করোনা প্রতিরোধ: নাগরিক দায়িত্ব


করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমকে যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন গত ২৫ মার্চ ২০২০ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে। ভাষণে তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনা ভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সবার প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হবো। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। একজন নাগরিক হিসেবে নিশ্চয় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণকে সাহস জোগানো, পাশে থাকার কথা ব্যক্ত করেছেন। নাগরিক হিসেবে উৎকন্ঠার মধ্যেও খানিকটা সাহস সঞ্চার হয়েছে। হওয়াটা স্বাভাবিকও বটে। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করেছেন। এদিকে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানেও কোন আড়ম্বতা ছিলনা। শুধু নিয়ম রক্ষার কাজটি করেছেন প্রশাসন। করাটাই বর্তমান সময়ে স্বাভাবিক বিষয়।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মারাত্মক আকার ধারণ করেনি যা আইইডিসিআর এর হিসেবে মতে। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার মতো অবস্থাও তৈরি হয়নি। কিন্তু সাহস রাখার কথা বার বার উচ্চারিত হচ্ছে বিভিন্ন তরফে। তবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলারও কিছু হয়নি বলে আমি মনে করি। একটি তথা বলা প্রয়োজন, সচেতন ও সোচ্চার জনগোষ্ঠী তথা নাগরিক সমাজই পারে এই মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে। সরকারের নির্দেশনা মেনে নাগরিক হিসেবে আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসগুলোকে একটু পাল্টে ফেলার চেষ্টা করি তাহলেই হয়তোবা করোনা মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।

কথায় কথায় শুধু নিরক্ষর-খেটে খাওয়া মানুষ যারা বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাঁশি শিষ্টাচার তথা স্বাস্থ্যসম্মত লাইফস্টাইল মেনে চলতে অভ্যস্ত নয় তাদের উপর দোষ না চাপিয়ে নিজেদেরকে প্রশ্ন করি আমরা আসলেই স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলছি কি না। জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলার কথা থাকলেও তার ভ্রুক্ষেপও করছিনা। অনেকে আবার ত্রাণ দেবার অযুহাতে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করছি তাতে করে আমরা আমাদের বিপদ আমরাই ডেকে আনছি। নির্দিষ্ট দুরত্ব অবস্থান করার বিষয়টিও আমলেই নিচ্ছিনা অনেকেই। নিজেদের আমরা সচেতন নাগরিক দাবি করছি বটে, তবে আচরণগত দিক থেকে এর কোন দৃশ্যমান ফলাফল দেখা যায়নি।

একজন নাগরিকের এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজের ঘরে থেকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্বন কওে করোনা ভাইরোস প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিষয় বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো। যাতে করে প্রত্যেক নাগরিক তার লক্ষ্যিত জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তুলতে পারে। তবে একাজ একজন, দুজন নয়, সকলকেই করতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। অপরাপর বিষয় হলো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিততে হলে আমাদের সবাইকে একসাথেই দায়িত্ব নিতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘরের ভেতর থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিজের, পরিবারের এবং দেশের জন্য আমাদের কিছু ত্যাগ করতে হবে।এটি এখন চিরন্তন। বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছেন, তাদের অনুরোধ করবো, তারা যেনো নিয়ম মেনে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন।

কেউ মিথ্যে বা গুজব ছড়াবেন না। আর গুজবে কানও দিবেন না। এটি প্রত্যেক নাগরিক দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করে। তবে অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে নাগরিকরা যেন, সঠিক তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। অবশ্যই আমাদের ভুললে চলবেনা, আমরা যেন ইতালি বা আমেরিকার মতো হেলা না করি, চীনও কিন্তু শুরুতে আমলে নেয়নি, অবশ্যই আমরা যেন এই ভুল না করি। তাহলে খেসাড়ত দিতে হবে সমগ্র বাঙালি জাতিকে। এখনও সেই সময় আছে। সবাই দায়িত্বের সঙ্গে চলাফেরা করলে আমরা এই লড়াই জিততে পারবো। দোষারুপের রাজনীতি পরিহার করে সকলকে এক সাথেই হাটতে হবে যুদ্ধে জেতার জন্য। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে দেখেছি সর্বদলীয় সভা করতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ডাকে সকলেই এক হয়ে গেছে করোনা মোকাবেলায়। তাহলে আমাদের সমস্যা কোথায়? আসলে সমস্যা মানসিকতায়। ইতিবাচক রাজনীতিই পারে বর্তমানে করোনা মোকাবেলায় সফল হতে।

আজকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতা পুরোপুরি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। করোনা যখন চীনে সংক্রমণ ঘটে ঠিক তখনি প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিলো স্বাস্থ্য দপ্তর-সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে। ভারত যখন মহামারী ঘোষণার পরই লকডাউন করলো, আমরা কিন্তু তা এখনো করলাম না যদি অঘোষিত লকডাউন বলছে কেউ কেউ। অন্যান্যদেশে যখন আন্তর্জাতিক সহ সবধরণের বিমান চলাচল বন্ধ, ঠিক সেসময়ও আমাদের লন্ডন, চীনের সাথে আকাশ পথের যোগাযোগ চলমান। যদিও প্রশ্ন উঠেছে বহি:বিশ্বের যোগাযোগ বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু অন্যান্য দেশগুলো তো বন্ধ রেখেছে। জানিনা কর্তৃপক্ষ কোন যুক্তিতে তা অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে উন্নত দেশের চেয়ে বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যদিও আক্রান্তের সংখ্যা কম। কিন্তু আমাদেও মতো জনবহুল দেশে এখনি প্রস্তুতি না রাখলে খুবই যন্ত্রনাদায়ক হবে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী বিদেশ ফেরত ও কভিড-১৯ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের দুই সপ্তাহ নিজেদের সুরক্ষা বিষয়ে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন নিশ্চিতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মতো জনবহুল ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত কারণে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এ ভাইরাস প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়।

একটি কথা সবিশেষ বলতে চাই রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে সম্পর্কটা খুবই নিবিড়। রাষ্ট্রহীন ব্যক্তি যেমন আত্মপরিচয়হীন, তেমনিভাবে নাগরিক ছাড়া রাষ্ট্রও অকার্যকর। রাষ্ট্র যেমন নাগরিক জীবন অর্থবহ, সুন্দর ও গতিশীল করে তোলে, ঠিক তেমনিভাবে সুনাগরিকও রাষ্ট্রকে সফল করে তোলার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। নাগরিকরা হবেন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যশীল। অচেনা করোনা ভাইরাস বদলে দিয়েছে পৃথিবীর যাপিত জীবন। পৃথিবী এখন কাঁপছে অদৃশ্য শক্তি করোনা ভাইরাসের ভয়ে। যদি আমরা আমাদের নাগরিক কর্তব্য নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই হয়তোবা করোনা ভাইরাস যুদ্ধে আমরা জিততে পারবো। #

লেখক: সুব্রত কুমার পাল, সুশাসন বিষয়ক বিশ্লেষক/ উন্নয়ন কর্মী, রাজশাহী


শর্টলিংকঃ