ইথেল ও জুলিয়াস রোজেনবার্গ


তখন ও এখনো অভিবাসীদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নিউইয়র্ক। কাছের থেকে দূরের হোক কোনো কোনো আত্মীয়ের দেখা এখানে মিলবেই। আত্মীয় না পেলেও সমস্যা নেই, অধিকাংশই তো অভিবাসী। বাঁচার পথ কেউ না কেউ দেখিয়ে দেবে এ ভরসা করেই প্রথম মহাযুদ্ধের আগে বার্নি গ্রিনগ্লাস রাশিয়া থেকে নিউইয়র্ক শহরে এসে বসতি স্থাপন করলেন শহরের লোয়ার ইস্ট সাইডে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সাবেক স্ত্রীর গর্ভজাত তার এক পুত্র সন্তান। এখানে এসে টেসি নামের যে আফ্রিকান তরুণীকে বিয়ে করলেন, তার গর্ভে জন্ম নিলেন ইথেল গ্রিনগ্লাস ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৫। তারপর আরো দুটো ভাই হলো ইথেলের। বার্নার্ড ও ডেভিড। অভিবাসীদের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন, ছোট বাড়িতে অনেকের বসবাস।

ইথেল সিওয়ার্ড পার্ক হাই স্কুলে পড়ার সময় নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং স্কুল পাঠ শেষ করার আগেই অভিনয়ের জন্য বেশ পরিচিত হয়ে উঠলেন। ১৯৩১ সালে স্কুল পাস করে একটি প্যাকেজিং ও শিপিং কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। চাকরিতে এসে জড়িয়ে পড়লেন সামাজিক কাজে, শ্রমিকের স্বার্থে রাজনীতিতে। এ রকম একটি রাজনৈতিক সভাতে পরিচিত হলেন তার চেয়ে তিন বছরের ছোট তরুণ ও উদ্যমী রাজনৈতিক কর্মী জুলিয়াস রোজেনবার্গের সঙ্গে। তাদের প্রেম শুরু হয়ে গেল, দুজনের তখন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি প্রবল আকর্ষণ, সাম্যবাদই পারে মানুষের মুক্তির মূলমন্ত্র হতে।

জুলিয়াস রোজেনবার্গের মা-বাবা দুজনই ইহুদি রুশ অভিবাসী। তার জন্ম ১২ মে ১৯১৮ নিউইয়র্ক সিটিতে। তিনিও ভর্তি হলেন সিওয়ার্ড পার্ক হাই স্কুলে। জুলিয়াস হিব্রুতে ভালো নম্বর পাওয়ায় মা-বাবা ঠিক করেন ছেলেকে ধর্মযাজক র্যাবাই বানাবেন। কিন্তু ধর্মযাজকের জীবন তাকে আকৃষ্ট করতে পারল না, তিনি আকৃষ্ট হলেন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি। ইয়ং কমিউনিস্ট লিগে যোগ দিলেন। ইথেলের তিন বছর পর স্কুল পাস করে ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য সিটি কলেজে ভর্তি হলেন। জুলিয়াস রোজেনবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরে যোগ দিলেন। কিন্তু কিছুকাল পর কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে তার পুরনো যোগসূত্র আবিষ্কৃত হলে তিনি চাকরিচ্যুত হলেন।

তার কয়েক বছর আগে ১৮ জুন ১৯৩৯ সালে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর বছর জুলিয়াস ও ইথেল বিয়ে করলেন। ১৯৪৩ প্রথম ছেলে মিশেল এবং ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় ছেলে রবার্টের জন্ম হয়। সংসার বেশ চলছিল।

