ইমরাজ হাসানের গল্প ‘সাতরং’


রায়দিঘির পুবপাড়ে কদম গাছটার নিচে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। ঝোপঝাড় ও লতাপাতা বিছানো উদোম বুকে নির্জনতার আদরে অবুঝ থৈথৈ। থেকে থেকে ঝিঁঝিঁপোকার দল, টানা সুরে নিয়ে নিচ্ছে সারা রাত্তির একনাগাড় কোরাসের প্রস্তুতি ।

দিঘির পাড় ঘেঁষা পচা কালো কাঠকলমির জঙ্গল থেকে ডাহুকের কচি বাচ্ছা কোঁ কোঁ শব্দে আরও গভীর জঙ্গলে ঢোকবার চেষ্টা করতে কাদাপানিতে গিয়ে পড়ল। একপশলা বৃষ্টি হবার পরে,এখানটায় মাটির বৃষ্টি শুষে নেবার শব্দ, ঘাসেদের শরীর ভেজানোর গন্ধ, সারি সারি বাবলা, কদম, শিশুগাছের ঘামের গন্ধ বাতাসে পাওয়া যায়।

একজোড়া অচেনা সাতরঙা পাখি প্রতিদিন বৃষ্টির পরে কদম গাছের মড়া, ফোঁকরে ফাঁপা ডালটাতে বসে। আজও তাঁরা অসময়ে ডানা ঝাপটিয়ে বসল। ওই দ্যাখ, কি বলে ছ্যালাম! এই আবছা কালো নির্জনতায় নিজের গলার কথা শুনেই হাসান চমকে উঠল। ঘাড় চুলকতে চুলকতে বিচ্ছিরি কালো দাঁত বের করে মানিক।

তাই তো বে, এ যে শালা রঙের ভাণ্ডার। ও দুটো কি পাকি বে?

কি জানি!- উত্তর দিলো হাসান। তবে পাকি দুটো একটা মদা আরেকটা মেদি।

কি করে বুজলি? ঠ্যাঙ তুলে দেখেছিলি নাকি ? বলেই কাদা লাগা কোদাল দাঁতের লিকলিকে ভূতের মত গা দুলতে থাকে।

তু তো কুনুদিন ইস্কুলের পাঁদাড় মারালি না , তু তো বোকা পাঁঠার মতই চেঁচাবি। মানুষের সমাজে তু এরকমই হয়। ছেলে আর মেয়ে এরা দুজুনে ঘর বাঁদে। বছর বছর বাচ্চা পয়দা করে। পাকিপশুদের বেলাতেও একই। এ ধরাবাঁধা লিয়ম। এর লড়চড় হবার জো নাই!

ভীষণ মাস্টারি ঢঙে কথা গুলো বলে হাসান। কথা শুনতে শুনতে মানিক তাকে জড়িয়ে ধরে।

তুর চাগরি হবেই!, তু শালোর যাকে বলে মাস্টার হবি। যা মনে আসবে তাই বলবি হাবোল মাস্টারের মত। আর পড়া না পারলে ইস্কুলের হারামি ছাত্তর গুলোকে এন্তার ক্যালাবি।

ফালতু বকিস না তো, চাগরি পাওয়া মুকের কথা লয়। তার লেগে মগজে একঝুড়ি বুদ্দি, বাপের গুচ্ছেন টাকা ঘুষ দিতে হবে। আমার চাগরি হবে! থু শালো!! রাগে কাঁপতে থাকে হাসান।

মানিক আর কিছু বলতে পারেনা। হতভম্বের মত ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বেশিক্ষন একযাগয়ায় দাঁড়িয়ে থাকলে ওর পা থরথর করে কাঁপে। তাকে দেখতে তখন বোকা পাঁঠার মতই লাগে।

পাঠক বাড়িতে কালী পূজোর অমাবস্যার মাঝ রাতে জোড়া পাঁঠাকে গা ধুইয়ে, গলায় জবা ফুলের মালা দিয়ে, একবাটি টকটকে সিঁদুর মাথায় ঢেলে হাড়িকাটের কাছে নিয়ে গেলে; পাঁঠা দুটো ব্যা ব্যা চেঁচায় আর ঠকঠক করে কাঁপে।

তারপর কালো মোষের মত চেহারার কামারদের হারুকাকা বিশাল খাঁড়া দিয়ে তাদের মুণ্ডুটা এককোপে মাটিতে ফেলে দিলে তবে শান্তি!

