অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজের দিকে তুলুন


ছোটবেলায় একবার বাবাকে না বলে বাবার ম্যানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা নিয়েছিলাম। বাবা জানতে পেরে কড়া শাসন করেছিলেন। তারপর আর কোনদিন বাবাকে না জানিয়ে টাকা নেই নি। প্রসঙ্গ হচ্ছে দুর্নীতি, অপরাধ, চুরি, মেরেধরে খাওয়া, অন্যায় করা, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি। কথায় কথায় আমরা সরকারেরর উপর সমস্ত খারাপ ঘটনার দোষ চাপাই।

বন্দুক যেমন অন্য দিকে তাক করা সহজ আঙ্গুলটাও বুঝি তাই! কাউকে দেখলাম না নিজের আঙ্গুলটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে, আমি কি ঘুষ খাই? আমি কি দুর্নীতি করি? আমি কি অন্যায় করি? আমার জন্য কারো অসুবিধা হচ্ছে কি না? আমি অন্যের হক মেরে খাচ্ছি কি না? আমি কি চুরি করছি? কি? দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাই না?

দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি সৎ হয় দেশ বদলাতে বাধ্য। আমি প্রথমে ছোট জায়গা থেকে শুরু করছি। ধরুন আপনি একজন রিকশা, সিএনজি বা অটোচালক। আপনার শহরে অপরিচিত নতুন যাত্রীর কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেন কি না? বিসিএস, ব্যাংকসহ যত ধরনের চাকুরির পরীক্ষা হয়, সেই দিন আপনারা ঠিকই দশ টাকার ভাড়া পনের টাকা আদায় করেন।

একই ভাবে আশেপাশের দোকানীরাও খাবারের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এগুলো দুর্নীতি নয়? এটাকে চুরি বলে না। অথচ আপনারাই সরকারকে গালি দেন, সরকার দুর্নীতিবাজ।

আপনি কুমার মাটির পাত্র ভাল করে না পুড়িয়ে সেল (বিক্রি) করছেন, আপনি কামার লোহার মধ্যে ভেজাল মিশাচ্ছেন, আপনি গোয়লা দুধের মধ্য জল দিচ্ছেন, আপনি দোকানী তেল, লবন, মসলা, ময়দাসহ যাবতীয় পণ্যে ভেজাল দিচ্ছেন। এই আপনারাই আবার সরকার দুর্নীতিবাজ বলে মুখে ফেনা তুলছেন।

আপনি মুরগির ফার্মের মালিক। মুরগিকে এন্টিবায়োটিক দিয়ে তিনদিন পরই বাজারে বিক্রি করছেন। আপনি গরুর ফার্মের মালিক। গরু মোটাতাজা করনের জন্য সকলপ্রকার ড্রাগ গরুকে খাওয়াচ্ছেন, গরু খুব দ্রুত বেড়ে উঠছে। আপনারা কি জানেন, আপনাদের এই এন্টিবায়োটিক কিংবা গ্রোথ হরমোন মানুষের কি পরিমান ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায়? অথচ আপনারাও সরকারকে গালি দিতে দ্বিধাবোধ করেন না।

আপনি শিক্ষক। আপনার কাজ শুধু পড়ানো নয়,বরং ছাত্রছাত্রীদের নৈতিক, দেশপ্রেমিক, সৎ এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আপনার গুরু দায়িত্ব। আপনি পালন করেন? নাকি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ব্যাক্তিগত কাজে ব্যাস্ত থাকেন?

শিক্ষক শব্দটা শুনলে বিনয় আর অমায়িক একটা বিষয় চলে আসে। আপনি নম্র হবেন, ভদ্র হবেন, সুচরিত্রের অধিকারি হবেন। তা না হয়ে যৌন হয়রানিন মত কাজে লিপ্ত হন কেন? কোমলমতি শিশুটাকে আপনার মেয়ে ভাবতে পারেন না? এই আপনিই আবার অন্যর দিকে আঙ্গুল তুলেন।

আপনি অভিভাবক, ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান। ভালো কথা,তা ছেলেকে কি শুধু উচ্চশিক্ষিত করতে চান নাকি সাথে একজন উৎকৃষ্ট ভালো মনের মানুষ ও করতে চান? যদি তাই হয়, তবে প্রশ্ন কিনেন কেন?

প্রশ্ন কিনে পরীক্ষার আগের রাতে যে ছেলেটার হাতে তুলে দিচ্ছেন মনে রাখবেন সেই ছেলেটা যত উচ্চ পর্যায়ে যাকনা কেন ভালো মানুষ কোন দিন হবে না। মনে রাখবেন,আপনিই তাকে দেশ বিক্রি করতে শেখালেন।

আপনি পথচারি, প্রতিদিনই আপনাকে রাস্তায় বেরুতে হয়। আপনি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন করে বেশ বড় তারকা বনে গেছেন। অথচ আপনিই সড়কে চলাচলের নির্দেশনা অমান্য করে যত্রতত্র সড়ক পারাপার করেন। আপনিই যখন ড্রাইভিং সিটে বসেন তখন আর সিগনাল মানেন না, স্পিড মানেন না এমনকি উল্টো পথে চালাতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

