ইভ্যালির সাইক্লোন প্রতারণায় লণ্ডভণ্ড গ্রাহকরা


ইউএনভি ডেস্ক :

ইভ্যালির সাইক্লোন, লণ্ডভণ্ড, নবীন বরণ, ভ্যালেন্টাইন সাইক্লোন, ধামাকা অফার নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞাপন। আর বছরব্যাপী বিশেষ দিবসকে ঘিরে প্রতিষ্ঠানটির দেয়া এসব লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে সারাদেশ থেকে অনলাইনে পছন্দের পণ্য অর্ডার করে বিপাকে পড়েছেন অসংখ্য সাধারণ গ্রাহক

রকমারি আকর্ষণীয় ছাড় আর অফার দিয়ে এক বছরের মধ্যেই ইকমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে আলোচনার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে অনলাইন কেনাকাটার প্লাটফর্ম ইভ্যালি। অল্পদিনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উঠেছে গ্রাহক হয়রানি আর ভোগান্তির হাজারো অভিযোগ।

১৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার নিয়ম থাকলেও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, কেউ এক মাস, কেউ দুই মাস পরেও বুঝে পাচ্ছেন না নির্দিষ্ট পণ্য। এসএমএস, ইমেইল, হেল্প সেন্টারে কল করেও মিলছে না কোনো সমাধান। কেউ কেউ পণ্য অর্ডারের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও রয়েছেন শঙ্কায়।

পণ্য অর্ডার করে টাকা পরিশোধ করার পরেও সেটা নির্ধারিত সময়ে গ্রাহক না পাওয়া, প্রোসেসিংয়ের নামে দিনের পর দিন পণ্য আটকে রাখা, হেল্প লাইনে কল করে অভিযোগ করলে সেটা আমলে না নিয়ে তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া, সাধারণ গ্রাহকদের এমন নানান ধরনের হয়রানি আর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে এ ধরনের অসংখ্য গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন।

প্রতিষ্ঠানটির হেল্প সেন্টারে কল করেও কোনো সমাধান না পেয়ে অনেকেই কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সামিউল বাসির বিন হোসাইন নামের এক গ্রাহক সম্প্রতি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,ইভ্যালির অফারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী কেউ আছেন ফ্রেন্ডলিস্টে? ওই পোস্টের এক কমেন্টের জবাবে তিনি লিখেন, আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নাই সিইও। যাইহোক, অফারগুলোখুব বাজেভাবে শুরু করছে ইভ্যালি। অর্ডার দিলে ৪ মাসেও প্রোডাক্ট পাওয়া যায় না।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ফেসবুকে ইভ্যালির কয়েকটি গ্রুপ ও পেজ রয়েছে। এগুলো হলো- ইভ্যালি.কম.বিডি, ইভ্যালি অফার অ্যান্ড হেল্প সেন্টার, ইভ্যালির অফার এর বিস্তারিত, ইভ্যালি অফার অ্যান্ড রিভিউ ইত্যাদি। গ্রুপগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রাহকদের ভাল রিভিউগুলো রয়েছে। ভুক্তভোগী কোনো গ্রাহক এখানে নেগেটিভ রিভিউ লিখলে সেগুলো রিভিউ গ্রুপে এপ্রুভ করা হয় না। অসহায় গ্রাহক তখন ভরসার জায়গা হিসেবে মনের সব ক্ষোভ আর অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে। এছাড়াওইভ্যালির ফেসবুকে দেয়া সব অফারের পোস্টেও একইভাবে করছেন অভিযোগ।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার  জন্মদিন। এ উপলক্ষে তিনি নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেন কিছু ছবি। ওই পোস্টের কমেন্টে শুভেচ্ছা জানানোর পরিবর্তে গ্রাহকরা তুলে ধরেন নানান হয়রানি আর ভোগান্তির কথা।

ইভ্যালি থেকে দ্ইুটালেনোভো মোবাইল অর্ডার কফার্ম করে হতাশায় দিন গুণছেন আমিনুল ইসলাম নামের ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে পড়ুয়া এক ছাত্র। তিনি মনের অবস্থার কথা জানিয়ে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উদ্দেশে লিখেছেন, ইভ্যালিতে লেনোভোর ২টা মোবাইল অর্ডার করে ২৬ দিন ধরে প্রসেসিংয়ে আছে। এখনো কোনো খবর নাই।

