উগান্ডার ইদি আমিন : সহকারী পাচক থেকে প্রেসিডেন্ট


জুলাই ১৯৭৫। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় কূটনীতিবিদদের পার্টি। এ ধরনের পার্টিতে রাষ্ট্রপ্রধানদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণত যান না, তবে শুভেচ্ছা পাঠান। কিন্তু ইদি আমিন যাবেন। যাওয়াটাকে স্মরণীয় করতে তিনি বাস্তবের এক ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ মঞ্চস্থ করলেন। হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন বা ‘সাদা মানুষের বোঝা’ রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত কবিতার নাম।

সাদা মানুষের দায় হচ্ছে অশ্বেতাঙ্গদের মানুষ করা। আভিধানিক অর্থে ঔপনিবেশিক শাসকের দায়িত্ব হচ্ছে অশ্বেতাঙ্গদের শাসন করা ও সভ্যতার দিকে নিয়ে আসা। এটা অবশ্যই একটা বড় বোঝা।

প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন সাদা মানুষের বোঝাটাকে বাস্তব রূপ দিতে চেয়ারসহ চারজন শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীর কাঁধে চড়ে পার্টিতে গেলেন। সাদা মানুষের ঘাড়ে বিশালদেহী কালো মানুষ এই ছবি অশ্বেতাঙ্গদের দেশে যখন ছাপা হলো কালো মানুষ বলল, বাঘের বাচ্চা ইদি। এতদিনে বর্ণবাদের জ্বালা কিছুটা মিটল। শ্বেতাঙ্গ দেশে এ ছবি দেখে কেউ কেউ বললেন, বেঁচে থাকতে এটা দেখতে হলো।

কেবল মজা করার জন্য ইদি আমিন এ কাজটা করেছেন, মনে করার কারণ নেই। এটি তার পরিকল্পিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তিনি পৃথিবীকে দেখাবেন এটাই সাদা মানুষের প্রাপ্য, বিশেষ করে ব্রিটিশদের।

১৯৭৫-এর সেপ্টেম্বরের একদিন। চৌদ্দজন সাদা মানুষ ইদি আমিনের সামনে হাঁটু গেড়ে প্রতিজ্ঞা করছেন উগান্ডার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে তারা সশস্ত্র লড়াই করতে প্রস্তুত। সে ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। এ ছবি অশ্বেতাঙ্গদের মনস্তাত্ত্বিক আনন্দ দিয়েছে। সাদা মানুষরা অসম্মানের প্রতিশোধ নেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ওয়েন তার স্মৃতিচিত্রে উল্লেখ করেছেন, তিনি ইদিকে হত্যা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

১৯৭৭ সালে ব্রিটেন উগান্ডার সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যখন তাদের ডিপ্লোম্যাটদের প্রত্যাহার করে নিল, ইদি আমিন ঘোষণা করলেন যে তিনি ব্রিটিশদের পরাজিত করছেন এবং তার নামের সঙ্গে যোগ করলেন CBE অর্থাৎ Conquerer of the British Empire ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিজয়ী।

শেষ পর্যন্ত খেতাবসহ তার নাম দাঁড়াল: HIS EXCELENCY, PRESIDENT FOR LIFE, FIELD MARSHAL AL HADGI DOCTOR IDI AMIN DADA, VC, DSO, MC, CBE, LORD OF ALL THE BEASTS OF THE EARTH AND FISHES OF THE SEAS AND CONQUERER OF THE BRITISH EMPIRE IN AFRICA IN GENERA AND UGANDA IN PARTUCULAR।

তিনি নিজেকে স্কটল্যান্ডের মুকুটহীন সম্রাট মনে করতেন। তিনি কখনো DSO (ডিস্টিংগুইশভ সার্ভিস অর্ডার), MC (মিলিটারি ক্রস) লাভ করেননি। VC (ভিক্টোরিয়াস ক্রস)ও তার নিজের আরোপিত। ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পিএইচডি তিনি নিজেই নিজেকে প্রদান করেন।

