করোনা মহামারি এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমের অপপ্রচার


প্রণব কুমার পান্ডে

কোভিড -১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সাল থেকে গোটা পৃথিবী শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম সময় পার করছে। মহামারির স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রভাব এত মারাত্মক যে বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতিগুলো এখনও এর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনও কোভিড -১৯ মহামারির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তরঙ্গ মোকাবেলা করতে লড়াই করছে।

বিভিন্ন সংস্থার ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়ায় এই দেশগুলোর সরকার ও জনগণ স্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয় কারণ এই মহামারিটি দেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।

বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারিকালীন ব্যতিক্রমীভাবে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে। সুতরাং, গোটা বিশ্ব কোভিড -১৯ মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখে অবাক হয়েছে।

অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডের লেখা বই
অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে’র লেখা বই

এখন বেশ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হ’লো : কীভাবে বাংলাদেশ সরকার মহামারি মোকাবেলা করেছে এবং মহামারিটির বিপর্যয়মূলক প্রভাব দেশটিকে কতটা প্রভাবিত করেছে? ইতিমধ্যে আমরা সকলে জেনেছি যে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার অন্যতম সেরা সম্ভাব্য ব্যবস্থা হল লকডাউন কার্যকর। তবে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে দীর্ঘ মেয়াদে লকডাউন কার্যকর করে জনগণকে ঘরে আটকে রাখতে ব্যর্থ হওয়া খুব সাধারণ বিষয়। মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারকে কয়েক মাসের জন্য সরকারি ছুটি আকারে লকডাউন প্রয়োগ করতে হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের জীবিকার জন্য দৈনিক শ্রমের উপর নির্ভর করে। সরকার এই সময়ে অনাহার থেকে বাঁচাতে এই শ্রেণীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করেছে। সরকার যে সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেছিল সেগুলো হল উন্মুক্ত বাজারের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয়, ৫ মিলিয়ন মানুষের কাছে সরাসরি নগদ সাহায্য স্থানান্তর এবং দারিদ্র জনগণকে বাঁচাতে সামাজিক সুরক্ষার অধীনে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো। সরকারের সহায়তায় এই জনগোষ্ঠী মহামারি চলাকালীন তাদের দিনানিপাত করতে সক্ষম হয়েছে।

অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে'র লেখা বই
অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে’র লেখা বই

মহামারির বিরূপ প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে সরকার এক লক্ষ একুশ হাজার কোটি টাকার একটি বিশাল অংকের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে যা গোটা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী প্রণোদনা প্যাকেজ ছিল। পরবর্তী সময়ে, সরকার এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রদান করে। এমনকি, সরকার কোভিড -১৯ রোগীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত তহবিল সরবরাহ করেছে।

তারা দেশবাসীকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন উন্নত দেশ যখন ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে লড়াই করছে, তখন সরকার কোভিড -১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা ক্রয় করে টিকা প্রদান প্রক্রিয়া পরিচালনা শুরু করেছে। কোভিড -১৯ পরিচালনায় সরকারের সাফল্যের কারণে, বাংলাদেশ ব্লুমবার্গের কোভিড -১৯ রেসিলিয়েন্স র‌্যাঙ্কিংয়ে ২০ তম স্থান অর্জন করেছে অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম মৃত্যুর হার নিয়ে।

অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে'র লেখা বই
অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে’র লেখা বই

দুর্ভাগ্যক্রমে, অনেক পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং তাদের আধিকারিকরা আনন্দের সাথে সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য গ্রহণ করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, তারা মহামারি মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যের সংবাদ পরিবেশন না করে তাঁর ভূমিকা ক্ষুণ্ণ করার লক্ষে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। ভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী অপ্রত্যাশিত সাফল্য দেখে হতাশ হয়ে তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনেয় অসত্য তথ্য পরিবেষণ করেছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ২০২০-এর জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে আইসিডিডিআর,বি এর প্রধান ড. জন ডি ক্লিমেটস- এর বরাত দিয়ে দ্যা ইকোনমিস্ট বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করে দাবি করে যে ঢাকা শহরে সেই সময় কোভিড -১৯ রোগীর ছিল প্রায় ৭,৫০,০০০। পরে ড. ক্লিমেটস স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে এই রিপোর্টে ভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আইসিডিডিআর,বি এর সংক্রামিত কর্মচারী এবং কর্মকর্তার এর সংখ্যার উপর উপর ভিত্তি করে ঢাকা শহরের রোগীর সংখ্যা দাবি করা হয়েছিল যেটি যুক্তিযুক্ত ছিল না।

অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে'র লেখা বই
অধ্যাপক ড. প্রণব কুমার পান্ডে’র লেখা বই