১৯৫০ সালের জানুয়ারি ম্যানহাটন প্রজেস্টের (পারমাণবিক) তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ক্লস ফক্স (জার্মান শরণার্থী) গ্রেফতার হলেন। তিনি ব্রিটিশদের পক্ষে প্রকল্পে যোগ দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যুদ্ধের পুরো সময়টায় তিনি আণবিক বোমাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল সোভিয়েতদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তদন্তে বেরিয়ে এল এ পাচারে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করতেন একজন আমেরিকান, হ্যারি গোল্ড। ১৯৫০ সালে হ্যারি গ্রেফতার হন। হ্যারি স্বীকার করেন এবং তার একজন সহযোগী ডেভিড গ্রিনগ্লাসকেও সম্পৃক্ত করেন। ১৫ জুন ১৯৫০ ডেভিড গ্রেফতার হওয়ার পর দোষ স্বীকার করেন এবং বলেন, তাকে সোভিয়েত গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তার বোন ইথেল ও তার স্বামী জুলিয়াস। তাকে এ কাজে যোগ দিতে রাজি করাতে তারা ডেভিডের স্ত্রী রুথকে প্রথম সম্মত করান। তিনি বলেন জুলিয়াস আগে থেকে গোপনীয় তথ্য সোভিয়েতের কাছে পাচার করে আসছিলেন। তিনিই তাকে সোভিয়েত এজেন্ট আনাতলি ইয়াকোভলেভের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেন।

ডেভিড গ্রিনগ্লাসের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ১৭ জুলাই ১৯৫০ জুলিয়াস রোজেনবার্গ গ্রেফতার হন। ডেভিড ও তার স্ত্রী রুথ এবং জুলিয়াস ও ইথেলকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে কিছু কাগজপত্র ইথেল জুলিয়াসকে টাইপ করে দিয়েছেন। ১১ আগস্ট ১৯৫০ ইথেলকে গ্রেফতার করা হয়। ডেভিড গ্রিনগ্লাস আটক হওয়ার পর মর্টন সোবেল সপরিবারে মেক্সিকো সিটিতে পালিয়ে যান। বিনা পাসপোর্টে ইউরোপে পালানোর একটি পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ার পর মেক্সিকোর পুলিশই তাকে গ্রেফতার করে এবং আমেরিকান নাগরিক হিসেবে তাকে আমেরিকান পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কলেজ জীবনে জুলিয়াসের বন্ধু প্রকৌশলী মর্টনকেও তিনি রুশ গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেন।

এফবিআই তদন্তে নেমে বের করে জুলিয়াস ও ইথেলের সম্পর্কের সূচনা ১৯৩২ সালে, ইথেলের মা-বাবা তাকে পছন্দ করেননি, এমনকি জুলিয়াসের ইথেলদের বাড়িতে আসাও নিষেধ ছিল। জুলিয়াস যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছেন এ তথ্য জুলিয়াসের চাকরিদাতা মার্কিন সেনাবাহিনীর গভর্নরস আইল্যান্ডের সেকেন্ড সার্ভিস কমান্ডের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে চাকরিচ্যুত হন। ১৯৪০-এর মে মাসে নিউইয়র্ক এফবিআইর ফিল্ড অফিস জানতে পারে ইথেল ওয়াশিংটন সেনসাস ব্যুরোতে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু পাড় কমিউনিস্ট। তারা আরো জানতে পারে যে ইথেল ও অন্য এক নারী কমিউনিস্ট প্রচারণা অংশ হিসেবে কাগজ বিতরণ করছে। ১৩ আগস্ট ১৯৩৯ কমিউনিস্ট পার্টির মনোনয়নের জন্য তিনি আবেদনও করছেন। জুলিয়াস ১৪ বছর বয়সে ইয়ং কমিউনিস্ট লিগে যোগদান করেছিলেন। কলেজে তিনি ছিলেন ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের সেক্রেটারি।

