করোনা মোকাবেলায় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা


‘করোনা’ ভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সকলের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকলকে দল-মতের উর্দ্ধে উঠে করোনা মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। আমরা যদি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তথা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে পারি তাহলেই করোনার মহামারী থেকে বাচাঁ কিছুটা হলেও সম্ভব হতে পারে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের হিসেব মতে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪৫৭১টি। সে হিসেবে মোট ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৫৯৪২৩ জন, পৌরসভায় ৪২৪৪ জন উপজেলা পরিষদে ২৪৬০ জন, সিটি কর্পোরেশনে ৫৩৯ জন এবং জেলা পরিষদে ৬১ জন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ৯১৫ জন সদস্য, সংরিক্ষত ৩০৬জন নারী সদস্য আছে। সবমিলিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ৬৭৯৪৮ জন। সংখ্যায় এটি একেবারে কম নয়।

সবার মধ্যে সদিচ্ছা থাকলে করোনা মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দ। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে সেবা করার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতাকারীর সংখ্যা গড়ে এর ৩গুণ হলে সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় দুই লাখের অধিক। এই দুই লাখের অধিক ব্যক্তি যদি সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে দাড়াঁয় তাহলে এই মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া আমাদের মতো দেশে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারে। অতীতেও বিভিন্ন ক্রান্তিকালে আমরা এর চিহ্ন রেখেছি।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নিদের্শনা থাকলেও করোনা প্রতিরোধে তৃণমূলে খুব একটা প্রতিফলন দেখা যায়নি কার্যকরভাবে। একদিকে যেমন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য সংকটে ফেলেছে তার চেয়েও বড় বিষয় হলো সাধারণ মানুষকে করোনা প্রতিরোধে সচেতন কওে তোলা। পরিবেশ এবং পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, আমরা যদি আমাদের গ্রামগুলোকে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ প্রতিনিধিদের কার্যকর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের এখনই সময়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই যে জনকল্যাণে ভূমিকা রাখার কথাই বলা হয়েছে মূল ভাবেই।

রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাকে ফোন করে, ফেসবুকে, ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে বেশকিছু স্বেচ্ছাব্রতী জানিয়েছেন যে, তাদের এলাকাগুলোতে সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে বসছে হাট-বাজার, আড্ডা, একসাথে একাধিক লোকের চলাফেরা, স্বাস্থ্যবিধি তোয়াক্কা না করা। আর এই ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা মেলেনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জোড়ালো ও কার্যকর ভূমিকা। তবে এই চিত্রের ভিন্ন চিত্রও কিছু কিছু স্থানে দেখা গেছে, তা অস্বীকার করা যাবেনা, তবে সকলের সমন্বিত অংশগ্রহণের ফলে একটি ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। তাই জনসচেনতা সৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিকে এখনই কাজে নামতে হবে।

রাষ্ট্রের শাসনকার্য সঠিকভাবে পরিচালনায় স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রিয় সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশহিসেবে গড়ে উঠেছে। এই সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মূল কারণ হচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা স্থানীয়ভাবেই সমাধান করার উদ্যোগ নেয়া। গণতান্ত্রিক ধারণার উপর ভিত্তি করে একটি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, পরিষদের প্রধান কার্যাবলীতে জনকল্যাণ ও সামাজিক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে সেই সাথে আরো বিষয় যুক্ত রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের জীবন যাপনকে সুন্দর করার স্বার্থেই এ জন্য আইন অনুযায়ী নির্ধারিত কাজ সবমিলিয়ে ১১০টির মতো।

অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০ বাংলাদেশের সংবিধানে স্থানীয় সরকার পদ্ধতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে কার্যকর পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়, যাতে প্রশাসন প্রতিটি ইউনিটের জন্য জনগণকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনঅংগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি গুরুত্ব অনেক।

উপজেলা পরিষদের জন্য ৩১টি কাজ আইনগতভাবে নির্ধারণ করা থাকলেও বাস্তবে এই পরিষদের কাজ খুবই সীমিত। জেলা পরিষদের (তিন পার্বত্য জেলা ব্যাতিত) জন্য নির্ধারিত কাজ রয়েছে ৬৩টি। কিন্তু উপজেলা পরিষদের মতো তারাও এডিপিভুক্ত কিছু উন্নয়নকাজ ছাড়া দৃশ্যমান আর কোনো কাজ করে না। জেলা পরিষদের এই কাজও দৃশ্যমান হয়েছে জেলা পরিষদ নির্বাচনের পর। পৌরসভার জন্য আইনে সবমিলিয়ে কাজের সংখ্যা ১৭২টি।

কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন, নর্দমা পরিষ্কার, জন্ম-মত্যু নিবন্ধন ও কিছু প্রত্যয়নপত্র দেওয়া, টিআর-কাবিখা বিতরণের মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ। আইনে সিটি করপোরেশনের জন্য ১৬০টি কাজ নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু তারাও অনেকটা বৃহত্তর পরিসরে পৌরসভার কাজগুলোই করে থাকে। বড় শহরগুলোতে সিটি করপোরেশনের কাজে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ও রয়েছে।

এখন সময় এসেছে জনপ্রতিনিধির কার্যকর ও সঠিক দায়িত্ব পালনের। সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুবিধা যেমন পৌছে দেয়ার উদ্যোগ নেবেন আমাদের জনপ্রতিনিধিরা, ঠিক একটি কার্যকর শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এমনটাই প্রত্যাশা।

 সুব্রত কুমার পাল : সুশাসন বিষয়ক বিশ্লেষক


শর্টলিংকঃ