অতি আবেগের ভাইরাস


আমরা বড়ই আবেগ প্রবণ জাতি।অতি আবেগ সচারাচর ভুল পথে প্রবাহিত করে।আমরাও আমাদের  অতি আবেগে প্রায়ই ভুল পথে পরিভ্রমণ করি।এমন ঘটনা আমাদের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত  হয়েছে।সম্প্রতি ফেসবুকে আমরা অতি আবেগ তাড়িত হয়ে দুটো জঘন্য ঘটনার জন্ম দিয়েছি।একটি  বুয়েট ছাত্র আবরার ফারহাদ হত্যার ঘটনা অন্যটি ভোলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যাক্তির ফেসবুক আইডি  হ্যাক করে হযরত মোহাম্মদ সাঃ কে কটূক্তি করাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনা।উগ্র জাতীয়তাবাদ  ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় নিহত অজশ্র শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আজ এই দুই ঘটনা নিয়ে আমার  একান্ত কিছু মতামত আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

ফেসবুকের পোস্ট কে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনা আমাদের দেশে স্মভবত এই প্রথম।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই সাইট যে কারো প্রাণ নিতে পারে তা বোধকরি ফেসবুকের  অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকার্বাগ সাহেবও কখনো কল্পনা করেননি।তাতে কি ভালো মন্দ রেকর্ড  গড়তে আমাদের সোনার ছেলেদের জুড়ি মেলা ভার।

সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ভারত আর বাংলাদেশের  মধ্যকার ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে নিজের মতামত ফেসবুকে পোস্ট করে বুয়েট ছাত্র
আবরার ফারহাদ।ব্যাস ছাত্রলীগের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পাসে ডাক পড়ে আবরারের।এরপর রাত থেকে  ভোর অব্দি দফায় দফায় পৈশাচিক এবং নারকীয় কায়দায় পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় সম্ভবনাময়  এই ছাত্র টিকে।বাঁচার প্রবল আকুতিতেও সামান্যতম মন গলেনি মদ্যপ হত্যাকারীদের।

হত্যার পর শুরু হয় জঘন্য ব্লেম গেম এর খেলা।হত্যাকান্ডের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আবরারকে  শিবির কর্মী আখ্যায়িত করে হত্যাকারী ছাত্রলীগ নেতারা,সেই সাথে উধাও করার চেষ্টা করা হয়  হোস্টেলের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ।ছাত্রলীগের হাতে খুন হলেই সে শিবির কর্মী এই র্প্যাকটিস  এর আগেও আমরা বহুবার দেখেছি।আমার মনে হয় এধরণের প্রপাগ্যান্ডা ছড়িয়ে ঘটনা ভিন্নখাতে  প্রবাহিত করা এবং বিচারহীনতার অপরাজনীতি আজ ছাত্রলীগকে খুনি সন্ত্রাসীদের অভয়অরণ্যে  পরিণত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবে আর তারই ছাত্র সংগঠন ছাত্র  খুন করবে এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায়না।এই দায় ভার খোদ আওয়ামীলীগ সভাপতি এবং  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।তবে সম্প্রতি চাঁদাবাজির অপরাধে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়  সভাপতি-সাধারণ  সম্পাদক এবং দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুদ্ধি  অভিযান একটু হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে।আশা করি দূর্নীতি মাদক এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই  শুদ্ধি অভিযান চলমান থাকবে।

হত্যার ঘটনা বুয়েট সহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে  সর্বস্তরের ছাত্র জনতা,শুরু হয় দেশব্যাপি তীব্র আন্দোলন। আবরার ফারহাদ হত্যার সাথে জড়িত  সকলকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে,রিমান্ডে নিয়েছে,অনেকেই স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দিয়েছে  এবং তারা বর্তমানে কারাগারে আছে।এসব খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে কিনা এনিয়ে সারা দেশ  সন্দিহান হলেও আমি উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে-হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল কারণ কি আর এর প্রতিকারই  বা কি?। মত প্রকাশের পূর্ন অধিকার একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান শর্ত বলে আমি মনে করি।

অথচ  গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে মত প্রকাশের অপরাধে হত্যার স্বিকার হতে হল আবরার ফারহাদকে,গণতন্ত্রের  জন্য এই ঘটনা লজ্জাজনক। আগেই বলেছি… বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিতে আমরা আপদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে তো আছিই অনেক  আগে থেকে সেই সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা এবং রাজনীতিতে বিরোধী মতের সুষ্ঠু চর্চা না থাকায়  ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে অনেক অনেক দুরে সরে গেছি আমরা।তাইতো  সরকার কিংবা সরকারি দলের কারো সামান্যতম নেতিবাচক সমালোচনাও সহ্য করতে পারছেনা  তাদের দলের নেতাকর্মীরা।

