এমপি বনাব এসপির লড়াইয়ে অশান্ত শিবগঞ্জ


নিজস্ব প্রতিবেদক:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের রাজনীতিতে এমপি বনাম এসপি গ্রুপের লড়াই উঠেছে চরমে। প্রায় প্রতিদিনই উপজেলার কোথাও না কোথাও এমপি আর এসপি গ্রুপের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। এ যেন সরকারি আর বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান।

গত জানুয়ারি থেকে সর্বশেষ গত ২৭ আগষ্ট পর্যন্ত দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে ২৮ টি। অভিযোগ উঠেছে, একতরফাভাবে মামলা হচ্ছে এমপি লোকেদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশের পক্ষপাতমুলক ভুমিকার কারণে শিবগঞ্জে এসপি গ্রুপের ক্যাডাররা বেপেরায়া হয়ে উঠেছে।

দলীয় নেতাকর্মী ও স্থানীয়রা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ও কুমিল্লার এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে পরস্পর বিরোধী গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা অশান্ত করে তুলেছে শিবগঞ্জকে। সোনামসজিদ পোর্টের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে গত কয়েক মাসে দুই গ্রুপের মধ্যে পাল্টা পাল্টি হামলার ১০টি ঘটনা ঘটেছে। গত ২৫ থেকে ২৭ আগষ্ট পর্যন্ত উপজেলা সদরে একাধিবার দুই গ্রুপের মধ্যে সশস্ত্র ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বাড়ি ভাঙ্গচুর, ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছে অনেকে।

শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কারিবুল হক রাজিন অভিযোগে বলেন, কুমিল্লার এসপি সৈয়দ নুরুল ইসলামের বাড়ি শিবগঞ্জে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্ররাজনীতি করতেন। সেই সুবাদে তিনি স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পুলিশের নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন প্রশাসনে। স্থানীয় এমপি ডা. শিমুলকে কোনঠাসা করতে, শিবির-ছাত্রদলের চিহিৃত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও নাশকতা মামলার আসামিদের নিয়ে সশস্ত্র গ্রুপ তৈরির অভিযোগও রয়েছে । এমপি ডা. শিমুল যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই সৈয়দ নুরুলের ক্যাডাররা হামলা করছেন। আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা এসপির ক্যাডারদের হাতে প্রায়ই আক্রান্ত হচ্ছেন।

রাজিনের আরও অভিযোগ দীর্ঘদিন বিএনপি করলেও নিজের ভাই সৈয়দ নজরুলকে দলের মনোনয়নে উপজেলা চেয়ারম্যান করেছেন এসপি নুরুল। এখন পৌরসভাতে আরেক ভাই সৈয়দ মনিরুলকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। নিজে একদিন এমপি হবেন- এমন আশাতে ক্যাডারদের মাঠে নামিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছেন।

এতে দল ও সরকারের ভাবমুর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল আমার শিবির ছাত্রদলের যেসব ক্যাডারদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে আমাকে একটি পা হারিয়ে পঙ্গু হতে হয়, সেইসব ক্যাডারদের সৈয়দ নুরুল তার গ্রুপে ভিড়িয়েছেন। তারাই এখন ছাত্রলীগ যুবলীগে পদ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

পুলিশের একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে নিজের এলাকার রাজনীতিতে গ্রুপ তৈরি ও প্রশাসনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল বলেন, ২০১৩ সালে শিবগঞ্জে যখন জামাত বিএনপির তুমুল সন্ত্রাস চলছিল, তখন আমি অসহায় দলীয় নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আহত নিহতদের সাহায্য সহযোগীতা করেছি। সেই ধারাবাহিকতায় শিবগঞ্জের অসংখ্য মানুষ ও দলীয় নেতাকর্মী আমাকে ভালোবাসে। তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