অনেক আফ্রিকান নেতা যেমন তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়াবেরে, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা এবং ইদি আমিনের জন্ম তারিখ জানার সুযোগ নেই। অশিক্ষিত দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে জন্মদিন কখনো আলোচনার বিষয় ছিল না। ইদি আমিনের জন্ম ১৯২৫ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে কোনো এক সময়, তার জন্মের পরপরই কৃষিজীবী বাবা পরিবার ত্যাগ করে, মা শ্রমিক হিসেবে নিজের ও পুত্রের জীবন ধারণের সব আয়োজন করেন। এক সময় তিনি এশীয় মালিকানাধীন আখের ক্ষেতে আখ কাটার কাজ করতেন।

ইদির ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতা তাকে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আফ্রিকান রাইফেলসের সহকারী পাচক হিসেবে চাকরির সুযোগ করে দিল। তার দেহটি ব্রিটিশ কমান্ডারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাকে চুলা থেকে তুলে রণাঙ্গনে পাঠিয়ে দিলেন।

১৯৫০-এর দশকটি তার কাটল কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়েছে। একের পর এক নন-কমিশন্ড র্যাংক পেরিয়ে ১৯৫৭ সালে সার্জেন্ট মেজর হলেন এবং দুবছর পর হলেন ‘এফেন্দি’-নেতৃত্বগুণ সম্পর্ক নেটিভদের সর্বোচ্চ পদ। ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন উগান্ডাকে স্বাধীনতা দেয় তিনিই সে দেশের সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ দেশীয় পদে আসীন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী মিল্টন ওবোতে তাকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর বানালেন। ব্রিটেন ও ইসরায়েলে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে প্যারাট্রুপার উইংস পেলেন। ১৯৬৪ সালে কর্নেল হয়ে সেনা ও বিমান বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার হলেন।

মিল্টন ওবোতের সঙ্গে যোগসাজশে স্বর্ণ ও আইভরিতে সাড়ে তিন লাখ ডলার আত্মসাতের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন। কথা ছিল বিনিময়ে কঙ্গোয় গেরিলাদের অস্ত্র সরবরাহ করবেন। কিন্তু তা করেননি। এ অভিযোগ আনায় ইদি আমিনের বাহিনী পাঁচজন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করে এবং মিল্টন ওবোতে সংবিধান স্থগিত করেন।

ইদি আমিন সেনা ও পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। দুই মাস পর উগান্ডা রাষ্ট্র গঠনের একটি মৌলিক নীতি অস্বীকার করে বুগান্ডার রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড মুতেসার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করলেন এবং ইদি আমিন তার ট্যাংক বাহিনী পাঠিয়ে রাজপ্রাসাদ গুঁড়িয়ে দিলেন। রাজা মুতেসা পালিয়ে গেলেন এবং প্রাণে বাঁচলেন। ওবোতে নিজেকে সর্বক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। ১৯৬৭ সালে ইদি আমিন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, ১৯৬৮ সালে মেজর জেনারেল হলেন।

মিল্টন ওবোতের প্রশাসন থেকে বাগান্ডা গোত্রের ক্ষমতাশালীদের অপসারণ করে অ্যাকলি ও ল্যাঙ্গি গোত্রের থেকে বাগান্ডা গোত্রের অনুগত লোকদের স্থলাভিষিক্ত করার প্রক্রিয়া ইদি আমিন বাস্তবায়ন করলেন। মিল্টন সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ও সোভিয়েত ব্লকের রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকলেন। তার সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় জাতীয়করণ ঘটতে পারে, এ আশঙ্কায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে তাকে সমর্থন করা নিয়ে টানাপড়েন শুরু হলো।

কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের বৈঠকে থাকার আগে মিল্টন সেনাপতি জেনারেল ইদি আমিনকে নিয়ে সন্দিহান হয়ে তার হাত থেকে বিমান বাহিনীর দায়িত্ব সরিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীর তহবিল তসরুপের মতো একটি ঘটনাও বেশ আলোচিত হচ্ছিল এবং প্রেসিডেন্ট এজন্য ইদি আমিনের ওপর খড়গহস্ত হতে পারেন বলে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল।

