Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

ইউরোপের শিশু শিক্ষার ধরণ


ইউরোপের শিশুশিক্ষার ধরণ আমাকে প্রথমে করেছে অবাক পরে মুগ্ধ। তা কি করে সম্ভব? প্রশ্নটি খুবই আশাব্যঞ্জক। তবে উত্তরটি পেতে সময় লেগেছে ষোলটি বছর, তাইতো লেখাটি এর আগে লিখতে পারিনি

হ্যাঁ, বলব কিছু ঘটনা সঙ্গে বর্ণনা দেবো সুইডেনের শিশু শিক্ষার ধরণ। উদ্দেশ্য একটিই, আর তাহলো, যদি বাংলাদেশের শিশু শিক্ষার সঙ্গে এখানকার শিশু শিক্ষার অমিল থাকে তবে সেই অমিলটা খুঁজে বের করা। যদি দেখা যায় সেটা আমাদের জন্য ভালো তাহলে ভালো জিনিসগুলো আমরা অনুকরণ এবং অনুসরণ করতে পারি।

জন্মের প্রথম বছর শিশু তার মায়ের সঙ্গে সময় কাটায়। পরে তাকে সুইডিশ ডাগিসে (কিন্ডারগার্টেন বা ডে কেয়ার শিক্ষা প্রশিক্ষণ) ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ডাগিসে মায়েরা শিশুর সঙ্গে থাকেন। আস্তে আস্তে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষাবিদ এবং শিশুদের একটি সমন্বয় ঘটতে থাকে এবং মায়েদের উপস্থিতি কমতে থাকে এবং শেষে সকাল থেকে বিকেল অবধি সময় শিশুর শিক্ষা জীবন শুরু হয় ডাগিসে।
শিশুর বয়স ছয় বছর হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে নানা বিষয়ের ওপর নানাভাবে হাতেনাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়। ছয়টি বছর দাগিসে এরা শেখে বিভিন্ন বিষয় যেমন শেয়ার ভ্যালী, মনুষ্যত্ববোধ, ভাতৃত্ববোধ, একতা, সামাজিকতা। এক কথায় বলা যেতে পারে এখান থেকে জীবন গড়ার শুরুটাকে মজবুত করে তৈরি করতে সাহায্য করা হয়।

একজন ডাগিসের শিশুর মধ্যে সচেতনতার ছাপ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি বার বার। দেখেছি যখন আমার ছেলে মেয়ে ডাগিস থেকে বাড়িতে এসেছে। আমি যদি কোথাও কোন ভুল করেছি সঙ্গে সঙ্গে তারা বলেছে বাবা তুমি এটা এভাবে না করে এইভাবে কর।

আমাদের ডাগিসের শিক্ষকরা এটা এভাবে করতে বলেছে। আমি অবাক হয়েছি আর তাদের থেকে নতুন নতুন বিষয় শিখেছি। শেখার সঙ্গে সঙ্গে তারাও বুঝেছে বাড়িতে এবং সমাজে তাদের ভ্যালী কত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ব্যক্তিত্ব এবং আত্মমর্যাদার বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয় ছয় বছর বয়সে। যা না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়।

ছয় বছর বয়সে কোন রকম প্রেশার (চাপ প্রয়োগ) ছাড়া একজন শিশুকে গড়ে তোলা, যেখানে তার শিশুকাল হারিয়ে যায়নি, যেখানে সে খেলাধুলার মধ্যদিয়ে জীবনের পরিকাঠামো তৈরিতে যা যা দরকার তার সব পেয়েছে। যার কারনে জীবনে চলার পথে দ্বন্দ্ব নয় প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে সে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে শুরু করে।

এবার স্কুলের জীবন শুরু। জীবনের নতুন অধ্যায়। জানা, দেখা, নিজের হাতে সব কিছু তৈরি করা। নিজের চেষ্টায় কিছু করা। দেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা। নতুন এবং পুরনোর সংমিশ্রণে চিন্তার উন্নয়ন করা। প্রকৃতিকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করা। অজানা এবং অচেনাকে চেনা। সব কিছুর সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে পড়া। যা এদের জীবনকে পরিপূর্ণতা দিতে সাহায্য করে।

ছয় বছর থেকে পনের বছর বয়সে এরা শিক্ষার বেসিকের সঙ্গে সুন্দরভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ সময়ের শিক্ষায় জীবনের দিক নির্দেশনা সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ছবি দেয় বিধায় তারা বেশ সচেতন হয়ে ওঠে। তারা কি হতে চায় তাদের কর্মজীবনে।

আমি কখনও দেখিনি আমার ছেলে-মেয়েকে বই পড়তে বা লেখাপড়া করতে বাড়িতে। মাঝে মধ্যে তাদের জিজ্ঞেস করেছি, কি কোন হোম ওয়ার্ক নেই? তারা বলেছে,
-বাবা তুমি কত ঘণ্টা কাজ কর?