আপনি ছাত্র। পড়াশুনা করাটা আপনার ধর্ম পালনের সমান। কিন্তু চিত্রপট উল্টো। আপনার ইচ্ছা হলে ক্লাস করবেন না হলে করবেন না, পরীক্ষা ভালো হোক কিংবা খারাপ মার্কস আপনার চাই, পরীক্ষার হলে অন্যের দেখে লিখবেন কিন্তু শিক্ষক কিছু বলতে পারবে না কিংবা যদি নকল করতে বাধা পান শিক্ষকের সাথে খারাপ ব্যাবহার করবেন। কেমন ছাত্র আপনি? আর যা বলেন,শিক্ষক খারাপ এই কথা আপনার মুখে বেমানান।

আপনি ছাত্র রাজনীতি করেন। বেশ পরিচিতি আপনার। কিন্তু গোপনে গোপনে হলের ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন, ড্রাইনিং এ ফ্রিতে খান, ক্যাম্পাসের ছোট দোকানীর কাছ থেকে ফ্রিতে নেন ধুম্রশালাকা , মাদক সেবনে আপনি সিদ্ধহস্ত, ছোট বড় টেন্ডারে করেন চাঁদাবাজি।

অথচ নিজেকে সাধু ভাবেন। বড় পরিসরে এইসব কুকর্মের জন্য যখন জায়গা পাননা, তখন করেন দলবদল, রাজনৈতিকদের গালিগালাজ। আপনি নেতা হলে আর যাই হোক দেশ গঠন হবে না।

আপনি ডাক্তার। রোগীর সেবা করা আপনার ধর্ম। ডাক্তারি পড়তে সরকার আপনার পেছনে যে টাকা ব্যায় করে তাতে কুলি, কামার-কুমার, চাষা, শ্রমিক সবার ঘাম ঝড়ানো টাকা আছে। তাদের উপার্জিত অর্থে পড়াশোনা করতে আপনার বাধে না কিন্তু তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে আপনার বাধে।

গ্রামের হাসপাতালে পোস্টিং দিলে খুব মন খারাপ করে। আপনি সরকারি বরাদ্দের ঔষধ রোগীর কাছে না দিয়ে বাজারে বিক্রি করেন। উন্নত যন্ত্রপাতি ক্রয়জনিত মুনাফা ভোগ করেন। এই ক্লিনিক, ওই ক্লিনিক ক্ষ্যাপ মেরে বেড়ান।

ঔষধ কোম্পানি আর ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের দালালি করেন ও মুনাফার ভাগ নেন। গরীব রোগীটাকে তিলে তিলে পৃষ্ট করে মারেন। অথচ এই আপনিই অন্যের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলেন “দুর্নীতিবাজ”।

আপনি ঠিকাদার, প্রকৌশলি, পুলিশ, জর্জ-ব্যারিষ্টার, আমলা, রাজনীতিবিদ। আপনারা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন, আপনারা সৎ। ঠিকাদার সাহেব কি বলতে পারবেন, ঘুষ না দিয়ে আপনি কাজ পেয়েছেন। আর ঘুষ না দিয়ে আপনি কাজের টাকা ছাড় কারাতে পেরেছেন?

প্রকৌশলি মহাশয়, আপনারা রাস্তা,বিল্ডিং কিংবা অন্য কোন স্থাপনা নির্মান শতভাগ সততার সাথে করেছেন কখনো? আপনার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবুন, আপনি কি ঘুষের টাকায় তাকে মানুষ করতে চান?

পুলিশের কাজ জনগনের নিরাপত্তা দেওয়া। অথচ আপনারা আজ জনজীবনকে অতিষ্ট করে তুলছেন। টাকার জন্য আপনি নিরপরাধ মানুষকে অপরাধী বানাচ্ছেন। টাকা খেয়ে দোষীকে নির্দোষ প্রমাণ করছেন। রাস্তার ট্রাফিকিং এ চাঁদাবাজি করছেন।

ছোট বড় পুলিশ ভেরিফিকেশনেও টাকা ছাড়া আপনার কলম চলে না। সন্ত্রাসীদের সাথে মিলে চুরিচালান, ড্রাগ ব্যাবস্যার খবর পত্রপত্রিকায় চলে আসছে নিয়মিত। আপনারা কি করে অন্যের দিকে আঙ্গুল দেখান?

আপনি উকিল। একজন সর্বজন স্বীকৃত অপরাধীর পক্ষে আইনি লড়াই করেন। আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির পক্ষে লড়াই করেন। আপনি টাকার জন্য ধর্ষণকারী, হত্যাকারী কিংবা দুর্নীতিবাজদের সাজা পেতে দেন না। জর্জ-ব্যারিষ্টার সাহেবেরা আপনাদের সহাহায়তা করেন। এই আপনারাও অন্যর দিকে আঙ্গুল তোলেন।

প্রতিটি জনগন কোন না কোন ভাবে দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত। রাজনীতিবিদদের ঘুষখোর বলে আপনিই গালি দেন, সেই আপনিই ছেলে-মেয়ের চাকুরির জন্য ঘুষ দেন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে, আমরাই রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি কারার সুযোগ দেই। আর এটা শুরু হয় ভোটের দিন থেকে। কারন আমরা পকেট ভারি করে ভোট দেই।

নিজের আঙ্গুটা একবার নিজের দিকে তুলুন। আসুন নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজেরা সৎ থাকি, নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি, অন্যায় করা থেকে বিরত থাকি। নিজেকে শতভাগ নিজের কাজে নিযুক্ত রাখার নামই দেশপ্রেম। দেখবেন ছোট এই পরিবর্তনে পুরো দেশের পরিবর্তন ঘটবে।

 

লেখক: নয়ন চন্দ্র মহন্ত
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ,
সহকারি অধ্যাপক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


শর্টলিংকঃ