ডেভিড গ্রিনগ্লাস তার বোন ইথেলের চেয়ে সাত বছরের ছোট। জুলিয়াস ও ইথেলের চিন্তাধারা নিয়ে শুরুতে অনাগ্রহী হলেও ধীরে ধীরে ডেভিডকে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ আকৃষ্ট করে। তিনি এফবিআইকে জানান, ১৯৩৬-৩৮ পর্যন্ত ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের সদস্য থাকলে কখনো মূল দল কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি। তিনি দাবি করেন মার্শাল টিটোকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করার পর তার মনে হয় যে কমিউনিজমকে সোভিয়েত সম্প্রসারণের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জুলিয়াসের ক্লাসমেট মর্টন সোবেল ও অভিবাসী, তার জন্ম রাশিয়াতেই, তিনি ওয়াশিংটন ডিসেতে ব্যুরো অব নেভাল অর্ডন্যার্স এর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মেক্সিকো পুলিশ তাকে হস্তান্তর করার পর তিনি চাকুরিচ্যুত হন। আলেক্সজান্ডার ফেকলিসব প্রাক্তন রুশ গোয়েন্দা এবং জুলিয়াসের সাবেক বস লিখেছেন, ১৯৪২-এর শ্রম দিবসে সাবেক স্পাইমাস্টার সিমন সেমিওনভ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কাজে তাকে নিয়োগ করেন। কিন্তু নািস জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের কারণে আমেরিকা ও ইউরোপ মিত্র হিসেবে এগিয়ে আগে এবং ফলে গোয়েন্দা কৌশল ও লক্ষ্যে কিছু পরিবর্তন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র কমিউনিস্ট পার্টির পদস্থ নেতা বার্নাড শুস্টার জুলিয়াস রোজেনবার্গকে সেমিওনভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সেমিওনভকে মস্কোতে ডেকে পাঠানো হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন আলেক্সজান্ডার ফেকলিসভ। তিনি লিখেছেন জুলিয়াস হাজার পাতা কাগজপত্র সরবরাহ করা ছাড়াও জোয়েল বার, আলফ্রেড সারান্ট, উইলিয়াম পার্ল ও প্রকৌশলী মর্টন সোবেলকে সোভিয়েত গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য নিয়োগ করেছেন। জুলিয়াসের নির্দেশে উইলিয়াম পার্ল ফিকলিসভকে লকহিড পি-৮০ সুটিং স্টারের সম্পূর্ণ ড্রইংসহ ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর অ্যারোনট্রিকসের হাজার হাজার পাতা সরবরাহ করেন। লকহিড পি-৮০ যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জেট ফাইটার। ফেকলিসভ জুলিয়াসের কাছেই জানতে পারেন যে ইথেলের ভাই ডেভিড গ্রিনগ্লাস ও যুক্তরাষ্ট্রের টপ-সিক্রেট প্রকল্প ম্যানহাটন প্রজেক্টে চাকরি করেন। তিনি ডেভিডকে সোভিয়েত গুপ্তচর নেটওয়ার্কে নিয়ে আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করার জন্য জুলিয়াসকে নির্দেশ দেন। স্ত্রী ইথেলকে ব্যবহার করে জুলিয়াস তার বসের নির্দেশ পালনে সফল হন এবং তাকে ১০০ ডলার বোনাস দেয়া হয়।

অন্যদিকে ৫০০ ডলার হাতে পেয়ে ডেভিড গ্রিনগ্লাসও দলে ভিড়ে যান। জুলিয়াস ম্যানহাটন প্রজেক্টের আরো একজন প্রকৌশলী রাসেল ম্যাকনাটকেও নিয়োগ দিতে সমর্থ হন। ম্যাকনাটের নিযুক্তি ইউরোপিয়ান ভিত্তিক অস্ত্র উৎপাদনের তথ্য সোভিয়েত পেতে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করলেও যুক্তরাষ্ট কখনো তার যুদ্ধ সামর্থ্য নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কিছু জানায়নি এবং ম্যানহাটন প্রজেক্টের জন্য কোনো ধরনের সোভিয়েত সহযোগিতাও চায়নি। কিন্তু ২৯ আগস্ট ১৯৪৯ সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন তার প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা সম্পন্ন করল যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পাশ্চাত্য বিস্মিত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রও দেখল তার একক সামর্থ্য খর্ব হয়ে গেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় সোভিয়েত গুপ্তচররাই কি তথ্য সরবরাহ করে এমন একটি ঘটনা ঘটিয়ে ছিল? সব তথ্য জড় করে অন্য কোনো দেশকে দিলে তারা কিছু করতে পারবে? পারবে না, তার কারণ তাদের কাঠামো, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সামর্থ্য নেই, বৈজ্ঞানিক মেধাও নেই। এদিক দিয়ে সামান্য ইঙ্গিতই সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। কেজিবি যেমন আমেরিকায় সক্রিয়, তেমনি সিআইএও সোভিয়েত ইউনিয়নে সক্রিয় ছিল। যদি আমেরিকা সত্যিই বিস্মিত হয়ে থাকে, এ অগ্রগতির ইঙ্গিতও না পেয়ে থাকে এটা অবশ্যই সিআইএর বড় ব্যর্থতা।

