এই সময়ের রূপালি পর্দাতেও সমান, প্রবাহমান রবীন্দ্রনাথ


ইউএনভি ডেস্ক:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ভাবতেন। ১৯২৯ সালে রবি ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। অভিনয়ও করেছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং কঙ্কাবতী। একই বছর নরেশচন্দ্র মিত্র নির্মাণ করেন মানভঞ্জন। তবে সব ছিল নির্বাক চলচ্চিত্র।

এই সময়ের রূপালি পর্দাতেও সমান, প্রবাহমান রবীন্দ্রনাথ

নিজের লেখার ওপর নিজেই পরিচালনা করেন, নির্মাণ করেন নটির পূজা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৩২ সালের কথা। এরপর অবশ্য ২০১৯ সালেও নটির পূজা রিমেক হয়। এটি প্রথম সবাক, রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র । সত্যজিত রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, নরেশচন্দ্র মিত্র, নীতীন বসুরা গত শতাব্দীতে রবি ঠাকুরের চলচ্চিত্রকে নিয়ে এসেছেন অনেক সামনে

রবি ঠাকুরের লেখা উপন্যাস বা ছোটগল্প আজও সমান প্রাসঙ্গিক। দশকের পর দশক ধরে রবীন্দ্রনাথের লেখনি প্রাণ পেয়েছে রূপালি পর্দায়। শতাব্দী বদলেছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ফিরে ফিরে এসেছে বিভিন্নভাবে। সাদাকালো যুগ থেকে এই ডিজিটাল চলচ্চিত্র পরিচালকদের ভাবনাতেও রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি সমুজ্জ্বল।

নতুন শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসকে রূপালি পর্দায় যাঁরা তুলে ধরেছেন তাঁদের মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ অন্যতম। চোখের বালি ও নৌকাডুবি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি অবলম্বনে দুটি ছবি নির্মাণ করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঋতুপর্ণ ঘোষের সমসাময়িক পরিচালকদের মধ্যেই বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্রভাবনাকেও নাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘এলার চার অধ্যায়’-এর মূল ভাবনা ঘিরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ রচিত চার অধ্যায় উপন্যাস। ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষাপট,দেশের প্রতি কর্তব্য আর প্রেম এই দুইয়ের মাঝখানের দ্বন্দ্বে জর্জরিত এলা। ছবিতে এলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পাওলি দাম।

তবে রবি ঠাকুরের আলোচিত গল্প কাবুলিওয়ালা নিয়ে উপমাহদেশে তৈরি চলচ্চিত্র শোরগোল ফেলে দেয়। ১৯৬১ সালে হিন্দি ভাষায় নির্মিত হেমেন গুপ্তার পরিচালনায় ছবিটিতে অভিনয় করেন বলরাজ সাহনি, বেবি সোনু, উষা কিরণ।

বাংলাদেশে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন কাজী হায়াৎ। কাবুলিওয়ালা ছোটগল্প অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন কাজী হায়াৎ। ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন মান্না। এছাড়া মিনি চরিত্রে অভিনয় করেন প্রার্থনা ফারদিন দিঘী, তার পিতা লেখক চরিত্রে অভিনয় করেন সুব্রত বড়ুয়া ও তার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন দোয়েল। বাস্তব জীবনেও দিঘী সুব্রত ও দোয়েলের কন্যা। এই চলচ্চিত্রে তারা প্রথম একসাথে অভিনয় করেন। ছবিটি তুমুল আলোচিত হয়।

বাংলাদেশে ২০০৬ সালে মুক্তি পায় সুভা। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এই ছবিতে অভিনয় করেন শাকিব খান, ছবিটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী পূর্ণিমা। ছবিটি নির্মিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সুভা ছোটগল্প অবলম্বনে।

এক্কেবারে সাম্প্রতিককালে যেসব পরিচালকদের চলচ্চিত্র দর্শনে রবি ঠাকুরের ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম অমিতাভ ভট্টাচার্য। তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘রক্তকরবী’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটক রক্তকরবীকে আজকের প্রেক্ষাপটে তৈরি করেছিলেন অমিতাভ। মানুষের ওপর মানু্যরে শোষণ, ব্যক্তির অবমাননা, অব্যক্ত প্রেম, বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের প্রতি জোর গলায় প্রতিবাদ-সবই আছে এই নাটকে।

রবি ঠাকুরের লেখা সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস চতুরঙ্গ নিয়ে ২০০৮ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন একই নামের চলচ্চিত্র। তবে পরিচালকের ক্যামেরার লেন্সে একবারই রবীন্দ্র লেখনি মূর্ত হয়েছে তা নয়। ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল সুমন মুখোপাধ্যায়ের শেষের কবিতা। অমিত, লাবণ্য, কেতকীর প্রেম-সম্পর্কের জটিলতা সবই ধরা দিয়েছে এই ছবিতে।

বর্তমান প্রজন্মের পরিচালকদের মধ্যে রবীন্দ্র সৃষ্টির সবচেয়ে বিতর্কিত অ্যাডপশন নিঃসন্দেহে কিউয়ের তাসের দেশ। রবীন্দ্রনাথের নাটককে সমকালীন ছাঁচে ফেলেছেন কিউ।এটা মূলত কিউয়ের চোখে তাসের দেশের ভাবানুবাদ। তাই তিনি পত্রলেখা ও হরতনির মধ্যে যৌনমুক্তির চেতনা ও সমকামিতা খুঁজে পেয়েছেন। সমালোচনা হলেও অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধারাই কিউকে ভালো নম্বরে পাস করিয়েছিলেন। যদিও পরিচালকের কথায় তিনি নাকি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা আকৃষ্ট নন, কিন্তু তাসের দেশ তাঁর ঘাড়ে চেপেছিল ১২ বছর ধরে। ২০১৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি।

রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বা নাটক নিয়েই আজকের প্রজন্মের পরিচালকরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তেমনটা নয়-রবীন্দ্রনাথের কবিতাও বাদ যায়নি। রেশমি মিত্র রবি ঠাকুরের হঠাৎ দেখা কবিতাকে চিত্ররূপ দিয়েছেন। ছবিতে অভিনয় করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, দেবশ্রী রায়, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি, দ্বীপ ভট্টাচার্য।

শুধু বাংলা ছবির পর্দাতেই আটকে থাকেনি রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। এপিক চ্যানেলের জন্য বলিউডের বাঙালি পরিচালক অনুরাগ বসু তৈরি করেন ‘স্টোরিস বাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। এই বহুল প্রশংসিত শোয়ে চোখের বালি, চারুলতা, কাবুলিওয়ালা,ডিটেক্টিভ, সমাপ্তির মতো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সিরিজ।


শর্টলিংকঃ