কাবুলের নিয়ন্ত্রণ কার কাছে যাচ্ছে?


ইউএনভি ডেস্ক:

বছর কুড়ি আগে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুতিতে কাবুলের নারীরাই খুশি হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। কারণ পাঁচ বছরের তালেবান শাসন তাদের বন্দি করে রেখেছিল অন্তঃপুরে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে পড়েছিল। রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল সব ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ। প্রবেশাধিকার হারিয়েছিলেন আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়ও।

অন্যদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপট কাবুলের নারীদেরই শঙ্কিত করে তুলছে সবচেয়ে বেশি। কারণ দেশটিতে এখন ক্ষীণ হলেও তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আবার পুরনো অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

তালেবানদের কট্টর সমর্থকরাও ভাবতে পারেনি, তারা মার্কিন সেনাদের সঙ্গে দুই দশক লড়াই চালিয়ে টিকে থাকতে পারবে। আবার টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার ধারাবাহিকতায় শুরু হওয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা ও তালেবানদের নির্মূল না করেই আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নেবে, এ কথাও ছিল অনেকের ভাবনার অতীত। ধারণার অতীত এসব ঘটনাই এখন ঘটছে আফগানিস্তানে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, তালেবানরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও এখন আফগানিস্তান ত্যাগ করছে অনেকটা রিক্ত হস্তেই।

যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার দুই দশক পূর্ণ হচ্ছে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর। এ সময়ের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ঘোষণাকে এখন নিজেদের বিজয় হিসেবেই দেখছে তালেবানরা। অন্যদিকে ওয়াশিংটনও ঘোষণা দিয়েছে, গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশটির পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার পরিকল্পনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণায় চোখে অন্ধকার দেখছেন আফগান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, আশরাফ ঘানির সরকারকে বিপদের মুখে অনেকটা একা রেখেই আফগানিস্তান থেকে সরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনদের অনুপস্থিতিতে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা তালেবানদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়াটা আফগান সেনাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা পুরোপুরি দখল করে নেয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়।

এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, তালেবানরা এখন সামরিক বিজয় অর্জন করে নেয়ার বিষয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। আফগান সেনারা এখন পর্যন্ত বড় বড় শহর ও সরকারি ঘাঁটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে তাদের শুধু আত্মরক্ষামূলক অভিযানেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। পুনর্দখলকৃত বিভিন্ন এলাকা ধরে রাখতেই তারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গত বছর বাহিনীটি যেসব এলাকা থেকে সরে এসেছিল, সেসব এলাকায়ও নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে একটি চুক্তি সই হওয়ার পর থেকেই আফগানিস্তানে সহিংস হামলার সংখ্যা বেড়েছে। তালেবানরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছে। আবার জাতীয় পর্যায়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও অস্বীকার করে আসছে তারা। ফলে এ মুহূর্তে তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও যথেষ্ট শঙ্কা ও সন্দেহ রয়েছে।

বিবিসির দুই সাংবাদিক সম্প্রতি তালেবান নিয়ন্ত্রিত বল্খ শহর ঘুরে এসেছেন। মাহফুজ জুবায়েদি ও সেকান্দার কিরমানি নামের ওই দুই সাংবাদিকের বর্ণনায়ও আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সার্বিক চিত্র সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তাদের ভাষ্যমতে, তালেবানরা এরই মধ্যে নিজেদের বিজয়ী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।

ভারি ও মার্কিন সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রে সজ্জিত তালেবানরা ওই দুই সাংবাদিকের কাছে দাবি করে, দীর্ঘদিনের এ যুদ্ধে তালেবানরাই বিজয়ী। পরাজয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

বলেখ আফগান সরকারি বাহিনীর অবস্থান ছিল নগরের মূল বাজারের পাশে। তালেবানদের দাবি, সরকারি সেনারা কখনই নিজ ঘাঁটি এলাকার বাইরে বের হয় না।

