এন্ড্রু’র জন্য সহায়তা চাওয়ায় তাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকেই


জিয়াউল গনি সেলিম ও এমএ আমিন রিংকু :

‘তিনি বাংলাদেশের এতো বড় মানের শিল্পী, তার চিকিৎসার অর্থের জন্য সাহায্য চাইতে আমি নিজেও যখন মানুষের কাছে গেছি , প্রতারণা আখ্যা দিয়ে অনেকেই বিদায় করে দিয়েছেন। যখন আর কিচ্ছু নেই। প্রচুর টাকা লাগছে। দেখলাম যে আর উপায় নেই। তাকে তো বাঁচতে হবে। তিনি যদি আবার গান গায়তে পারেন তাহলে হয়তো আবার বাড়ি করতে পারবেন। তাই জীবন বাঁচাতে বাড়িটিও বিক্রি করেছিলেন তিনি’।

মারস্যুপিয়াম অ্যাপার্টমেন্টের পূর্বঅংশে দ্বিতীয়তলার (ছবিতে ডান পাশে) এই ফ্ল্যাটটিই ছিল এন্ড্রু কিশোরের

চিকিৎসা শেষে গানের ভুবনে ফেরার আশায় শেষপর্যন্ত নিজের ফ্ল্যাটটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন বাংলাগানের প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। তবে সে আশা আর পূরণ হলো না।  ব্যক্তিজীবনে নানা অপূর্ণতা আর কষ্ট নিয়ে নীরব অভিমানেই চলেন গেলেন তিনি।গানের মতোই জীবনের গল্পে যা কিছু দেখার ও শোনার আর সময় বাকি থাকলো না। যাদুকরী কণ্ঠ হলেও কখনো বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন না তিনি। সারাজীবন কেবল সিনেমা ও স্টেজ শো’ করেই মাতিয়ে রেখেছিলেন।

শতচেষ্টা করেও আর কোনো বাঁধনেই আটকানো গেল না বাংলাগানের রাজপুত্র এন্ড্রু কিশোরকে। পৃথিবীর সব মায়াবন্ধন ছিন্ন করে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। জীবনে শেষদিনগুলোতে বেছে নিয়েছিলেন নিঃসঙ্গতা। বলেছিলেন, পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কেউ যেন যোগাযোগ না করেন। এমন কি কথা বলেন নি ফোনেও। নিশ্চিত মৃত্যুর পথযাত্রী জেনেও কী এমন গাঢ় অভিমানে সবকিছু থেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন নিজেকে?

এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু অধ্যাপক ড. দীপক দাস ইউনিভার্সালনিউজকে বলেন, প্রচণ্ড রকমের অভিমানী ছিলেন কিশোর। তিনি কখনো আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের কখনো কষ্ট দিতে চান নি। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন, আর বাঁচবেন না। তাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে পরিবারের সদস্য ছাড়া আরো সাথে দেখা করেন নি। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল- জন্মস্থানেই যেন মৃত্যু হয়। তাই সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা হয়ে রাজশাহীতে ফিরে উঠেছিলেন বোনের বাসায়। মৃত্যুর আগে তিন দিন ধরে সংজ্ঞাহীন ছিলেন। তবে মৃত্যুর সময় আমি ছিলাম। তিনি কোনো কথা বলতে পরেন নি।

সুরের ভুবনে কোনো অপ্রাপ্তিই বাধা হয়ে আটকাতে পারে নি কণ্ঠের যাদুকর কিশোরকে। তাই ১৫হাজারেরও বেশি গান নিজের কণ্ঠে তুলেছিলেন এই প্লেব্যাক সম্রাট। কিশোরের ভরাট কণ্ঠের মাদকতা সমাতালে মাতিয়ে রেখেছে অন্তত তিন প্রজন্মকে। এমন খ্যাতির চূঁড়া ছুঁয়ে থাকলেও তাঁর বুকের ভেতরে একটা গভীর ক্ষত ছিল আজীবনই। স্বাধীনচেতা এই সুরের পাখি বেতার বা টেলিভিশনের রীতি মেনে কখনো অডিশন দিতে যান নি।তাই তালিকাভুক্ত শিল্পীর খাতায় নাম ওঠেনি তাঁর। তবে সঙ্গীতজীবনের প্রথমদিকে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯সাল পর্যন্ত রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক ড. দীপক দাস বলছিলেন, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জীবনের সব সঞ্চয়ই যখন শেষ, তখন তাঁকে হারাতে হয় নীড়ের ঠিকানাও। রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকার এই অ্যাপার্টমেন্টে থাকা শখের ফ্ল্যাটটিও বিক্রি করতে হয়েছিল।

এ ফ্ল্যাটটি রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-আরডিএ’র পদ্মা আবাসিকে। তাই বিক্রি করতে গিয়েও তাকে নানা আইনী জটিলতায় পড়তে হয়েছিল। এন্ড্রু কিশোর এতো বড়মাপের সেলিব্রেটি, তাতেও কাজ হয় নি। একব্যাংক কর্মকর্তা অবশেষে ফ্ল্যাটটি কিনে নেন।

এরপরও চিকিৎসার টাকার সংকুলান হয় নি। এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু অধ্যাপক ড. দীপক দাস আরো জানান, অদ্ভুত ব্যাপার! তিনি বাংলাদেশের এতো শিল্পী, তার চিকিৎসার অর্থের জন্য সাহায্য চাইতে আমি নিজেও যখন মানুষের কাছে গেছি , প্রতারণা আখ্যা দিয়ে অনেকেই বিদায় করে দিয়েছেন। যখন আর কিচ্ছু নেই। প্রচুর টাকা লাগছে। দেখলাম যে আর উপায় নেই। তাকে তো বাঁচতে হবে। তিনি যদি আবার গান গায়তে পারেন তাহলে হয়তো আবার বাড়ি করতে পারবেন। তাই জীবন বাঁচাতে বাড়িটিও বিক্রি করেছিলেন তিনি।

ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু

সঙ্গীতজীবনে শ্রেষ্ঠ আসনটি ধরে রাখলেও কখনো ভুলে যান নি বাল্যকালের গানের ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুকে। তাই ওস্তাদের মৃত্যুর পর কিশোর ব্যক্তি উদ্যোগেই রাজশাহীতে বাচ্চুর নামে প্রতিষ্ঠা করেন গানের সংগঠন।ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মইনুল ইসলাম খোকন বলেন,  নতুন প্রজন্মের মাঝে ওস্তাদ বাচ্চুকে ধরে রাখতে এন্ড্রু কিশোর নিজ উদ্যোগেই এই সংগঠনটি করেছিলেন। প্রতি বছরই বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সবই হতো কিশোরের উদ্যোগে। তার টাকাতেই চলতো সংগঠনটি। এমন কি অফিস ভাড়াও তিনিই বহন করতেন।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাস্টার্স পাস করে ঢাকায় পাড়ি জমান সুরের ভুবনে ঝড় তুলতে। গান গেয়েই তিনি আটবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। গত ৬ জুলাই ৬৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই গুণীশিল্পী।


শর্টলিংকঃ