উপেক্ষিত ইউজিসির নির্দেশনা, ফি আদায়ে চলছে মানসিক চাপ!


ইউএনভি ডেস্ক:

অনলাইনে পাঠদান, পরীক্ষা ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা মানছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেমিস্টার শেষ করা এবং শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সেমিস্টারে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তারা। যদিও ইউজিসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, চলমান সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী সেমিস্টারে কোর্স রেজিস্ট্রেশন ও ক্লাস করার সুযোগ পাবেন। এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সতর্ক থাকতে সাধারণ বিজ্ঞপ্তিও জারি করে ইউজিসি।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতির মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নিতে গত ৭ মে ইউজিসির পক্ষ থেকে ২৩টি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলমান সেমিস্টারের শিক্ষাকার্যক্রম অনলাইনে সন্তোষজনকভাবে পরিচালনা করছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি চলমান থাকবে। তবে ল্যাবরেটরিভিত্তিক কোর্সের ব্যবহারিক ক্লাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সম্পন্ন করতে হবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাকালে সেমিস্টারের কোর্সগুলোর অসমাপ্ত পাঠ্যসূচির ওপর অনলাইনে পাঠদান চলবে। তবে সেমিস্টার শেষ হলেও ফাইনাল পরীক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হলে আয়োজন করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সকলপর্যায়ের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন আগের নিয়ম অনুযায়ী চলবে।

‘করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি আদায়ে মানসিক চাপ প্রদান করা সমীচীন নয়’ উল্লেখ করে তা পরিহার করে মানবিক আচরণসহ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন পরিশোধের নির্দেশ দেয় ইউজিসি।

এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক শিক্ষার্থী সেমিস্টার ফি পরিশোধ করতে পারেননি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বকেয়া অর্থ পরিশোধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। যারা টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের ফলাফল আটকে দেয়া হচ্ছে। ফলে ওইসব শিক্ষার্থীর পরবর্তী সেমিস্টারে ভর্তিও আটকে যাচ্ছে। ফলাফল পাওয়ার পরও টাকার অভাবে অনেকে পরবর্তী সেমিস্টারে ভর্তি হতে পারছেন না— এমন অভিযোগ অনেক শিক্ষার্থীর।

অথচ নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি ও পরবর্তী সেমিস্টার শুরু সংক্রান্ত বিষয়ে ইউজিসির নির্দেশনায় (অনুচ্ছেদ- ২) বলা আছে, চলমান সেমিস্টারে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী সেমিস্টারে কোর্স রেজিস্ট্রেশন ও ক্লাস করার সুযোগ পাবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর মধ্যে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্স কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের জানিয়েছে যে, টিউশন ফি জমা না দিলে আগামী মাস থেকে ক্লাস করতে দেয়া হবে না।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ইউজিসির নির্দেশনা মোতাবেক অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি না দিলে প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে? আমরা তো কারও কাছ থেকে বাড়তি কোনো অর্থ আদায় করছি না। টিউশন ফি বাবদ যেটা পাওনা সেটা দিতে বলা হচ্ছে।

‘টিউশন ফি আদায়ের বিষয়টি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, সে অনুযায়ী নোটিশ জারি করা হয়েছে। তবে টিউশন ফি পরিশোধ না করলে পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত না করার বিষয়টি জানা নেই’— বলেন তিনি।

প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক হান্নান চৌধুরী বলেন, ইউজিসির দেয়া সকল নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা ক্লাস-পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ব্যাচের সেমিস্টার শেষ হয়েছে, তাদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের সবকিছু সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়, কেউ অর্থ পরিশোধ না করলে পরবর্তী সেমিস্টারে উন্নীত করা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি বকেয়া বেতন না দিলে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করাও সম্ভব হয় না। এ কারণে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র অর্থ পরিশোধে নোটিশ জারি করা হয়েছে। তবে কারও যদি সমস্যা থাকে তাহলে মানবিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসির সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক দিল আফরোজ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে গাইডলাইন ইউজিসি থেকে দেয়া হয়েছিল, সেগুলো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মানছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসছে।’

তিনি বলেন, ‘ইউজিসিকে আইনের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে হয়, তাই অভিযোগের পাশাপাশি দরকার হয় অকাট্য প্রমাণ। সেজন্য আমরা একটা সাধারণ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। শিক্ষার্থীর ফি আদায় সংক্রান্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে বা পরিচালনার জন্য কোনো নির্দেশনা প্রদান করলে সেই ডকুমেন্টগুলো প্রমাণ হিসেবে ইউজিসিতে ইমেইল করার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হচ্ছে, তারা যেন নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে পালন করে।’

জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর  বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইনে ক্লাস নেয়ার সক্ষমতার কথা জেনেও ইউজিসি শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে বেশকিছু গাইডলাইন দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) করেছিল, তারা শর্তগুলো ভঙ্গ করবে না। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন কর্তন, ছাঁটাই কিংবা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে টিউশন ফি আদায় করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, যা তারা করছে। এ অভিযোগগুলো আমরা পাচ্ছি, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির  বলেন, ‘দুর্যোগকালীন এ সময়ে ইউজিসির দেয়া সকল নির্দেশ মেনে ক্লাস, পরীক্ষা ও ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করতে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্তক করে দিয়েছি। এরপরও যদি কেউ তার ব্যতিক্রম করে, তবে তাদের চিহ্নিত করে ইউজিসি ব্যবস্থা নেবে। আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ এলে তাদের সর্তক করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমরা একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিয়মের মধ্যে থেকে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান— উভয়কে সহনীয় হতে হবে। শিক্ষার্থীরা যদি একেবারে টিউশন ফি দেয়া বন্ধ করে দেন, তবে অনেক প্রতিষ্ঠান চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। বাড়ি ভাড়া, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে সকলকে যতটা সম্ভব মানবিক হতে হবে।


শর্টলিংকঃ