অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো মান সম্মান ফেরত পাব না : আত্মহত্যার আগে চিরকুটে স্কুলছাত্রী


 বিশেষ প্রতিবেদক : 

‘অপরাধীকে শাস্তি দিলেই তো আমার মান সম্মান ফেরত পাব না। তাই আমাকে ক্ষমা করো’- আত্মহত্যার আগে শেষ চিঠির শেষ লাইনে  ঠিক এমন দহনের কথাই লিখেছে সুমাইয়া আক্তার বর্ষা। চিঠিটি লিখেছিল বাবা-মাকে। বর্ষা বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়তো।  স্কুলের স্কাউটদলের সে টিম লিডার ছিল সে। শেষ পর্যন্ত বখাটেদের নিপীড়ন বাঁচতে দিল না তাকে।

সুমাইয়া আক্তার বর্ষা
সুমাইয়া আক্তার বর্ষা

বলেছিল,  ‘একটা মেয়ের কাছে তার মান সম্মানটাই সব চাইতে বড়।  আমি আমার লজ্জার কথা সবাইকে বলতে বলতে নিজের কাছে অনেক ছোট হয়ে গেছি। প্রতিদিন এসব পর পুরুষের কাছে বলতে বলতে। আর পারছি না!’

বখাটের নিপীড়নের অতিষ্ঠ হয়ে থানায় মামলা করেছিল।তাই হাজারো লাঞ্ছনা ও অপবাদে জর্জরিত হতে হয়েছিল বর্ষাকে। এসব সইতে না পেরে গেল বৃহস্পতিবার নিজ বাড়িতেই গলায় ফাঁস দেয় বর্ষা। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মোহনপুর বিলপাড়ার আব্দুল মান্নানের ছোট মেয়ে।

বর্ষার বাবা আব্দুল মান্নান ও মা ফরিদা বেগম

শনিবার সকালে বর্ষাদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, মা ফরিদা বেগম অন্ধকার ঘরটাই ঘরে একা বসে আছে। ঘরে দরজায় হেলান দিয়ে মেঝেতেই বসে বিলাপ করছেন বড়বোন জান্নাতুল ফেরদৌস চাঁদনী। আর বাবা আব্দুল মান্নান বারান্দায় একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে শোক স্তব্ধ।

বৃহস্পতিবার ইফতারিতে মজা করে বড়া খাওয়ার জন্য নিজহাতেই ডাল ভিজিয়েছিল বর্ষা।দুপুরে মা ফরিদা বেগম গিয়েছিলেন বাড়ির বাইরে। বাইরে কাজে গিয়েছিলেন বাবা। রোজার তপ্ত দুপুর। প্রখর রোদে তেতে উঠেছে প্রকৃতি। ঘরে থাকা বড় দুই বোন চোখ বুঁজেছিল ঘুমে।এমন সময় পাশের ঘরটাই হয়তো নিরাপদ ভেবে বেছে নেয় বর্ষা। সবার অজান্তে ওই ঘরেই নিজের ওড়নায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।  আত্মহত্যার আগে চিরকুটে লিখে গেছে, নিপীড়নের বিচার না পাওয়ার কথা।

   বর্ষাদের বাড়ি

ওই চিঠিতে কারো নাম উল্লেখ করে নি বর্ষা। তবে  পরিবারের অভিযোগ, পাশের বাড়ির মুকুল নামে এক যুবক দীর্ঘদিন ধরে উত্যক্ত করে আসছিল বর্ষাকে। মুকুলের সাথে যোগ দেয়া তার পরিবারও। অকারণেই তারা নানা ধরনের কটূক্তির করতো বর্ষাকে।

মা ফরিদা বেগম বলছিলেন, তাদের কোনো ছেলে নেই। তিনজনই মেয়ে। বর্ষা সবার ছোট। বাবার বয়স হয়েছে। বাড়িতেই তিন বোন নিয়ে থাকেন। তাই  সামাজিকভাবে অনেকটা কোণঠাসা। শ্রমজীবী বাবার ওপরেই সংসারের ঘানি। ফলে আর্থিক অভাব অনটনেই চলে সংসার। অসহায় অবস্থা।

ফরিদা বেগমের অভিযোগ, পাশের বাড়ির মুকুল নামে এক যুবক দীর্ঘদিন ধরেই বর্ষাকে উত্যক্ত করে আসছিল্।  কিন্তু বর্ষা তাকে পাত্তা দেয় নি। এসবের প্রতিবাদ করে আসছিল। ফলে বাড়ির বাইরে বের হলেই নানাভাবে হেনস্তা ও উত্যক্ত করতো মুকুল।

এ অবস্থায়, গেল ২৩ এপ্রিল বিকেলে বান্ধবী সোনিয়া বাড়িতে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বর্ষাকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে কিলোমিটার দূরে বাগবাজার এলাকায় অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।  বর্ষাকে উদ্ধার করে প্রথমে মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এঘটনায় মুকুল ও সোনিয়া জড়িত-এমন অভিযোগে ২৭ এপ্রিল মামলা করে বর্ষার বাবা।

পরে পুলিশ মুকুল ও সোনিয়াকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কয়েকদিন পরই জামিনে বেরিয়ে যায় সোনিয়া।

                                             আত্মহত্যার আগে বর্ষার লেখা চিঠি

এদিকে,  খানিকটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে বর্ষা। কিন্তু মামলায় মুকুল জেলহাজতে থাকায় তার মা কাজল রেখা প্রতিনিয়তই বর্ষাকে অপবাদ দিয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়ে আসছিল-এমন অভিযোগ রয়েছে। আত্মহত্যার কয়েকদিন আগে বাড়ির পাশে পুকুরে গোসল করতে গেলে সেখানেই বর্ষা উলঙ্গ করার চেষ্টাও করা হয়। ফলে বাড়ির বাইরের জগতটাই য়েন বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার কাছে।

মোহনপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সানজিদা খাতুন রিক্তা বলেন, বখাটে মুকুলে বিরুদ্ধে আগেই অভিযোগ করেছিল বর্ষার পরিবার।ইউএনও এবং আমার কাছেও অভিযোগ করার পর পুলিশও এসেছিল। তাকে অভয় দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরপর লাঞ্ছনা ও অপবাদ থেকে রেহাই পায় নি। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় উঠতে বসতে  বর্ষাকে গালাগালি করতো মুকুলের পরিবারের লোকজন।

তিনি বলেন,  বর্ষাকে মুকুল ও তার পরিবার আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। এর বিচার চাই।

এবিষয়ে মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন,  ২৩ এপ্রিল অপহণের অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। এরপর আত্মহত্যার ঘটনাতেও আলাদা মামলা করেছে বর্ষার বাবা। মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।  এতে মুকুল ও তার মা কাজল রেখাসহ ১৩ আসামী। এরমধ্যে প্রধান আসামী মুকুল ও কাজল রেখাসহ ৫জন জেল হাজতে রয়েছে।


শর্টলিংকঃ