জুলিয়াস রোজেনবার্গের গুপ্তচর বৃত্তির অঢেল প্রমাণ উঠে এসেছে কিন্তু ইথেল রোজেনবার্গের অপরাধ কী? বিচার শুরুর আগেই সম্ভবত দুজনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় পদস্ত সরকারি আমলারা। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ ২০ জন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা গোপন বৈঠকে বসেন। পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান গর্ডন ডিন বলেন, বোঝা যাচ্ছে ওই গোয়েন্দা চক্রের কেন্দ্রে রয়েছে জুলিয়াস রোজেনবার্গ, তাকে মৃত্যুদণ্ডের কম কোনো সাজা দেয়ার সুযোগ নেই। অন্য সদস্য মাইলস লেইন বলেন যদিও ইথেল রোজেনবার্গের সম্পৃক্ততা শক্ত ও উল্লেখযোগ্য নয়, তবু তার ভয়ংকর শাস্তি হওয়া দরকার। ইথেলকে ফাঁসিয়েছে তারই আপন ছোট ভাই ডেভিড গ্রিনগ্লাস। ডেভিড ও তার স্ত্রী রুথ তাদের সাক্ষ্য একাধিকবার সংশোধন করেন এবং ইথেলের হাতেই কিছু গোপন দলিল ও বার্তা টাইপ করা, এটা প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

৬ মার্চ ১৯৫১ এক মেঘাচ্ছন্ন দিনে নিউইয়র্ক সিটির আদালতে যুক্তরাষ্ট্র বনাম জুলিয়াস রোজেনবার্গ, ইথেল রোজেনবার্গ ও মর্টন সোবেল মামলার বিচার শুরু হয়। সরকারের অ্যার্টিনি আরভিং সেয়পল আদালতকে বলেন, আসামিরা আমেরিকার জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। আমাদের ধ্বংস করার জন্য তারা সোভিয়েত ইউনিয়নে তথ্য ও গোপনীয় দলিল সরবরাহ করছে। তাদের ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার সুযোগ নেই।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রথম সাক্ষী ম্যাক্স এলিচার বলেন, ১৯৪৮ সালের এক মধ্যরাতে তিনি মর্টন সোবেলের দেয়া একটি ক্যান ভর্তি ফিল্ম জুলিয়াস রোজেনবার্গের কাছে সরবরাহ করেন। দ্বিতীয় সাক্ষী ডেভিড গ্রিনগ্লাস জুলিয়াসের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিলেন, তাকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা হলো তাও জানালেন, ইথেলের সম্পৃক্ততার কথা বললেন। রুথ বলেন, তার স্বামী ডেভিডের তৈরি করে দেয়া নোট ১৯৪৫-এর এক সন্ধ্যায় ইথেলই টাইপ করে দিয়েছেন।

২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য ব্রাদার: দি অ্যানটোল্ড স্টোরি অব অ্যাটমিক স্পাই ডেভিড গ্রিনগ্লাস অ্যান্ড হাউ হি সেন্ট হিস সিন্টার ইথেল রোজেনবার্গে টু দি ইলেকট্রিক চেয়ার’। ভাই ডেভিড গ্রিনগ্লাস কেমন করে তার বোন ইথেল রোজেনবার্গকে ইলেকট্রিক চেয়ারে পাঠাল—ডেভিড স্বীকার করেছেন (স্যাম রাবার্টসকে দেয়া সাক্ষাত্কার) নিজের স্ত্রী রুথকে বাঁচাতে বোনের বিরুদ্ধে বেশকিছু মিথ্যে সাক্ষ্য তাকে দিতে হয়েছে।

রোজেনবার্গদের মামলায় আরো কয়েক জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ গুপ্তচরবৃত্তির মামলায় আসামিও। আসামিপক্ষে কেবল একজনকেই সাফাই সাক্ষী করা হয়েছিল মর্টন সোবেল। তিনি সাক্ষ্য দিতে রাজি হননি।