সিঙ্গাপুরে সরকারপ্রধানদের বৈঠকে যাওয়ার পরপরই ২৫ জানুয়ারি ১৯৭১ ইদি আমিন অভ্যুত্থান ঘটালেন, রাজধানী কাম্পালা ও এন্টেবিতে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানগুলোতে তার প্রতি অনুগত সেনা ও অন্যন্য সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করলেন।

অভ্যুত্থানকারীরা ওবোতের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে এন্টেবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়। ওবোতের অনুগত কিছু সৈন্য কয়েকটি জায়গায় প্রতিরোধ গড়তে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তাদের কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, তারা সংগঠিতও হতে পারেনি। বরং প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়।

বিকাল সাড়ে ৪টায় ঘোষণা দেয়া হলো পুরো দেশ ইদি আমিনের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। ওবোতে সরকারকে দুর্নীতির জন্য উত্খাত করা হয়েছে বলে জানানো হয়। তার অনুগত সৈন্যদের প্রায় ৫০০০ জনকে ১৯৭২ সালের মধ্যে হত্যা করা হয়।

২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ইদি নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। তিনি একই সঙ্গে কমান্ডার ইন চিফ, সেনাপ্রধান ও বিমান বাহিনী প্রধান। কাম্পালায় প্রেসিডেন্টের বাসভবন গভর্নমেন্ট হাউজ হিসেবে পরিচিত ছিল, নাম বদলে এ ভবনকে করলেন দ্য কমান্ড পোস্ট। অনেক আদর্শ বদল করলেন।

তার যেকোনো ইচ্ছা আইন হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করল। ১৯৭২ সালে ৭০ হাজার এশীয় ব্যবসায়ীকে (অধিকাংশ ভারতীয়) উগান্ডা থেকে বহিষ্কার করলেন। এটা ছিল তার ভাষায় উগান্ডার অর্থনৈতিক যুদ্ধ।

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের হিসেবে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে তার আট বছরের শাসনামলে ইদি আমিন কমপক্ষে ৮০ হাজার উগান্ডাবাসীকে হত্যা করেছেন আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে এ সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি। নিহতদের তালিকায় রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রধান বিচারপতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অ্যাংলিকান আর্চবিশপ প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর, তার নিজের মন্ত্রিপরিষদের দুজন মন্ত্রী এরিনাইরো উইলসন এবং চার্লস ফোম্বি এবং বিখ্যাত একজন নাট্যকার বায়রন কাওয়াদো।

বিড়ালের বাচ্চার মতো আমুদে এবং সিংহের মতো হিংস্র ইদি আমিন কখন কী করতে যাচ্ছেন আগাম বলা সম্ভব ছিল না। অ্যাংলিকান বিশপকে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট কার্টারকে এক হাজার শব্দের টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাতে লিখেছেন, এ অপারেশনে উগান্ডায় অবস্থানকারী আমেরিকানরা খুব খুশি হয়েছে। ইদি আমিন ব্রিটেনের রানী, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এবং আরো অনেককে উপদেশমূলক বার্তা পাঠাতেন।

কেমব্রিজে পড়াশোনা করা বুগান্ডা রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড ক্ষমতাসীন অবস্থায় লন্ডনে মৃত্যুবরণ করলে সবাইকে অবাক করে তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার মরদেহ দেশে আনেন এবং আড়ম্বরপূর্ণ শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে বুগান্ডা জনগণের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। তিনি প্রতিনিয়ত খরচ সৃষ্টি করতেন। তার আচরণ পৃথিবীজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল।

মিল্টন ওবোতে প্রতিবেশী দেশ তানজানিয়ায় আশ্রয় নেন, সেখান থেকে তার অনুগতদের সংগঠিত করতে চেষ্ট চালিয়ে যান। ইদি আমিন তানজানিয়া আক্রমণ করে দেশটি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার ঘোষণা দেন।

