করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ভাবনা


বিশ্বে আমরা সবাই যে দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছি তার নাম প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। আজ এই দূর্যোগে কোথা থেকে এলো এই করোনা,কেন এবং কতদিন এ কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হবে তা এখন কেউই জানিনা।শুধু তাই নয় ছোট্ট এই ভাইরাস ক্রমশই মানব শরীরে তার রূপ বদলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভয়াবহভাবে নষ্ট করছে।তাঁর তান্ডবলীলায় পুরো বিশ্ব যেভাবে হেলে গিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা ।যেখানে ইউরোপের মতো দেশগুলোতে শাসকেরা অসহায় হয়ে পড়েছে,তারা আকাশের ওপর অসহায় চিত্তে তাকিয়ে স্রষ্টার কাছে সাহায্য চাইছে?

বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রয়েছে আমেরিকায়।তাদের দিকে তাকাই এবার।যেখানে কোনো সীমান্ত নেই, সেখানে কোনো দেশ নেই, এই সীমান্ত রক্ষা আর সীমান্ত বাড়ানোর জন্য ছোট-বড় সব দেশেই রয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনী। বিভিন্ন জরিপ, পরিসংখ্যান এবং গবেষণায় আমেরিকান প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়।

আকাশপথে যুদ্ধ করার সক্ষমতা, সামরিক ব্যয়, সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জামের সংখ্যা ইত্যাদিসহ ৫৫টি বিষয় বিবেচনা করে এই মত দিয়েছে গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার। এই বিশাল বাহিনীর পেছনে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ৭১৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করার পরিকল্পনা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; যা গত বছরের চেয়ে ৩৩ বিলিয়ন বা পাঁচ শতাংশ বেশি (সূত্র : সিএনবিসি নিউজ)। তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের এক বছরের বাজেট প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো এমন ১২টি দেশ চালাতে যে টাকা লাগে, প্রায় সে পরিমাণ টাকা খরচ হয় আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেছনে।প্রতিরক্ষা খাতে খরচের দিকে থেকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশ হলো- আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব, ভারত ও ফ্রান্স। পৃথিবীর মোট সামরিক বাজেটের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) খরচ করে এই পাঁচ দেশ।(সূত্র : এসআইপিআরআই)। আমেরিকার মতো একটি দেশ কেন এই বিশাল অঙ্কের টাকা প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের ‘উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন’ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর আবার এটি নিন্দা করেছে চীন, রাশিয়া এবং ইরান।রাশিয়া মনে করছে মার্কিন পরমাণু বোমাগুলো এত বড় আকারের যে তা আসলে কখনো ব্যবহার করা হবে না, তাই এগুলোকে তারা হুমকি বলে মনে করছে না। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ঠিক করে তারা নতুন ধরণের এবং ছোট আকারের পারমাণবিক বোমা বানাবে।

এসব ছোট আকারের বোমার ক্ষমতা হবে ২০ কিলোটন বা তার কম। তবে, এর ধ্বংসক্ষমতাও প্রচন্ড। ১৯৪৫ সালে জাপানের নাগাসাকিতে যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল তার ক্ষমতা ছিল এ রকমই – এবং তাতে ৭০ হাজারেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল।

কিন্তু পৃথিবীতে এই যে বড় বড় শক্তিধর দেশগুলোর হাতে এত যে পারমাণবিক বোমা আছে – তাঁরা কী এই পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারবে আটকাতে করোনা নামক দূর্যোগকে?নাকি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার পর আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে তাঁরা এসব শক্তির অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে নাশকতা উদযাপনে?

তবে তাদের এসব তথাকথিত শক্তি অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটাবে সেটি ভবিতব্য বিষয়।বর্তমানে সবচাইতে ভয়াবহ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে সেটি মোকাবেলা করা এখন অনিবার্য। সংবাদে যে খবর গুলো আসছে,তাতে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছে এই পরমাণু কিংবা সামরিক শক্তিতে বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা!

হয়তো তারা সেটা উদ্ভাবনও করতে পারবে কিন্তু পর্যাপ্ত সময়ে সমস্ত করোনা রুগীকে কতটুকু তারা সুরক্ষা সরবরাহ করতে পারবে নাকি মৃত্যুর ভয়াবহ মিছিল তাদের ভবিতব্য সেটি বলে দেবে সময়।

আমাদের দেশ স্রষ্টা প্রদত্ত যে প্রভাব বিস্তার কারী নিয়ামক রয়েছে তা হলো এদেশের মৌসুমী জলবায়ু।আমরা জানি এ জলবায়ুর কারনে সংগঠিত প্রচুর বৃষ্টিপাতে মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়। যা অন্তত্য বড় নেয়ামত। তারপরেও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়,এতগুলো মানুষ তার ভেতর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনুন্নত কেমন করে এতবড় একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।কেমন করে পরবর্তী উত্তরনে ধাপ পার হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।খুব হালকাভাবে নিতে গেলেও সেটি সম্ভব নয়, কারন হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত কীটের অভাব, নাকি আন্তরিকতার অভাব এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবেনা এখন।

কাজেই নিম্ন মধ্যবিত্ত,নিম্নবিত্ত মানুষগুলো একটি কঠিন পরিস্থিতর সম্মুখীত হতে পারে এটি উড়িয়ে দেয়া যাবে না।এখান থেকে সমাধানের পথ একটাই তা হচ্ছে ঘরে থাকা, সামাজিক বা শারিরীক বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করা।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে যেসকল বিধিনিষেধ রয়েছে তা সর্বসম্মতিক্রমে মেনে চলা।