২০২০ সালের ৭ এপ্রিল, আল-জাজিরা ডাব্লুএইচওকে উদ্ধৃত করে একটি বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করেছিল যেখানে তারা দাবি করেছিল যে বাংলাদেশে কোভিড -১৯ এর সংক্রমণের ফলে দুই মিলিয়ন মানুষ মারা যেতে পারে। প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছিল যে চিকিৎসকরা এবং স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারীরা দাবি করেছেন যে তাদের পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না এবং কর্তৃপক্ষ প্রাদুর্ভাবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত ছিল না। এই সংবাদটি বিভ্রান্তিকর কারণ দেশে কোভিড -১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আজ পর্যন্ত ১০,০০০ এর বেশি হয় নি।

২০২০ সালের ২৩ শে মার্চ চ্যানেলটি সাধারণ জনগণের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে আরেকটি প্রতিবেদনে দাবি করে যে মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে দেশ প্রস্তুত না থাকায় বাংলাদেশের মানুষ ভয়াবহতায় সময় পার করেছে। তারা ভিডিওতে আরও দাবি করে যে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে কোভিড -১৯ এর প্রকৃত রোগীর সংখ্যা গোপন করার জন্য বেশী করে রোগী শনাক্ত করণের পরীক্ষা করছে না।

তারা আরও দাবি করেছিল যে মানুষ ভয়ে ঢাকা ত্যাগ করছে। প্রকৃত বাস্তবতা হল অফিস, শিল্প-কলকারখানা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক মানুষ তাদের গ্রামে গিয়েছিল। সরকার যখন অফিস এবং শিল্প-কলকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মানুষ খুব কম সময়ের মধ্যেই ঢাকায় ফিরে আসে। সরকারের সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ধরনের সংবাদ প্রচার করা হয়।

 

২০২০ সালের ১১ জুন, দ্যা টেলিগ্রাফ “করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের সমাজে গভীর বিভাজন প্রকাশ করেছে” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং দাবি করে যে জনসংখ্যার একাংশ অতি শীঘ্রই লকডাউন শিথিল করার সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছিল এবং তারা ধারণা করেছিল যে এই ধরনের হটকারী সরকারি সিদ্ধান্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বাড়িয়ে দিতে পারে। তাদের আশঙ্কা সত্য হয়নি কারণ আক্রমণের হার কখনই বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি এবং টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়া অনেক দেশের তুলনায় আগেই শুরু হয়েছে।

২০২০ সালের ২২ জুলাই প্রকাশিত “ঢাকা থেকে মানুষের প্রস্থান কারণ কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশীদের শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে” শিরোনামে অন্য একটি প্রতিবেদনে এই গণমাধ্যম দাবি করে যে ঢাকা শহরে বসবাসরত জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ গ্রামে চলে যাচ্ছে। তবে পরে দেখা গেছে যে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে শুরু করলে জনগণ ঢাকায় ফিরতে শুরু করে। বাস্তবতা হল অনেক উন্নত দেশের তুলনায় মহামারি চলাকালীন আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ ভাল করেছে। সুতরাং, এটি বলা যায় যে, এই গণমাধ্যমের দাবিটি বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।


অন্যদিকে, ডয়চে ভেলে ২০২০ সালের ২০ জুন “করোনা ভাইরাস: বাংলাদেশের অর্থনীতি নিম্নগামী, দারিদ্র্যতার হার বৃদ্ধি ” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দাবি করে যে কোভিড -১৯ বাংলাদেশকে কঠোরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দেশটিতে দারিদ্র্যতার হার উচ্চ মাত্রায় বেড়েছে যদিও সরকারি অনেক দিনের প্রচেষ্টায় সেই হার কমেছিল। তবে ইকোনমিক ফোরাম তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে বিশ্বের অনেক বড় বড় অর্থনীতির তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারিকালীন ব্যতিক্রমীভাবে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে। সুতরাং, গোটা বিশ্ব কোভিড -১৯ মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখে অবাক হয়েছে। এমনকি নেত্র নিউজও বিভিন্ন প্রতিবেদনে দাবি করার চেষ্টা করেছে যে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি একটি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলো যদিও এই ধরনের সংবাদ ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

উপরে উল্লিখিত পরিস্থিতিতে দাবি করা যায় যে কোভিড -১৯ মোকাবেলায় শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য আন্তর্জাতিক অনেকগুলো গণমাধ্যমকে হতাশ করেছে। ফলে, তারা বাংলাদেশের কোভিড-১৯ মহামারি সম্পর্কে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ও ভ্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাস্তবতা হ’ল এই শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশটি দুর্দান্তভাবে কাজ করেছে। সুতরাং, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই। তাদের উচিত মনগড়া তথ্য প্রকাশের পরিবর্তে সাফল্যের সাথে মহামারি পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং অর্থনীতির গতি অক্ষুণ্ণ রাখতে বাংলাদেশ সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করা ।


শর্টলিংকঃ