১৯৭৭ সালে দুজন মন্ত্রীর হত্যাকাণ্ড ইদি আমিনের নির্দেশেই হয়েছে বলে সবাই মনে করেন। তার মন্ত্রীদের আরো কজন দেশ ছেড়ে পালালেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুস্তাফা আদরিসির অনুগত সৈনিকরা ইদি আমিন সমর্থকদের অপছন্দ করতে শুরু করে। ১৯৭৮-এ জেনারেল মুস্তাফাকে হত্যার একটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়। উগান্ডার ইদি আমিন ভক্ত সৈন্যদের প্ররোচনায় তানজানিয়া উগান্ডা আক্রমণ করে।

ইদি আমিনের ভক্ত ও স্বজনরা তার কাছ থেকে সরতে থাকেন। প্রবাসী উগান্ডান লিবারেশন আর্মি তানজানিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে রাজধানী কাম্পালা ঘিরে ফেলে। লিবিয়ান প্রেসিডেন্ট কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ইদি আমিন সরকারের সমর্থনে সৈন্যবাহিনীকে সহায়তা প্রদান করলেও তিনি ১১ এপ্রিল ১৯৭৯ হেলিকপ্টারে স্বদেশ থেকে পালিয়ে লিবিয়া চলে যান। ১৯৮০ পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করার পর সৌদি আরব চলে আসেন।

রাজনীতিতে আর নিজেকে জড়াবেন না, এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজপরিবারের অনুগ্রহে প্রায় ২৩ বছর সেখানে বসবাস করেন। ১৬ আগস্ট ২০০৩ কিং ফয়সাল স্পেশালিস্ট হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন এবং সৌদি বিধান অনুয়ায়ী অত্যন্ত সাদাসিধে কবরে সমাহিত হন।

তিনি কি কেবলই দানব

পশ্চিমের গণমাধ্যম ইদি আমিনকে নিয়ে যত অপপ্রচার করুক না কেন, হেনরি ইরাস্তাস মনে করেন যেকোনো শাসকের তুলনায় উগান্ডার জন্য তার অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি তার সুকৃতির যে তালিকা করেছেন সেখান থেকে কয়েকটি সংক্ষেপে তুলে ধরছি—

১. ইদি আমিন উগান্ডার স্পোর্টস ইমেজ পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছেন। খেলার ভৌত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছেন। ১৯৭২ সালে জন আকিগুয়াকে মিউনিখ অলিম্পিকে পাঠিয়ে দেশের জন্য দলগত স্বর্ণপদকটি এনেছেন। আফ্রিকা কাপে উগান্ডা ফাইনালে পৌঁছে। তার পতনের পর ক্রীড়াঙ্গনও তলিয়ে যায়।

২. ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত তিনি উগান্ডার মুদ্রার বিনিময় হারের পতন ঘটতে দেননি।

৩. তিনিই বিদেশে উগান্ডার জন্য সবচেয়ে বেশি সম্পদ ক্রয়, স্থাপনা নির্মাণ করেছেন—নিউইয়র্কে উগান্ডা হাউজ, ব্রিটেনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে উগান্ডা হাউজ, জেনেভা, ব্রাসেলস, নাইরোবি ও মোগাদিসুতে শহরের কেন্দ্রস্থলে দূতাবাস ভবন, মোম্বাসাতে কফি বাণিজ্য ও গুদামজাত করার জন্য ভবন তারই উদ্যোগে কেনা।

৪. উগান্ডা এয়ারলাইনস করপোরেশন, দেশের প্রথম ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার তারই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। সে সময় অভ্যন্তরীণ রুট ছাড়াও দেশের পতাকাবাহী উড়োজাহাজ নাইরোবি, রোম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, দুবাই, বোম্বে এবং আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছত। ইদি আমিনের পতনের পর বিমান পরিবহনে ধস নামে।

৫. ইদি আমিনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৬৫টি উড়োজাহাজের একটি সমৃদ্ধ এয়ারফোর্স গড়ে ওঠে। বলা আবশ্যক তিনি একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

৬. উগান্ডা রেলওয়ের ব্যাপক সম্প্রসারণ তার হাতেই ঘটে। উগান্ডার আবাসিক বিল্ডিং ব্লকগুলো তার নির্দেশেই তৈরি হয়েছে।