এই ধরণের উগ্র চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে সুষ্ঠু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা  করতে হবে সরকারকেই তা না হলে এমন অনেক আবরার অকালে উগ্ররাজনীতির বলি হবে।
আরেকটি অতি আবেগি ঘটনাও না বললে নয় যা এই ঘটনার সাথেই ্সম্পৃক্ত । আবরার ফারহাদ  হত্যার ঘটনায় আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীরা যে কটি দাবি জানায় তার মধ্যে একটি ছিল বুয়েটে ছাত্র  রাজনীতি বন্ধের দাবি।সবকটি দাবির সাথে এই দাবিটিও মেনে নেয় বুয়েট প্রশাসন এবং বুয়েটে ছাত্র  রাজনীতি বন্ধ করা হয়।অতি আবেগি হয়ে শিক্ষার্থীরা যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিছুদিন গেলেই  বোধকরি তারা বুঝতে পারবে।

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলেই ক্যা¤পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করবে,খুন  সন্ত্রাস চাঁদাবাজি এসব বন্ধ হবে এই ধারণা ভুল।ছাত্র রাজনীতির নামে আজ যা চলছে তা জঘন্য
অপতৎপরতা হলেও প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি মহান ব্রত এবং বাংলাদেশ বিনির্মানে ঐতিহাসিক ভাবে  গৌরব উজ্জল অবদান রেখেছে। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানানো শিক্ষার্থীদের কাছে আমার  একটি প্রশ্ন –বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি আদও কি চালু ছিল ?।

দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে ছাত্র সংসদ  নির্বাচন,প্রগতিশীল গণতান্ত্রিকতার তেমন কোন চর্চাও ছিলনা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে।হ্যা তবে  নামে মাত্র ছাত্রলীগের কমিটি থাকলেও তাতে যে ছাত্র রাজনীতির চর্চা হত না সে বিষয়ে আমি  নিশ্চিত। তাহলে কিসের ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানালেন আপনারা আর ছাত্র রাজনীতি বলতেই বা  আপনারা কি বোঝেন এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।ছাত্র রাজনীতি বলতে আপনারা যদি ছাত্রলীগের  রাজনীতি বুঝে থাকেন তবে আপনারা ভুল।দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী হলেও ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে  আপনাদের মেধার ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি।

আজ যে বাংলা ভাষায় কথা বলছেন,আজ যে  নিজের দেশ বাংলাদেশ পেয়েছেন,এই যে লাল সবুজের পতাকা,এই যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছেন  তার সবটিতে ছাত্র রাজনীতির মুখ্য ভূমিকা আছে।আজ ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে ঠিকি তা বলে  ছাত্র রাজনীতির অবদান ভুলে গেলে চলবে না।ছাত্র সংগঠন করা মানে ছাত্র রাজনীতি নয়,অমুক  নেতার হাত কে শক্তিশালী করার জন্য দল করা মানে ছাত্র রাজনীতি নয়,ক্যাম্পাস দখল মিটিং মিছিল  করা মানে ছাত্র রাজনীতি করা নয়,পোষ্ট পেয়ে হাজার হাজার কর্মী নিয়ে সোডাউন করা মানে ছাত্র  রাজনীতি নয়-ছাত্রদের কল্যাণে,দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং সর্বপরি সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের  অধিকার আদায়ে লড়াই সংগ্রাম করাই প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি।ছাত্র রাজনীতি কখনোই খারাপ চর্চা নয়  এটা আমাদের সকলেরই বোঝা উচিৎ।বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি  উঠে,কেউ অতি আবেগের বশে কেউবা জেনে বুঝে এই দাবি তোলে।

যারা জেনে বুঝে ছাত্র রাজনীতি  বন্ধ করতে চায় তারা মূলত একটি ফ্যাসিস্ট ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।কারণ তারা জানে অন্যায়  আর জুলুম প্রতিষ্ঠায় ছাত্র রাজনীতিই তাদের প্রধান বাঁধা।তাইতো তারা বিভিন্ন সময় ইনিয়ে বিনিয়ে  ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পাঁয়তারা করে।ছাত্র খুনের দায়ে যদি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হয় তবে অগণিত  মানুষ খুনের দায়ে বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড তথা জাতীয় নির্বাচন বন্ধ করা উচিৎ কারণ  বিগত নির্বাচন গুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের যে পরিমাণ নেতা কর্মী ও সাধারণ মানুষ মারা  গেছে তা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র খুনের সংখ্যায় কয়েকগুণ বেশি।আমাদের সকলকে বিশেষ করে
ছাত্র সমাজকে এই চক্রান্তের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

