ঋত্বিক ঘটক : মেঘে ঢাকা তারা


রুহুল আমিন :

ঋত্বিক ঘটক। নিজেকে যিনি বলতেন ভাঙা বুদ্ধিজীবী। ব্রোকেন ইনটেলেকচুয়াল। তিনি আসলে পরিচালক হতে সিনেমা বানাতেন না। সিনেমা বানাতেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। নিজের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছাতে।

তাই তো তিনি বলতেন, ‘ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতোদিন খোলা থাকবে, ততোদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাবো। কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার চেয়ে ভালো কোনো মিডিয়াম বেরোয় আর দশবছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি সেখানে চলে যাবো।সিনেমার প্রেমে মশায় আমি পড়িনি। আই ডু নট লাভ ফিল্ম।’ ঋত্বিক ঘটকের পুরো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনে তার জন্ম। তার মায়ের নাম ইন্দুবালা দেবী ও বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক।

তিনি বাবা-মায়ের ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান। ঋত্বিক ঘটক রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। আর ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের সময় তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। কলকাতায় গিয়ে ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি নেন ঋত্বিক। পরে ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম এ কোর্সে ভর্তি হন তিনি। এই কলকাতার আশ্রয়ই ঋত্বিককে সারা জীবন পুড়িয়েছে। নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে শরণার্থী হবার কষ্ট ঋত্বিককে ক্ষণে ক্ষণে ভুগিয়েছে। যা তার সিনেমায় ঘুরে ফিরে এসেছে। তিনি যেন এই বেদনা তার জীবদ্দশায় কখনো ভুলতে পারেননি।

 

ঋত্বিক ছাত্র অবস্থায়ই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মঞ্চ নাটকের প্রতিও ছিল তার তীব্র ঝোঁক। নাটক লিখতেনও তিনি। ১৯৪৮ সালে ঋত্বিক ঘটক তার প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’ লিখেন। ১৯৫১ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটি) যোগ দেন তিনি। তিনি নাটক লেখতেন, পরিচালনা করতেন। পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন। এ ছাড়া এই সময় তিনি বের্টোল্ট ব্রেশ্ট ও নিকোলাই গোগোলের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। এ সময় ঋত্বিক বুঝতে পারেন মঞ্চ নাটক দিয়ে সমাজের সব মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব না।

তিনি আরো বেশি জনপ্রিয় মাধ্যম খুঁজতে থাকেন। অবশেষে তিনি চলচ্চিত্রকে বেছে নেন তার বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য। ১৯৫১ সালে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন ঋত্বিক ঘটক। এই ছবিতে তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী হিসেবেও কাজ করেন। সেই থেকে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। এরপর তিনি নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন। ১৯৫২ সালে তিনি নির্মাণ করেন তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তার ‘অযান্ত্রিক’ চলচ্চিত্রটি। ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শক্তিশালী চলচ্চিত্রকার হিসেবে পরিচিত হতে থাকেন। অযান্ত্রিকের পর তিনি একে একে নির্মাণ করেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার ও সুবর্ণরেখাকে বাংলা চলচ্চিত্রে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়। এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।

১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ আর ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পরে শরণার্থীদের অস্তিত্বের সংকট তার এসব চলচ্চিত্রে উপস্থিত ছিল। শরণার্থীদের আশ্রয় নেওয়া কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতাই মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার ও সুবর্ণরেখায় চিত্রিত হয়েছে। তবে কোমল গান্ধার ও সুবর্ণরেখার ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে ষাটের দশকে আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ সময় ঋত্বিক ঘটক স্বল্প সময়ের জন্য পুনেতে বসবাস করেন। ঋত্বিক ১৯৬৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপাল হন। এখানে থাকা অবস্থায় তিনি শিক্ষার্থীদের নির্মিত দুটি চলচ্চিত্র Fear and Rendezvous সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রায় এক যুগ বিরতির পর ১৯৭২ সালে ফের তিনি চলচ্চিত্রে ফেরেন। এ সময় তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করেন। ১৯৭৩ সালে সালে ছবিটি মুক্তি পায়। আর ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্ক আর গপ্পো’।