সম্প্রতি চীন যেসমস্ত প্রক্রিয়ায় এ সংকট মোকাবেলা করেছিল তার পুরোটা আমাদের মতো মধ্য আয়ের দেশ যদি অনুসরণ করতে নাও পারে, তার কিছুটা করা কিন্তু সক্ষম।যেমন খুব প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে বের হলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণু নাশক সরঞ্জামটি সাথে করে রাখা।ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে ও পরে প্রয়োজনমতো সেটি ব্যবহার করে সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

হালকা ঠান্ডা,জ্বর,সর্দি,কাশি হলেই হাসপাতালে ভীড় না করা।এতে নতুন সংক্রমিত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকতে পারে।তবে করোনা সংক্রমনে যেসমস্ত উপসর্গ দেখা যাবে তৎক্ষণাত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

পরিবারে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, শিশু রয়েছে তাদের প্রতি সংবেদনশীল এবং যত্নশীল হওয়া। যাতে পূর্বে তারা এ রোগটি থেকে সুরক্ষিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমি বলবো পরিবারের সুরক্ষায় ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই(পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট) সরবরাহ রাখার ব্যবস্থা আবশ্যক।ঘরে মাস্ক,জীবাণুনাশক সাবান এবং সরঞ্জামের পাশাপাশি জ্বর,ঠান্ডার জন্যে ব্যবহৃত নাপা, এলাট্রল,গ্যাস্ট্রিকের জন্যে প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো যতটা দরকার ততটাই সরবরাহে রাখা।

সম্প্রতি চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্যে দ্রুত হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে পাওয়া না গেলে বিকল্প হিসেবে উবার ডাক্তার নামক যে পদ্ধতি আছে সেগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে।এছাড়া আইইডিসিআর ( Institute of Epidemiology Disease Control & Research) বর্ণিত ১৬২৬৩ এবং ৩৩৩ যোগাযোগ করার কথা সংবাদে বলা হয়েছে।তাছাড়াও বিভিন্ন গণ মাধ্যম,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রয়োজনীন নম্বরগুলোস্বা ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো সরবরাহ করা।

চৌদ্দ দিনের কোয়ারেন্টাইন বা সামাজিক নিরোধক বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে প্রত্যেককে।
তার মানে, এই সময়টা পার হলেই নিরাপদ তা নয়। পরিস্থিতি সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রনে না আসা অব্দি ঘর থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া যাবে না কোনমতে। বর্তমানে এটি এখন সবচাইতে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে এ সংকট মোকাবেলায়।
সামাজিক সেবা সংগঠন কিংবা সংস্থাগুলো বর্তমানে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে।গণ মাধ্যম থেকে পাওয়া এসব সংবাদে বিত্তবানদের অনুপ্রাণিত হওয়ার মক্ষোম সময়।প্রতিটি ইউনিয়নে, ওয়ার্ডে,পাড়া মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করে ত্রাণ তৎপরতা বিস্তৃত ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা এখন সময়ের দাবি। করোনা পরিস্থিতি থেকে উৎরে ওঠার পরও দূর্যোগ থেমে যাবে তাও নয়।বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, যেসমস্ত ঋৃন গ্রহন করে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিল সেগুলো পরবর্তীতে যোগান কিভাবে হবে,আয়রোজগারের বিষয়ে মারাত্মক ঝুঁকি তাদের মোকাবেলা করতে হবে।

জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল টেলিভিশন সংবাদের মাধ্যমে তার দেশসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসকে জার্মানির জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, প্রত্যেককে সংক্রমণ এড়াতে সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে কর্তৃপক্ষ নিয়ম বিধি সর্বসাধারণের পক্ষে মেনে চলতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান দৈনিক ইত্তেফাকে(২৬ মার্চ ২০২০) জানিয়েছে, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পর পর দেশ যে একটা বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে তা বঙ্গবন্ধু নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি অসংখ্য বাধা মোকাবিলা করে সাফল্য পাওয়ার যে সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে সে সত্যটিও।তার কথার সূত্র ধরে বাংলাদেশ বর্ধিত জনসংখ্যার অভিশাপ সত্ত্বেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা যথেষ্ট। ধান উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।

এছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,১৯৭২ সাল পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠনের সময় খাদ্য শস্যের ভয়াবহ সঙ্কট চলছিলো। ওই সময়টায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের সঙ্কটের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জও বঙ্গবন্ধুর সরকারকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। আর এগুলো মোকাবিলার জন্য তাঁর হাতে সম্পদও ছিল খুব সীমিত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ আমাদের বিরুদ্ধে বৈরি অবস্থানে। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু এই অল্প দেশজ সম্পদ এবং কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়েই ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশের অর্থনীতিকে তুলে আনতে পেরেছিলেন। কাজেই তাঁর মতো শক্তিশালি এবং অনুপ্রেরণাদায়ি নেতৃত্বের গুণে এদেশের মানুষ যেমন ঐসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল,তেমনি একটি কার্যকরী দূরদর্শিতাসম্পন্ন নেতৃত্ব আবার সজাগ করে তুলতে পারে; ঐক্যবদ্ধ করতে পারে বিপুল জনমতকে।সে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে, তেমনই প্রত্যাশা।তবে তার পূর্বে সর্বসম্মিলিতভাবে করোনা সংক্রমন ঠেকাতে যে সচেতনতার কথা বারবার বলা হচ্ছে তা মেনে চলা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

হাসিনা সাঈদ মুক্তা
ক্যান্টনমেন্ট,ঢাকা।


শর্টলিংকঃ