আশুরা শোকের পাশাপাশি সুখেরও নিদর্শন


‘আশুরার দিনে শুধু নয় রোদন/আল্লাহর মহিমায় নিজেকে করো শোধন। দুঃখ-কষ্ট দিয়ে মালিক বান্দাকে করেন নিরুপণ/আশুরা শোকের পাশাপাশি সুখেরও নিদর্শন।’মহান আল্লাহ তাআলা বছরের যে কয়েকটি দিনকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন,তার মধ্যে আশুরা বা মহররমের ১০ তারিখ অন্যতম। ঐতিহাসিক ও ঘটনাবহুল এই দিনটিকে বলা হয় পৃথিবীর আদি-অন্তের দিন। অর্থাৎ এ দিনেই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে, আবার ধ্বংস বা কেয়ামত এই দিনেই সংঘটিত হবে।

রমজানের রোজা আগে মুসলমানদের জন্য এদিনে রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে নফল রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। [সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, দারেমি ও মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.]

আমাদের পেয়ারে নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা রাখতেন। কিন্তু হিজরতের পর মদিনায় এসে নবীজি দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবীজি তাদের এই দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলেন।

জানতে পারলেন ‘এদিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।

নবীজি বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য। এরপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে ২টি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। [মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.]

নবীজি (সা.) আরও বললেন, ‘আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে নবম দিনেও রোজা রাখব’। [মুসলিম ও সুনানে আবু দাউদ]

আশুরার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের নিকট আমি আশাবাদী যে তিনি এক বছর আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ [মুসনাদে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.]

যে সব ঘটনার কারণে আশুরা তাৎপর্যময় এবং মুসলমানদের ইতিহাসে শোকের পাশাপাশি সুখের নিদর্শন হয়ে আছে সেগুলো সংক্ষেপে হল-

১. আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। আবার এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

২. আশুরার দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে এসেছিলেন। আবার এ দিনেই আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেছেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেছেন।

৩. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির মানুষজন আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর আশুরার দিনে নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেছেন।

৪. হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর আশুরার দিনে সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেছেন।

৫. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর আশুরার দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেছেন।

৬. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তার ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হয়েছিলেন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ৪০ বছর পর আশুরার দিনে পিতার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।

৭. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হয়েছিলেন এবং মাছ তাকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পেয়েছিলেন আশুরার দিনে।

৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তার দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়।

৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে আশুরার দিনে আল্লাহ তাআলা তাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেছিলেন।

১০. আশুরার দিনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবীর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেছিলেন।

তবে এই দশটি শোক ও সুখের ঘটনার মধ্যে শেষ ঘটনাটির জন্য বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে আশুরা দিবসটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হয়। মোটকথা, পৃথিবীর ইতিহাসের অসংখ্য কালজয়ী ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে মুহররম মাসের ১০ তারিখ।

আর কারবালার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিও আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রচিত হয়েছে শোকাভিভূত এক নতুন অধ্যায়।

কারবালা প্রান্তরের এ বিয়োগাত্নক ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘মহররম’ কবিতায় আশুরার দিনের সে ঘটনাকে তুলে ধরেছেন এভাবে-

‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া-

আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া,

কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?

সে কাঁদনে আসু আনে সিমারেরও ছোরাতে।

রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে-

জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?

হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,

তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়

উন্মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়

আলীজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।’

যেভাবে আশুরা উদযাপিত হয় : ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে। শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে। আশুরা উপলক্ষে মুসলমানদের জন্য ৯-১০ মুহররম অথবা ১০-১১ রোজা মুহররম রোজা রাখা সুন্নাত। এ ছাড়া মুসলমানরা এ দিন উত্তম আহারের জন্য চেষ্টা করে থাকে।

কারবালার শিক্ষা: আশুরার দিন কারবালা প্রান্তরে মানব ইতিহাসের যে নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছিল তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্তি হল তাদের মজবুত ঈমান। তাই আমাদের ঈমানী চেতনায় বলীয়ান হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবন পরিচালনা করতে হবে।

কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) সপরিবারে আত্মত্যাগ করে সমগ্র বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিয়ে গেয়েছেন যে, মস্তক আল্লাহর কাছে নত হয়েছে। সে মস্তক কখনও বাতিল শক্তির কাছে নত হতে পারে না। আল্লাহর পথে অটল থাকতে মুমিনরা তাদের জীবনকে উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তাই আজকের মুসলমানরা সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শপথ নিতে পারলেই কেবল আশুরার তাৎপর্য প্রতিফলিত হবে।

আশুরার দিবসে করণীয়: প্রতিটি ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম দুটি শর্ত রয়েছে। এক. আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করা। দুই. ওই ইবাদত রাসূল (সা.)-এর আনীত শরিয়ত এবং বর্ণিত পথ ও পন্থা অনুসারে হওয়া। আশুরার দিবসে রোজা রাখা ছাড়া অন্য কোনো রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ইবাদত ইসলাম অনুমোদন করে না। তাই কেবল রোজা রাখার মাধ্যমেই দিনটিকে পালন করতে হবে। আশুরা হল সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাতিলের সঙ্গে সত্য-মিথ্যার লড়াই।

আশুরার বর্জনীয় বিষয়: আশুরার সুমহান মর্যাদা ও তাৎপর্যকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজে কিছু নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কারের প্রচলন হয়ে গেছে। সে সব থেকে বেঁচে থাকা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আশুরার দিন ক্রন্দন-বিলাপ করা, বুকে চাপড়ানো, পিঠে চাবুক দিয়ে আঘাত করা, নিজেকে রক্তাক্ত করা ও শোক মিছিল করা কোনোটিই শরিয়তসম্মত কাজ নয়। কোরআন-হাদিসে এর কোনো ভিত্তি নেই।

অতএব আশুরার দিন শোক-মাতম না করে এখান থেকে কী শিক্ষা নেয়া যায় সে চেষ্টাই করা উচিত। তাছাড়া আশুরা মানে কেবল কারবালার ঘটনা নয়; এদিন ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা ঘটেছে। মুসলমানদের ইতিহাসে এদিনে শোকের পাশাপাশি সুখ ও বিজয় আছে। আর কারবালার ঘটনা ওই ঘটনাগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনা, যার মধ্যে মুসলমানের অনেক শিক্ষার বিষয় আছে।

পরিশেষে বলা যায়, আশুরার এই ঐতিহাসিক ঘটনার মূল চেতনা হচ্ছে ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চক্রান্ত ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বর্তমান বিশ্বে আশুরার এই শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালার ঘটনা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের দুনিয়ার অন্যায় ও অবিচার দূর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

তাই আসুন, আল্লাহ তাআলার দরবারে বিনীত প্রার্থনা করি, তিনি যেন আশুরার ঐতিহ্য, গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অশেষ সওয়াব হাসিলের তাওফিক দান করেন। আর ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনা স্মরণে প্রতিটি মুসলমানকে ঈমানী চেতনা শক্তিতে বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন।


শর্টলিংকঃ