নিজস্ব প্রতিবেদক :
গাছের গুড়ি চুরি থেকে শুরু করে মাদকের কারবারে পটু তিনি। দলের ভেতরে-বাইরে যাকে তাকে ধরে পেটানো ও চাঁদাবাজি করাই তার কাজ। সিটি কলেজ হোস্টেলের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তার টর্চার সেল। যখন যাকে ইচ্ছে ধরে এনে পেটানো হয় এখানে। তার বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পান নি সাংবাদিকরাও। অভিযোগ আছে, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় নাঈমের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া হয় না। তার পেছনে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘ টেন্ডারবাজ ‘ হিসেবে পরিচিত এক নেতাও।
এর আগের কমিটিতে রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন নাঈম। তখন থেকে বেপরোয়া তিনি। তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে অন্তত বহু শিক্ষার্থী। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে রাজশাহী কলেজকে নিজের কব্জায় রেখেছেন তিনি। আর কলেজের এমন কোনো উন্নয়নমূলক কাজ নেই, যে কাজের জন্য তার পোষ্য বাহিনীকে চাঁদা দিতে হয় না। এসব নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এমনকি ছাত্রলীগের একটি অংশের নেতাকর্মীরাও ক্ষুব্ধ।
রাজশাহী কলেজ সূত্র জানায়, এ কলেজে মোট তিনটি হোস্টেলের সাতটি ব্লকে প্রতিবছর ৫৫-৬০টি আসন ফাঁকা হয়। এই ফাঁকা আসনগুলোয় শিক্ষার্থী উঠানোর জন্য কলেজ ছাত্রলীগের সুপারিশ নিতে হয়। সেই সুযোগে ছাত্রলীগ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে চার-পাঁচ হাজার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে থাকে। এই চাঁদা আদায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন নাঈম। চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়া এক শিক্ষার্থী জানান, ‘নাঈমকে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে হোস্টেলে উঠেছি। আবার মাঝেমধ্যেই তাঁর নাম করে দু-একজন এসে দু-একশ করে টাকা নিয়ে যায়।’
রাজশাহী কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী বলছেন, ছাত্রলীগ নেতা না্ঈমের কথা মতো কাজ না করলেই ধরে ধরে পেটানো হয়। চাঁদা না দিলে বা মিটিং-মিছিলে অংশ না নিলে বা শিবির আখ্যা দিয়ে পেটানো হয়।
২০১৬ সালের ১৭ মার্চ রাতে কলেজের মুসলিম হোস্টেলের নিউ ব্লকে ঢুকে তাঁর সঙ্গে করমর্দন না করার কারণে তিন শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন না্ঈম ও তাঁর বাহিনী। এর মধ্যে মামুন নামের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ ছাত্রলীগের মিছিলে অংশ না নেওয়ায় রাজশাহীর স্থানীয় একটি দৈনিকের সাংবাদিক আব্দুল কাদিরকে ধরে পেটানো হয়। এর কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগের মিছিলের মধ্যে স্লোগান দিতে দেরি হওয়ায় ফিরোজ নামের এক ছাত্রলীগকর্মীকে ধরে পেটান না্ঈম।
রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজশাহী কলেজের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নানা সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে ছাত্রলীগের নাঈম। তার দাপটে যেন সবাই অস্থির। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে সে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। অথচ দেখার কেউ নেই!
২০১৮ সালের ১১জানুয়ারি আমজাদ হোসেন নামে এক যুবককে ধরে নিয়ে যায় ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের অনুসারীরা। এর পর তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। বাড়িতে ফোন দিয়ে দাবি করা হয় চাঁদা। পরে রাতে নগরীর মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে আমজাদকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সোহাগ নামে এক ছাত্রলীগকর্মীকে আটক করা হয়। আহত আমজাদ মোহনপুরের গোছাবাজার গ্রামের তৈয়ব আলীর ছেলে। পড়াশোনা শেষে তিনি নেটওয়ার্ক মার্কেটিংয়ের ব্যবসা করেন।
আমজাদ জানান, তাকে নগরীর সাহেববাজার ডেকে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা নাঈমের নেতৃত্বে রকি, আশরাফুল, শরিফুল, রায়হান ও রতনসহ কয়েকজন কথা আছে বলে রাজশাহী সিটি কলেজের হোস্টেলের দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে তাদের টর্চার সেলে তাকে লাঠি ও লোহার পাইপ দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে তার পরিবারের সদস্যদের ফোন দিয়ে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন নাঈম। প্রথমে বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার এবং পরে আমাকে ফেরতের সময় বাকি টাকা দেওয়ার কথা হয়।
এদিকে এ ঘটনার পর আমজাদের স্ত্রী জেসমিন খাতুন পুলিশে অভিযোগ করেন। এর পর আমজাদের মোবাইলের নম্বর ট্রেস করে তার অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। বিষয়টি বুঝতে পেরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমজাদকে মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় সোহাগ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে আটক করে পুলিশ।
২০১৭ সালের ১১ডিসেম্বর রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করে নাঈম বাহিনীর অন্যতম রাসিক দত্ত ও রতনসহ অন্তত ১০ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। এ হামলায় আহত হন রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল্লাহ মিম, পদ্মা নিউজের সাব এডিটর বাবর মাহমুদ এবং বরেন্দ্র এক্সপ্রেস ডট কমের প্রতিবেদক মোফাজ্জ্বল বিদ্যুৎ।
ছাত্রলীগের একাধিক নেতা ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ রাজিবের চাচাতো ভাই নাঈম।এ কারণে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে নানা অপকর্ম করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। রাজিবের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় নির্বিঘ্নে সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া, নাঈমের গুরু হিসেবে সব ধরনের আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ভাগ্নে। এই ভাগ্নের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন দপ্তরে টেন্ডারবাজি, হিন্দুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র দামে জমি বিক্রিতে বাধ্য করা, দখলবাজি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
তবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাইমুর রহমান নাঈমকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সম্পাদক এস.এম জাকির হোসাইনের সাক্ষরিত প্যাডে তাকে বহিস্কারের কথা জানানো হয়। এর কিছুদিন পরই তার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। কিন্তু এরপরও থামে নি দলের নামে নাঈমের অপকর্ম।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন নাঈম। এতে ছাত্রলীগ ও আওয়াশী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যা সরকারী দলের নানা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তাই নাঈমের ব্যাপারে দলের উচ্চমহলের সিদ্ধান্ত জরুরি।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ রাজিব ও রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিয়ামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা মোবাইল ফোন রিসিভ করেন নি। তবে রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রকি কুমার ঘোষ ইউনিভার্সাল২৪নিউজকে বলেন, ‘আমি সাংগঠনিক কাজে ঢাকায় অবস্থান করছি। নাঈমকে গ্রেফতারের কথা শুনেছি। তবে চাঁদাবাজি ও কোচিং সেন্টার ভাঙচুরের ঘটনা তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হবে। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে ফের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রকি কুমার ঘোষ আরো জানান, এর আগেও নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নাঈমকে কেন্দ্র থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। পরে আবার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়।