গাজীপুর থেকে হাসনাত সাদী আল সিফাত নামে এক স্টুডেন্ট ইভ্যালি থেকে একটা পাওয়ার ব্যাংক অর্ডার করে টাকা পরিশোধ করেছেন। অর্ডার ইনভয়েস নম্বর ঊঠখ ৩৪৭০১৭৮৬৯। তিনি বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাওয়ার ব্যাংকটা অর্ডার করে পড়েছেনবিপাকে। গত ২৭ জানুয়ারি অর্ডার কনফার্ম করা পাওয়ার ব্যাংকটি হাতে না পেয়ে তিনি এখন টেনশনে আছেন।

ইভ্যালিতে দেয়া অফারের পণ্য অর্ডার করে এক মাসেও হাতে না পেয়ে ভুক্তভোগী মো. জয়নাল আবেদীন লিখেছেন, ভাইয়া দয়া করে আর নতুন অফার দিয়েন না। টাকা তো সব আপনার কোম্পানির কাছে চলে গেছে। এখন যতো দ্রুত সম্ভব ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থাকরেন। আমার অর্ডার ইনভয়েস নম্বর- ঊঠখ#১০১৫০৯৭৭৪। অর্ডার টা ১মাসের উপরে হয়ে গেছে। এখনো ডেলিভারি পেলাম না।

শাওন আহমেদ নামে আরেক ভুক্তভোগী গ্রাহক লিখেছেন, গত ১৭ জানুয়ারি ইভ্যালিতে একটা পলিট্রন টিভি অর্ডার করে পুরো টাকা পরিশোধ করেছি। অর্ডার ইনভয়েস নম্বর-ঊঠখ৬৫৩৩১৩১১৬। ৪১ দিন চলছে কিন্তু এখনো আমার টিভি বুঝে পাইনি। এমনকি টাকাও ফেরত পাইনি।

৪৫ হাজার টাকার একটি শখের ডিএসএলআর ক্যামেরা অর্ডার করে চরম বিপাকে আছেন ফ্রিল্যান্সার মো. জীবন। রাত জেগে কষ্ট করে আয় করা টাকায় অর্ডারের ক্যামেরাটা ১৫ দিন ধরে প্রোসেসিংয়ে আছে। এখানো কেউ বিষয়টা দেখছেন না।

পছন্দের প্রোডাক্ট অর্ডার করে তা দেড় মাস পর বাতিলহওয়াতে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে আব্দুর রহমান মানিক লিখেছেন, পণ্য অর্ডারের ৪৫ দিন পরে বাতিলকরা হলো এটা কোন ধরনের ফাইজলামি?

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক শাহনাজ সুলতানা (তদন্ত) বিবার্তাকে বলেন, ওই কোম্পানীর বিরুদ্ধে লিখিত অনেক অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। তবে অভিযোগের পরিমাণ এখনো বলা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ওই কোম্পানীর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছি।

এই বিষয়ে ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল ইস্যু স্ট্যান্ডিং কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট খন্দকার হাসান শাহরিয়ার বিবার্তাকে বলেন, ই-ক্যাবের সদস্য কিংবা সদস্য নয় এমন যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে উপযুক্ত প্রমাণসহ কেউ অভিযোগ করলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে সমস্যাটি সমাধানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবো।

ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন লোভনীয় ছাড় আর ক্যাশব্যাক অফারের নামে যা করছে তা মূলত জনগণের টাকায় গ্রাহক ভোগান্তি আর হয়রানির ব্যবসা। যে কোনো বিশেষ দিবসে ৬০% ৮০% ৯০% এমনকি ১০০% ক্যাশব্যাক অফার দিচ্ছে। আর এ ফাঁদে পা দিচ্ছে দেশের সহজ-সরল অসংখ্য সাধারণ গ্রাহক।

সূত্র : বিবার্তা


শর্টলিংকঃ