পিছনের বাঁশ বনে হাওয়া ওঠে। মড়মড় শব্দ ওঠে , পচা মরা পাতা ঝরে পরে। আঁধার যেন আরেকটু বেশি ঘনিয়ে আসে এখানে। দিঘির ঠাণ্ডা বরফ পানিতে বোয়াল মাছেরা ঘাই মারতে মারতে দিঘির এপার-ওপার করে। পশ্চিম আকাশে নন্দীদের খামারের ওপাশে রামধনু ফোটে। দুজনে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।

দিঘির পশ্চিম পাড়ে মোজাই চাচা তিনদিনের বিয়ুনি জার্সি গাই ও হুবুহু মায়ের মত দেখতে বাছুরটাকে নিয়ে রামধনুর তলায় গিয়ে দাঁড়ায়।গাইটার দুচোখ ছলছল করে এবার হাসান কথা বলে প্রথম; পাখি দুটো কোথা থেকে এল বলদিগিনি মানকে?এরকম পাকি অ্যার আগে দ্যাখেছিস আমাদের গাঁয়ে?

পকেটে বিড়ির পিছনটুকু খুঁজতে খুঁজতে মানিক আবার পাখি দুটোর দিকে তাকায়। পাখি দুটো ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে। প্রেম, সেই আদিমের প্রেম। নিখাদ শরীরের প্রেম, অপটু মনের প্রেম। যে প্রেম থেকে তৈরি হয় জগৎ। সৃষ্টির সেই আদি ইতিহাস এখনো বইয়ে নিয়ে চলেছে সেই প্রেম।

আরে শালা, এরা যে পিরিতে টগমগ! পিরিত দ্যাকলে গা জোলে যায়! এ দুটো লিশ্চয় সাঁইতাল পাড়া হনে এইচে। দুটকে ধরতে পারলে! বলেই বিড়ির পিছনটুকু দেশলাই দিয়ে ধরায়।

ধুর! আমার কি মনে হয় জানিস, ওরা মেগ থেকে এয়েচে। এদেরকে আল্লা নিজের হাতে করে পলি মাটি দিয়ে বানিয়েচে। পেথমে এরা সাদা রঙের ছ্যেল। তারপর রামধেনু তে চুবিয়ে আল্লা ওদের ছেড়ে দিয়েচে; চরে খেতে। আমাদের কেও অ্যাকদিন আল্লা এরম করে কাদামাটি দিয়ে তৈয়ার করে ছ্যেল।

ত্যেকন পিতিবিটা ইস্কুলের পিচনের মত শুদু গাচের জঙ্গল ,আর সাপখোপ জন্তু জানোয়ার ছ্যালো। তেরপরে মানুষ হলো। মা হওয়া আর বাবা আদম। হাদিসে ইসব ই লিকা আচে, আস্তানায় মলবি সাহেব ইসব বলছ্যালো শুকুর চাচাকে আজকে।

আবার তু মাস্টারি শুরু করলি? এদিকে শালা হারামির কাঠপিঁপড়েতে পা জলিন দিচে। উঃ পা ফুলিয়ে দিয়েচে, যত গড়ল ছিল শালারা সব উবুড় করে দিয়েচে । জ্বলুনি আর চুলকুনি এক সাথে লাগচে। চ পালাই একান থেকে মগরবের আজান হয়ে গেল বে। একানটায় দোষাদোষ আচে জানিস নাকো?

চুপ কর দিকিনি, তোর পাঁঠার মত চেঁচানির চোটে দ্যাক পাকি দুটো পালিন যেচে!