-আট ঘণ্টা।

-বাড়িতে এসে কেন অফিসের কাজ করনা?

-কেন আমি তো অফিসেই আমার কাজ শেষ করে এসেছি, বাড়িতে কেন সেই কাজ করব?

তারা তখন বলেছে স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্য স্কুলের কাজ স্কুলে শেষ করা। বাড়ি এসে খেলাধুলা, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানো, মজা করা এসব করতেও তো সময় এবং মন দরকার।

আমি কখনও তাদের লেখাপড়া নিয়ে ঘাটাঘাটি করিনি। তবে খেলাধুলার ব্যাপারে বরং বেশি সময় দিয়েছি। তারা জীবনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তেমন কিছু মিস করেছে বলে আমার জানা নেই। এটা আমার ছেলে-মেয়েদের সৌভাগ্য হয়েছে বলে আমি মনে করি। যখন যা প্রয়োজন এবং যখন যা করার সময়, তা করতে পারার মাঝেই কিন্তু রয়েছে আসল আনন্দ।

যদি ফিরে যাই আমার জীবনের শুরুতে, আমাদের ছোটবেলার সময়ের সঙ্গে কিছুটা মিল এখানে আছে। যেমন আমরা স্কুলের পরে খেলাধুলা করেছি, দুষ্টুমি করেছি, নদীতে গিয়ে সাঁতার কেটেছি। তবে এখানকার মতো সব ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতি বা সুযোগ সুবিধা ছিলও না তখন, থাকলে মিস করতাম না।
তবে বাংলাদেশে বর্তমান শিশু শিক্ষার ধরণ যা শুনেছি বা দেখেছি সেটা বেশ আলাদা। যেমন পিঠে উটের মতো করে বইয়ের বোঝা তুলে দেয়া। স্কুল থেকে ফিরে বন্ধ ঘরে গৃহশিক্ষকের কাছে দীর্ঘসময় পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া। তারপর বাবা মার কাছে পড়া, পড়া আর পড়া।

এখানে একটি বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না, আর তা হলো যারা ড়িৎষফ পষধংং খেলোয়াড় হতে চায় তাদের ধপঃরারঃরবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে ভিন্ন। কারণ এলিট স্পোর্টসে দরকার প্রচুর মোটিভেশন, ডেডিকেশন, সাফার এবং অফার। যেহেতু কথায় রয়েছে ডরহহবৎ ঃধশবং রঃ ধষষ ংড় ড়হব সঁংঃ ড়িৎশ যধৎফবৎ ঃযধহ ড়ঃযবৎং.

এ ক্ষেত্রে এলিট ক্রীড়াবিদদের জীবনের কিছু মজার সময় তারা মিস করে বিশ্ব সেরা খেলোয়াড় হওয়ার জন্য। ঠিক তেমনিভাবে যদি কেও এলিট শিক্ষার জন্য পুরো সময় ইনভেস্ট করতে চায়, যেমন শুধু ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার কারনে জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করে, তখন দেখা যায় তারা শৈশব এবং কৈশোরের অনেক কিছু মিস করেছে, যা পরে হাজার চেষ্টা করলেও সেটা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় দরকার সুন্দর পরিকাঠামোর। সে ক্ষেত্রে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের পুরো সময়ের ওপর সুন্দর ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।

কারণ মানব জীবনের শৈশব, কৈশোর, যৌবন একবারই আসে বারবার নয়, এ বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। একদিন শিশুর শৈশব, কৈশোর শেষ হয়ে যাবে, জীবনের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শিক্ষা জীবন শেষে কর্মজীবন শুরু হবে। তখন টাকা পয়সা, গাড়ি, বাড়ি সবই হবে তবে জীবনের পরিপূর্ণতা হয়ত আসবে না।

ইউরোপের শিক্ষায় রয়েছে সুশিক্ষা, সুচিন্তা, সুভাবনা। যেখানে কোন কিছুই বাদ দেয়া হয়না। সব কিছুই রয়েছে এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায়। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে চাই সেটা হলো ইউরোপের শিক্ষা পদ্ধতি সুস্থ এবং সমৃদ্ধ জীবন গড়ার এক চাবিকাঠি। বাংলাদেশ তার শিক্ষা পরিকাঠামোকে এমন করে তৈরি করতে পারবে বলে আমি মনে করি।


Exit mobile version