৭. ৪ আগস্ট ১৯৭২-এর এশীয় তাড়াও ঘোষণা হয়—ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ত্যাগ করে উগান্ডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করো অথবা দেশ ছাড়ো। ব্রিটিশ কলোনি হওয়ার কারণে এশীয়রা ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেয়ে যায়। সাময়িকভাবে অর্থনীতি অস্থিতিশীল করলেও শেষ পর্যন্ত তা কালো মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। অন্য কোনো শাসকের পক্ষে এশীয়দের শোষণ বন্ধ করা সম্ভব ছিল না। ৯০ দিনের মধ্যে ৭০ হাজার এশীয়, অধিকাংশই ভারতীয়, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

৮. উগান্ডা ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি দেশে শিল্পায়নের ভিত্তি সৃষ্টি করেন।

৯. ১৯৬২ সালে স্বাধীন হলেও বাস্তবে ১৯৭০-এর দশকে বিশ্ব মানচিত্রে উগান্ডার উপস্থিতি তার কারণেই সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

১০. তিনি উগান্ডার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সমন্বিত করেন। তার মতো স্বল্প শিক্ষিত এমন মানুষের উদ্যোগের কারণেই উগান্ডা পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের সামর্থ্য অর্জন করেছে। ইদি আমিন যা করে গেছেন পরবর্তী শাসকরা তা ধরে রাখতে পারেননি।

ইদি আমিনকে বুঝতে তার কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করা সমীচীন হবে:

১. (উগান্ডায়) কথা বলার স্বাধীনতা আছে কিন্তু কথা বলার পরের স্বাধীনতার গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না।

২. আমি কোনো সুপারপাওয়ারের নিয়ন্ত্রণাধীন যেতে চাই না। আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি মনে করি আর সে কারণেই কোনো সুপারপাওয়ার এসে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, সে সুযোগ দিই না।

৩. আমি হচ্ছি আফ্রিকার হিরো।

৪. রাজনীতি হচ্ছে বক্সিংয়ের মতো। আপনি আপনার বিরোধীকে নকআউট করার চেষ্টা করবেন।

৫. জার্মানি হচ্ছে সেই দেশ যেখানে হিটলার ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং সুপ্রিম কমান্ডার, তিনি ষাট লাখের বেশি ইহুদিকে গ্যাস দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছেন।

৬. কারো পক্ষে বুলেটের চেয়ে দ্রুতগামী হওয়া সম্ভব নয়।

৭. এটা আমার জন্য নয়, আমি মানুষের মাংস খাবার চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু আমার জন্য তা বড্ড বেশি লবণাক্ত।

৮. আমি যেভাবে চিন্তা করি সেভাবেই কথা বলি বলে কোনো কোনো মানুষ আমাকে ভুল বোঝে।

৯. কেউ কেউ যদিও মনে করেন হিটলার খারাপ ছিলেন; আমি মনে করি তিনি ছিলেন মহৎ মানুষ, সত্যিকারের বিজয়ী, যার নাম কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়।

১০. আমার মিশন হচ্ছে দুর্নীতি, হতাশা ও দাসত্বের মন্দ পরিস্থিতি থেকে আমার দেশকে বের করা আনা। একবার এসব পাপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই সত্যিকারের বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা এবং তার তত্ত্বাবধান করব।

১১. আমি একজন বিখ্যাত খেলোয়াড়, বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্মরণীয় থাকতে চাই।

কোনো সন্দেহ নেই ইদি আমিন একজন ইগোইস্ট।

ইদি আমিনের দানব চরিত্রটিই পৃথিবী বেশি দেখেছে, সেভাবেই তিনি চিহ্নিত হয়েছেন। হিটলারের পর নির্মমতার উদাহরণ দিতে ইদি আমিনকেই টেনে আনা হয়। তিনি নিজ দেশের জন্য কী করছেন, তা খুব কমই আলোচিত হয়। এখনো উগান্ডাবাসী মনে করে তাদের দেশের উন্নয়নের ভিত রচনা করেছেন ইদি আমিন।

 

এম এ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা


শর্টলিংকঃ