কাহিনীর ছলে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন এ ছবিতে। ছবিটিতে নিজের রাজনৈতিক মতবাদকেও দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন। যুক্তি তক্ক আর গপ্পোকে ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুবর্ণরেখার পর থেকেই ঋত্বিক মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে থাকেন। দীর্ঘদিন তার হাতে কোনো কাজ ছিল না। হতাশার অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকেন। শুরু করেন মদ্যপান। স্বাস্থ্যও খারাপ হতে থাকে। এক সময় আর কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তারপরও তিনি শেষ দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তার সমালোচকরা বলতেন, ঋত্বিক সিনেমার নেশায় কি পড়বে? বাংলা মদ আর বিড়ির ধোঁয়ার নেশায়ই তো বুঁদ হয়ে আছে। তবে চলচ্চিত্র বোদ্ধারা তাকে বরাবরই সমীহ করতো। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ সালে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

ঋত্বিক ঘটক স্বপ্ন দেখতেন শ্রেণিহীন সমাজের। যেখানো শোষক ও শোষিত সম্পর্ক থাকবে না। শ্রেণি বৈষম্য থাকবে না। মানুষই হবে মানুষের প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু ঋত্বিকের স্বপ্নের সে দেশ ঋত্বিক পাননি। সারা জীবনই তিনি পুড়েছেন সেই বেদনায়। তাই তো তার সিনেমায় দেখা যায় দুর্ভিক্ষ আর দেশভাগের বেদনায় জর্জরিত সমাজ থেকেও কি করে একটি পুঁজিবাদী, ভোগবাদী সমাজ উঠে দাঁড়ায়। আর নিজেকে ভাঙা বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার করে নেন। পরিচালনার পাশাপাশি তিনি কাহিনী ও চিত্রনাট্যও লিখেছেন বেশ কয়েকটি সিনেমার।

সেগুলো হলো মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতী (১৯৫৮), স্বরলিপি (১৯৬০), কুমারী মন (১৯৬২), দ্বীপের নাম টিয়ারং (১৯৬৩), রাজকন্যা (১৯৬৫) ও হীরের প্রজাপতি (১৯৬৮)। তিনি অভিনয় করেছেন এমন সিনেমাগুলো হলো তথাপি, (১৯৫০), ছিন্নমূল (১৯৫১) , কুমারী মন (১৯৫২), সুবর্ণরেখা (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম , যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৭। তার নির্মিত শর্টফিল্ম ও তথ্যচিত্রগুলো হলো : দ্য লাইফ অফ দ্য আদিবাসিজ (১৯৯৫), প্লেসেস অফ হিস্টোরিক ইন্টারেস্ট ইন বিহার (১৯৫৫), সিজার্স (১৯৬২), ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩), ফিয়ার (১৯৬৫), রঁদেভু (১৯৬৫), সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫), সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো (১৯৬৭), ইয়ে কওন (হোয়াই / দ্য কোয়েশ্চন) (১৯৭০), আমার লেলিন (১৯৭০), পুরুলিয়ার ছৌ (দ্য ছৌ ড্যান্স অফ পুরুলিয়া) (১৯৭০), দুর্বার গতি পদ্মা (দ্য টার্বুলেন্ট পদ্মা) (১৯৭১)। মৃত্যুর আগে অনেকগুলো কাজ চলমান ছিল, যা তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তার অসমাপ্ত ছবি ও তথ্যচিত্রগুলো হলো বেদেনি (১৯৫১), কত অজানারে (১৯৫৯), বগলার বঙ্গদর্শন (১৯৬৪-৬৫), রঙের গোলাপ (১৯৬৮), রামকিঙ্কর (১৯৭৫)। আগেও একাধিকবার স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। কিন্তু যুক্তি তক্ক আর গপ্পোর পর তিনি পুরোপুরি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তাকে ভর্তি করানো হয় মানসিক হাসপাতালে। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় মাঝেমধ্যেই তিনি মারমুখি হয়ে উঠতে থাকেন।

জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তার হাসপাতালে। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে মুক্তি নেন বাংলা চলচ্চিত্রের এই ধ্রুবতারা। ঋত্বিক যেন তার সিনেমার শিরোনামের মতোই মেঘে ঢাকা তারা। তার মৃত্যুর অনেক বছর পর বাঙালি বুঝতে পারে ঋত্বিক কেমন ছিলেন। তার চলচ্চিত্র কেমন ছিল। তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন। অথচ যখন তার সিনেমাগুলো মুক্তি পেয়েছিল তখন সিনেমাগুলো চলেনি। এই সিনেমা মানুষ দেখতে চায়নি তখন।


শর্টলিংকঃ