এক মাস ধরে এ বিচারের খুঁটিনাটি পৃথিবীর সব সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে। বিচারক আরভিং কাউফস্যানসহ ২১ জন পুরুষ ও একজন নারী বিচারকের জুরি সোভিয়েত বোমায় কোরিয়ায় নিহত পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যুর দায়ও রোজেনবার্গ দম্পতির ওপর ফেলে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ প্রদান করে।

জুলিয়াস ও ইথেলের দুই ছেলে ‘ডোন্ট কিল মাই মাম অ্যান্ড ড্যাড’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামে। তাদের জীবন রক্ষা করার জন্য পৃথিবীজুড়ে আর এক আন্দোলন শুরু হয়। বিশেষ করে ইথেলের প্রশ্নে এমনকি কট্টর সোভিয়েত বিরোধীদেরও অনেকে মনে করেন তার ওপর ভীষণ অন্যায় করা হয়েছে। মার্ক্সবাদী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে বিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন:

এ বিচারে একটি জাতিকে খুন করা হয়েছে। যারা রায়ের প্রতিবাদ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কমিউনিস্ট বিরোধী ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। যেমন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, নাট্যকার জা কঁকতো, রসায়নে নোবেল বিজয়ী হ্যারল্ড বরেই। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের মধ্যে প্রতিবাদ করেছেন ফ্রিদা কাহলো, দিয়েগো রিভেরা, বার্টল্ট ব্রেখট, নেলসন এলগ্রেন। আইনস্টাইন ও হ্যারল্ড রোজেনবার্গদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রুমানকে লিখেছেন। পাবলো পিকাসো লিখলেন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধটি যেন সংঘটিত না হয়। পোপ জীবন রক্ষার অকাতর আবেদন জানালেন।

ইথেল ও জুলিয়াসের জীবন বাঁচাতে সাম্যবাদী ধনবাদী সব দেশেই প্রতিবাদ ও মিছিল হয়েছে। ১৯ জুন ১৯৫৩ রাত ৮টায় নিউইয়র্ক সিঙ্গ সিঙ্গ প্রিজন ৫৭ সেকেন্ডের প্রথম ইলেকট্রিক শকেই জুলিয়াস রোজেনবার্গের মৃত্যু হয়। কিন্তু ইথেলের মৃত্যু না হওয়ায় তাকে ইলেকট্রিক চেয়ারের স্ট্র্যাপ আবারো বাঁধা হয় এবং আরো দুটো শক দেয়া হলে এক সময় ইথেলের নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করে। আব্রাহাম লিঙ্কন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ম্যারি সুরাটের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ৮৮ বছর পর দ্বিতীয় নারী ইথেল রোজেনবার্গের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

জ্যাঁ পল সার্ত্র আমেরিকানদের বললেন, তোমরা অসুস্থ মানসিকতার জাতি। তোমরা নিজেদের বোমার ছায়া দেখেই আতঙ্কিত। সোভিয়েত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী বরিস ব্রকোভিচ বললেন, তারা অকারণে রোজেনবার্গদের ইলেকট্রিক চেয়ারে বসাল, তারা অ্যাটম বোমার কিছুই জানত না। বহু বছর কারাবাসের পর মুক্ত হয়ে মর্টন সোবেল ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্বীকার করেছেন তিনি বাস্তবিকই সোভিয়েত গুপ্তচর ছিলেন। জুলিয়াস রোজেনবার্গ তার আগে থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করে আসছিল। কিন্তু ইথেলকে মরতে হলো জুলিয়াস রোজেনবার্গের কারণেই। সোভিয়েত সরকার প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ একবার বলেছেন, জোসেফ স্ট্যালিন তাকে জানিয়েছেন রোজেনবার্গ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাঠিয়েছেন। তাদের সন্তানরা এখন বাবার ব্যাপারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে কিন্তু মাকে নিরপরাধ ঘোষণা করা হোক এ দাবি জানিয়েই যাচ্ছে।

ইথেল রোজেনবার্গকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, বেরিয়েছে গানের অ্যালবাম।

 

আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক


শর্টলিংকঃ