বেশ হয়েচে, চ দিগিনি বাড়ি যাই। আমার গা টা কেমন করচে। তিনি সন্দে বেলা, দোষাদোষের যাগয়াই দাঁড়িয়ে আর বকতে হবে না।  তু একেবারে মেদির ধারী, ভয়ে মরচে! দাঁড়া পাকিদুটো আবার বসেচে।

অন্ধকার এবার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। পশ্চিম আকাশে রামধনুর একটু মাত্র রঙ লেগে আছে। দিঘি পাড়ের সারি সারি গাছে বর্ষার ভারি অন্ধকারে নিজেদের গোটাতে গোটাতে শেষ অস্তিত্বটুকু জানান দিয়ে যাচ্ছে। গভীর অন্ধকারে গাঁয়ের খড়ের,টিনের চালে গুমরে গুমরে কান্না শেষে পানির দাগ লেগে। পায়ের তলায় ভিজে মাটি-ঘাস-আগাছার তলায় ষড়যন্ত্রের নিঝুম আঁধার।

পিছনের বামুন বাড়ি থেকে শাঁখের দীর্ঘ শব্দ নিরবতাকে খানখান করে দিয়ে শেয়ালের গর্তে গিয়ে ঢোকে। সঙ্গে সঙ্গে শেয়াল ডেকে ওঠে জোলের মাঠ থেকে। চারদিকের শব্দ কেমন যেন চাপা চাপা। হু হু করে আরেকটা ঠাণ্ডা বাতাস গোটা দিঘি ঘুরপাক করে ওদের শিরদাঁড়ায় ঢোকে। এতক্ষণে ওরা নিজেদের দিকে তাকায় ।

কারো ই মুখ চেনা যায়না। মানিকের পা আরও জোড়ে কাঁপতে থাকে। ওরা আর কেউ পাখি দ্যাখে না। একে অপরের দিকে তীক্ষ্ম ভাবে তাকায়। নিজের বুকে হাত দিয়ে রাখে। অন্যকে ছোঁবার সাহস হয়না। মানিককে টিংটিঙে বাঁশ গাছের মত মনে হয়; মাথায় হাঁড়ী চাপানো। ওদের চোখ জ্বলজ্বল করে।

হাচান চ বাড়ি যাই শুকনো গলায় বলে ওঠে মানিক। কিন্তু তাদের এক পা নড়বার ক্ষমতা নেই। নিশ্চল অন্ধকার ভীষণ মূর্তির মত বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ওপারে রফিকদের বাড়িয়ে আলো জ্বলে ওঠে। ধান ভাপানোর কটু গন্ধ ভাসে বাতাসে। ওদের কুকুর সমানে করুণ সুরে কেঁদে ওঠে। সরসর শব্দ করে একটা হলুদ খরিস গোখরো বাঁশবনের দিকে এগোয়। মানিকের দেশলায়ের আলোয় তার গায়ে সাতরংয়ের বিষ ফুটে ওঠে।

ওরা দুজনে চিৎকার করে ছুট লাগায়। শ্রীধরের ভাঙা গোয়াল ঘরের পিছন দিকের সরু গলি দিয়ে রায়েদের মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোদাল কাটা আকাশে সরু চাঁদ হাসছে। ম্যাড়ম্যাড়ে তারা একে-ওপরকে জড়িয়ে ধরছে। ওরা ছত্তারের বোন কুলসুমাকে শ্রীধরের গলিতে ঢুকতে দেখে।

দক্ষিন পাড়ের ইস্কুলের বন থেকে বেড়ালের মত সেদিকে যায় নিজামের মেজ ব্যাটা সামাদ। তারা কদম গাছটার নিজে যায়। পাখিদুটো উড়ে যাচ্ছে রং ঝাপটিয়ে ফেলে। সাতরং এসে পড়েছে কুলসুমা আর সামাদের খালি গায়ে।

লেখক পরিচিতি: ইমরাজ হাসান জন্ম- ২৯ এপ্রিল, ১৯৯৬ যবগ্রাম, বর্ধমান

বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে পাঠ্যরত।

ইমেল- hasanimraj@gmail.com


শর্টলিংকঃ