবং জনসাধারণের অসচেতনতার কারণেই অবৈধ দোকানগুলো ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক যুগান্তরকে বলেন, আমি ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছি, দেশের সব ওষুধের দোকান একটি শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে। যেসব দোকানের লাইসেন্স রিনিউ করা নেই, তাদের সময় দেয়া হবে। যারা লাইসেন্স ছাড়া চলছে কিন্তু দোকানের মান ভালো তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে। আর যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ সেগুলোকে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা এক লাখ ৫১ হাজার। এর মধ্যে গত দুই বছরে নতুন নিবন্ধন পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩৫টি। এই সময়ে আরও ৪৩৬টি মডেল ফার্মেসির অনুমোদন দেয় অধিদফতর। তবে নিবন্ধন ছাড়া কতগুলো ওষুধের দোকান রয়েছে তার সঠিক কোনো হিসাব নেই তাদের কাছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন রনি যুগান্তরকে বলেন, ‘সারা দেশে লাইসেন্সধারী ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। আর লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের দোকান রয়েছে আরও প্রায় দেড় লাখ। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর ও বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির দুর্বলতার কারণে লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বহু ফার্মেসি। অবৈধভাবে পরিচালিত প্রায় ৫০ হাজার দোকান রয়েছে, যেগুলো একেবারেই মানসম্পন্ন নয়। এগুলোকে বন্ধ করতে হবে। তবে যেগুলো মানসম্পন্ন তাদের দ্রুত লাইসেন্সের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে শর্ত শিথিল করার পরামর্শ দেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অবৈধ ওষুধের দোকান রয়েছে। যেসব দোকানে মানহীন ওষুধ বিক্রি হয়। রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এসব দোকান বিস্তৃত।
এদিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব নাখালপাড়ায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, একটি ছোট্ট এলাকার নাম লিচুবাগান। এখানে একটি শাখা রাস্তা ও এর আশপাশের দু-একটি গলিতে ওষুধের দোকান আছে ১০টির বেশি। এর মধ্যে গত এক বছরেই গড়ে উঠেছে ৫ থেকে ৬টি। একটি আবার শাখা দোকান। অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী কোনো স্থানে তার মূল দোকান। ওষুধের বিক্রি বাড়ায় গলির মধ্যে আরেকটি দোকান দিয়ে বসেছেন। এমনকি গত এপ্রিলে এই গলিতেই এক সেলুন মালিক চুল কাটার পাশাপাশি একটি ওষুধের দোকান দেন। তবে ৪ থেকে ৫ মাস দোকানটি চালিয়ে সম্প্রতি বন্ধ করেছেন।

ওষুধের স্থানীয় এক দোকানি বলেন, এটি কোনো একটি এলাকার চিত্র নয়। সারা দেশের পরিস্থিতিই একইরকম। করোনার সময় যেসব ওষুধের দোকান গড়ে উঠেছে সেগুলোর বেশির ভাগেরই লাইসেন্স নেই। এমনকি ঔষধ প্রশাসনের নিয়মনীতি না মেনে ‘বি’ বা ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্ট ছাড়াই চলছে এসব দোকান। যদিও ইতিপূর্বে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, দেশে লাইসেন্সবিহীন কোনো দোকান থাকবে না।

ঔষধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশে দেশের সব জেলার ড্রাগ সুপার, সিভিল সার্জন, উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজ নিজ এলাকার ওষুধের দোকানের তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কতটি ফার্মেসি আছে। কতগুলোর লাইসেন্স আছে আর কতগুলোর লাইসেন্স নেই ইত্যাদি তথ্য দিতে বলা হয়। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানা গেছে।

জানা গেছে, একটি খুচরা বা পাইকারি দোকানের ড্রাগ লাইসেন্স নেয়ার পর প্রতি দুই বছর অন্তর নবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না হলে বিলম্ব ফি দিয়ে নবায়নের সুযোগ আছে। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও লাইসেন্স নবায়ন করছেন না অনেক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলেও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব লাইসেন্স বাতিলে কোনো উদ্যোগই নেয় না ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুচরা ওষুধ বিক্রির জন্য দুই ক্যাটাগরির লাইসেন্স দেয় অধিদফতর। একটি হল মডেল ফার্মেসির, আরেকটি মেডিসিন শপের। মডেল ফার্মেসির জন্য প্রয়োজন হয় ৩০০ ফুটের একটি দোকান, পৌরসভার ভেতরে হলে ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং বাইরে হলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যা ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি, মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, মালিকের ব্যাংক সচ্ছলতার সনদ, ফার্মেসিতে নিয়োজিত গ্র্যাজুয়েট বা এ গ্রেড ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ফার্মাসিস্টের অঙ্গীকারনামা, দোকান ভাড়ার চুক্তিনামা। এছাড়া মেডিসিন শপের ক্ষেত্রে ১২০ ফুটের দোকান, ফার্মেসিতে নিয়োজিত বি বা সি গ্রেডের ফার্মাসিস্টের রেজিস্ট্রেশন সনদের সত্যায়িত কপি এবং মডেল ফার্মেসির মতোই অন্য সব সনদ দিয়ে শর্ত পূরণ করলেই দেয়া হয় ড্রাগ লাইসেন্স।

জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ২০০ টাকা ফি দিয়ে পৌর এলাকার পাইকারি, ১০০ টাকা দিয়ে খুচরা দোকান ও ৫০ টাকায় পৌর এলাকার বাইরের দোকানের লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। মেয়াদোত্তীর্ণের তিন থেকে ১২ মাস পর্যন্ত পৌর এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ৫০০, খুচরা ব্যবসায়ীরা ২০০ আর পৌর এলাকার বাইরের দোকান ১০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণের ১২ মাসের ঊর্ধ্বে বা পরবর্তী বছরের জন্য পাইকারি দোকান ১ হাজার ও খুচরা দোকানের ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ রয়েছে। এত সুযোগের পরও সারা দেশে প্রায় অর্ধেক ওষুধের দোকানের লাইসেন্স নেই। কেউ একেবারেই নিবন্ধন নেয়নি, কেউ নিলেও পরে নবায়ন করেনি।


Exit mobile version