শিবগঞ্জে দলকে শক্তিশালী করতে আমি সর্বাত্মক ভুমিকা রেখেছি। এমপি বিরোধী গ্রুপ পরিচালনা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এমপি ও তার লোকেরা অন্যায় করলে অন্যেরা কি হাত গুটিয়ে থাকবে। এমপির ক্যাডাররা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিকে গালাগালি করলে তারা কি চুপচাপ বসে থাকবে? এ কারণে তারাও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, এমপির লোকেরাই শিবগঞ্জে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস করছে। অন্যেরা তার জবাব দিচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এর বাইরে আর কি সমাধান আছে। আমি কখনো রাজনীতির বাইরে ছিলাম না। এখন শিবগঞ্জের মাটি মানুষের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারি না।

এদিকে অভিযোগ প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, এসপি সৈয়দ নুরুল রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে শিবগঞ্জের রাজনীতিকে অশান্ত করে তুলেছেন। বিপুল টাকা ঢেলে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনে ভাঙ্গন ও কোন্দল তৈরি করেছেন। সৈয়দ নুরুলের অনুসারীরা সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। নুরুল তার দেহরক্ষী এএসআই মামুনকে সর্বক্ষণ শিবগঞ্জে রাখেন। গত কয়েকদিনে শিবগঞ্জে নুরুলের গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারা যেসব সন্ত্রাসী কাজ করেছে তার নেতৃত্বে ছিল মামুন। এমপি ডা. শিমুল আরও বলেন, থানা পুলিশ, সৈয়দ নুরুলের নির্দেশে চলে। ফলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমি বিষয়গুলি আইজিপি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবকে একাধিকবার জানিয়েছি।

এমপি ডা. শিমুল আরও বলেন, সৈয়দ নুরুল রাজনীতি করতে চাইলে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে করতে পারেন। এভাবে সন্ত্রাসীদের পৃষ্টপোষকতা করে শিবগঞ্জের রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন-তাতে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাবেক এমপি গোলার রাব্বানীর সময়েই এসপি নুরুল শিবগঞ্জের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। পুলিশের চাকরি করলেও বিভিন্ন উপলক্ষে শিবগঞ্জে নিজের বাড়ি ও এলাকায় গিয়ে অনুসারীদের নিয়ে সমাবেশ করেন সৈয়দ নুরুল। এলাকায় গঠন করেছেন নুরুল ভাইয়ের সমর্থক গোষ্ঠী। যুবলীগ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের একাংশ নুরুল ভাইয়ের সমর্থক গোষ্ঠী লেখা জার্সি গায়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। এসব দলীয় কর্মসূচিতে তারা সৈয়দ নুরুলের নামে স্লোগান দেন। দেখা গেছে, নেতাকর্মীর অধিকাংশের ফেসবুক প্রোফাইলে এসপি নুরুলের ছবি সাটানো। সারাদিন তারা ফেসবুকে নুরুল বন্দনা করেন আর এমপি শিমুল ও তার পক্ষের নেতাকর্মীদের গালাগালি করে ও অশালীন ভাষায় পোষ্ট দেন। এসব পোষ্ট ট্যাগ করা হয় এসপি নুরুল ও তার দেহরক্ষী এএসআই মামুনকে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এসপি নুরুল  সাবেক ছাত্রনেতা হওয়ায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের সঙ্গে তার পরিচিতি ও সুসম্পর্ক রয়েছে। এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি তার অতি অনুগত শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কমিটিগুলিতে তার পক্ষের নেতাদের বসিয়েছেন। তারাই এখন এসপি নুরুলের হয়ে এমপি ডা. শিমুলকে কোনঠাসা করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এসপি নুরুলের প্রভাবে তার গ্রুপের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে পুলিশের নিস্ক্রিয়তা ও প্রশ্রয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জ থানার ওসি শামসুল আলম শাহ বলেন, পুলিশ দুই পক্ষের কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। যারাই বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এসপি নুরুল গ্রুপের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।


শর্টলিংকঃ