অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ‘আদিবাসি ছাত্র পরিষদ’


সুব্রত গাইন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় :

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা প্রাচীনকাল থেকে আদ্যাবধি নিপীড়নের শিকার। নামমাত্র অধিকার বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও তা বই পুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির কথা উল্লেখ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মৌলিক মানবাধিকার থেকেও অনেক পিছিয়ে।

বিভিন্ন জাতীয় দিবসও পালন করেন আদিবাসী শিক্ষার্থীরা

নিজেদের জমি জোর করে দখল করছে ভূমি দস্যুরা, ঘরবাড়ি লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একদিকে যেমন ভূমিদস্যুদের অত্যাচার অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্যের কারণে আদিবাসীরা রয়েছে চরম সংকটে।

এই শোষন-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে স্কুল, কলেজ থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সকল উপজাতিদের ভাষা-সংস্কৃত, ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সচেষ্ট করার ভূমিকা পালন করছে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ।

নিজেদের আত্মসম্মান গড়ে তোলা, অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আদিবাসী ছাত্র পরিষদ। হরেন্দ্রনাথ সিংহ কে আহ্বায়ক ও মানিক সরেনকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকেই আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে চলছে সংগঠনটি।

সংগঠনটির অন্যতম উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐক্য, প্রগতি ও জাতিগত সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ করা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমস্যা সমাধান করা। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে নিজ সংস্কৃতি ঐতিহ্য সম্পের্কে সচেতন করা।

এছাড়াও প্রান্তিক এলাকায় বসবাস করা শিশুদের স্কুলগামী করার জন্য তারা নানা সেমিনার, পুস্তক বিতরণ, বৃত্তি প্রদানসহ নানা উন্নয়ন মুখি কাজ করে যাচ্ছেন।

আদিবাসী ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে নবীন বরণ

আদিবাসী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক মানিক সরেন বলেন, আমাদের সংগঠনে করার প্রধান লক্ষ্যই ছিল আদিবাসীদের শিক্ষা থেকে শুরু করে অন্যান্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা।

সংগঠনটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় সে সময় এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র দশ জন। অনেক চড়াই-উতড়াই পার করে আমাদের পথ চলা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর বাইরের কলেজগুলোতে আদিবাসীদের মধ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করে। তাদের ভিতরে সাঁওতাল, মারমা, চাকমা, মুন্ডা, মাহাতো, পাহান, সরেন, সিং, বাগদীসহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও আছে।

শুধুমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাওতালদের জন্য একটি ও উড়াওদের নিয়ে আলাদা একটি সংগঠন আছে। তবে ওই সংগঠনে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর কেউ সদস্য হতে পারবে না। ফলে তাদের যে সমস্যা হবে তা দেখার মতো কেউ থাকবে না।

তাই এমন একটা সংগঠনের প্রয়োজন হয় যেখানে সব সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধভাবে থাকতে পারবে। এই চিন্তা থেকেই সংগঠনটির উদ্ভব হয়েছে বলে জানান মানিক সরেন।

সংগঠনের সভাপতি নকুল পাহান বলেন, ‘আমরা সংগঠন করি শুধু নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নয়। বরং বাঙালিদের নিয়েও কাজ করি। কেননা আমরা বাঙালিদের থেকে আলাদা কেউ না। তবে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করা। তারা যাতে আগের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে আসে।

এছাড়াও আমরা গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করি। তাদের আবাসন সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করি। বিভিন্ন জায়গায় নির্যাতনের শিকার হলে সে যে জাতিই হোক না কেন- আমরা সেই ঘটনার প্রতিবাদে সভা, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ নানা ধরণের অন্দোলন করে থাকি।’

শিক্ষায় এগিয়ে আসছে আদিবাসী নারীরাও

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তরুন মুন্ডা অভিযোগ করে জানান, আমাদের আদিবাসীরা মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। দেশের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমনি চাকুরির ক্ষেত্রগুলোতে আদিবাসীরা পর্যাপ্ত কোটা পায় না।

অধিকাংশ আদিবাসি গরিব হওয়ায় তাদের সন্তানদের ভালভাবে প্রাথমিক শিক্ষাও দিতে পারে না। তাদের জন্য আলাদা বৃত্তির ব্যবস্থা না থাকায় তারা ঝরে পড়ছে। টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বিদেশে যেতে পারে না।

তবে নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জন করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে আদিবাসী ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীরা বলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত প্রভূতি বিষয়গুলো আছে কিন্তুবাঙালি জাতি হয়েও আদিবাসিরা মাতৃভাষায় জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পাচ্ছে না। আদিবাসিরা তো বাংলাদেশেরই জনগণ আর ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধেও আদিবাসিদের ভূমিকা রয়েছে।

অধিকার আদায় করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে চলছে তারা। এই শোষন-বঞ্চনা আর নিপীড়নের ভেতর দিয়ে আদিবাসীরা আজও আশায় বুক বাঁধে। আবার নতুন করে সংগঠিত হয়। নতুন পথ চলার দিশারি হিসেবে খুজে পায় আদিবাসি ছাত্র পরিষদকে।


শর্টলিংকঃ