এবার আসি ভোলার ঘটনার প্রসঙ্গে।ফেসবুক কে ব্যবহার করে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর ঘটনা প্রথম  নয় এর আগেও অনেক বার হয়েছে রামুর বৈদ্ধ বিহারের ঘটনা এর মধ্যে অন্যতম।তো বরাবরের মত  এবারো একই দৃশ্যপট।জনৈক হিন্দু ছেলের আইডি হ্যাক করে হযরত মোহাম্মদ সাঃ কে গালিগালাজ  করা হয়েছে।অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং থানায় রাখে এরমধ্যেই বিক্ষুব্ধ মুসলমানরা  থানায় আক্রমণ করে এবং অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে।পরিস্থিতি বেগতিক হলে  পুলিশ আÍরক্ষায় গুলি চালায় এবং কয়েকজন নিহত হয়।

একবার ভাবুনতো কোন হিন্দু রাষ্ট্রের একটি  গ্রামে একশো ঘর হিন্দুর বাস আর মুসলমান আপনারা তিন চার পরিবার এমন অবস্থায় আপনি কি শ্রী  কৃষ্ণ কে গালিগালাজ করবেন? নিশ্চয় করবেন না।আমার তো মনে হয় সুস্থ মাথার কেউ একাজ  করবেনা কারণ বিচার শালিশতো দূরের কথা আপনাকে তাৎক্ষনিক পিটিয়েই মেরে ফেলবে।আমাদের  সবারই নিশ্চয় কোন না কোন হিন্দু বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ,সহকর্মী  অথবা পরিচিত আছে,মনে করে  দেখুন তো আমরা বিভিন্ন সময় ইয়ার্কির ছলে তাদের এমন অনেক কথাই বলি নি কি যা তাদের  ধর্মীয়  অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তার বিপরীতে কখনোকি তারা আমাদের ধর্ম অথবা ধর্মীয় মহাপুরুষদের ব্যাপারে কটূক্তি করেছে ? সচারাচর উত্তরটা না বোধক নয় কি ?

হিন্দুরা  যে আমাদের দেশে রিলিজিয়াস মাইনরিটি সেটা তারা ভালো করেই জানে এমত অবস্থায় নিজের  জীবনবাজী রেখে আমাদের প্রধান নবীকে গালি দেবার মত ধৃষ্টতাতো পাগলেও দেখাবেনা বলে আমি  মনে করি।অথচ কোন কিছু বিচার বিশ্লেষণ না করেই আমরা আগেব গায়ে মেখে উন্মাদনায় মেতে  উঠি। কখনো মানুষ হত্যা করি কখনো নিজেই মরে যায়।মোহাম্মদ সাঃ কিংবা শ্রী কৃষ্ণ কে গালি দিলে  আমাদের যতই মান সম্মান যাক না কেনো তাদের কিন্তু মোটেও মান যায় না।তাদের মান সম্মান  এতো নিছক কিছু নয় যে নাগণ্য কারো গালিগালাজে তা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

আমার বাবাকে কেউ চোর  বললেই যে আমার বাবা চোর হয়ে যায়না এই জ্ঞান আমারতো স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই হয়েছে  তবে আমাদের সকলের যে আজো হয়নি তা আমরা বারবার প্রমাণ করি।ধর্মের নামে রাজনীতি করা  উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বারবার ধর্মপ্রাণ বাঙ্গালিকে নিজের ফায়দা হাসিলে ব্যবহার করেছে।তাইতো  অতি আবেগি বাঙ্গালি অতি কল্পনায় কখনো মসজিদের মিনারে চাঁদ তারা দেখেছে,কখনো গায়েবী  জিহাদি বক্তৃতা শুনেছে,কখনোবা চাঁদের গায়ে বানরের ছবি দেখেছে এবং কোন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই  জীবন বাজী রেখে অথাকথিত জিহাদে ঝাপ দিয়েছে।

অতি আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের শিখতে হবে।অতি আবেগের ভেলায় ভেসে আমরা কোথাই  গিয়ে পৌছাচ্ছি সেটা ভেবে দেখতে হবে।বিচার বিশ্লেষণ করবার ক্ষমতা আছে বলেই আমরা মানুষ  অথচ সেই মানবিক চরিত্র থেকে বেরিয়ে আমরা দিনকে দিন পিশাচে পরিণত হচ্ছি।অতি আবেগের  খেসারত বহু বার দিতে হয়েছে আমাদের।তাই আসুন আমরা সচেতন হই,নিজেদের মানবিক ক্ষমতা  কাজে লাগাই।অতি আবেগের বসবর্তি না হয়ে যেকোন ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ করে সচেতন মানুষ হিসেবে কাম্য পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

লেখকঃ তামিম শিরাজী।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক ,বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।


শর্টলিংকঃ