অন্যদিকে তালেবানরা বলেখর আশপাশে বেশ কয়েকটি চেক পয়েন্ট বসিয়েছে। এসব চেক পয়েন্টের পাশ দিয়ে চলাচলরত প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করছে তারা। মূলত আফগান সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শনাক্ত করতেই এ ধরনের তল্লাশি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে জানালেন তালেবান গোয়েন্দা সংস্থার স্থানীয় প্রধান। তার ভাষ্যমতে, এমন কাউকে শনাক্ত করা গেলে তাকে আটক করা হয়। তারপর স্থানীয় তালেবান আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

ওই দুই সাংবাদিক বলছেন, এ চিত্র এখন গোটা আফগানিস্তানেরই। সরকারের নিয়ন্ত্রণে শুধু নগরাঞ্চল ও বড় শহরগুলো। অন্যদিকে তাদের ঘিরে রয়েছে তালেবানরা। বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে এখন তাদের কর্তৃত্বই সবচেয়ে বেশি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, তালেবানরা নিজ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোয় এরই মধ্যে এক ধরনের ছায়া সরকার ব্যবস্থা গঠন করে ফেলেছে। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিগ্রস্ততা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে খুব একটা অভিযোগও তুলছেন না স্থানীয়রা। তবে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় এখনো নারী শিক্ষা ও লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ অনেক বেশি। এছাড়া গোঁড়ামি ও কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও নানা ধরনের নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

আফগানিস্তানের আজকের অবস্থার পেছনে বহিঃশক্তিগুলোর দায় কম নয় বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে দেশটিতে আবার অতীতের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছেন তারা। আশির দশক শুরুর ঠিক প্রাক্কালে রুশ আগ্রাসন দেশটিকে ঠেলে দেয় ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে। সে সময় স্নায়ুযুদ্ধের লড়াইয়ের বড় ময়দান হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। দেশটিতে ইসলামী জঙ্গি দল গঠনের মাধ্যমে তত্কালীন সোভিয়েত রাশিয়াকে মোকাবেলার পথ বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এতে সমর্থন দেন পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক। পাকিস্তানে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে কট্টরপন্থী জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

এ জঙ্গিরাই পরবর্তী সময়ে পরিচিত হয় তালেবান নামে। পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে তাদের মহিমান্বিত করে দেখানো হয়। অন্যদিকে তাদের অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ। এরপর এ তালেবান মুজাহিদ ও সোভিয়েতদের লড়াইয়ে মৃত্যু হয় অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের। উদ্বাস্তু হয় ৫০ লাখ মানুষ। এক দশকের লড়াইয়ের পর ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ত্যাগ করে সোভিয়েতরা। সে সময়ও আকস্মিক বিপদে পড়ে গিয়েছিল দেশটির তত্কালীন সরকার। অনেকটা একাই তালেবানদের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। গজিয়ে ওঠে একাধিক পক্ষ। এরপর ১৯৯৬ সালে কাবুলের ক্ষমতা দখল করে নেয় তালেবানরা।

২০১১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনার পর আফগানিস্তানে যুদ্ধে নামে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের সহযোগিতায় তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক দলের সমন্বয়ে গঠিত উত্তরাঞ্চলীয় জোট। এরপর দেশটির সরকারি বাহিনী ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে তালেবানদের লড়াই চলছে দুই দশক ধরে।

মার্কিন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, এ লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত শুধু যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষের। অন্যদিকে এ যুদ্ধ চালাতে গিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির প্রায় সাড়ে সাত গুণ।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের সময়টিকে বলা হয় দেশটির অন্ধকারতম অধ্যায়। ওই সময়ে গোঁড়ামি ও কট্টর পন্থার বলি হতে হয়েছে আফগানদের। দেশটির নারীরাও পিছিয়ে পড়েছিল অনেক। নারী শিক্ষা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নানা বৈষম্য জেঁকে বসেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে সে সময়টারই প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অথচ দেশটির অবস্থা চিরকাল এমন ছিল না। একসময় আফগানিস্তানকে বলা হতো এশিয়ার হূিপণ্ড। পর্যটকদের কাছে গন্তব্য হিসেবেও অন্যতম ঈপ্সনীয় দেশ ছিল আফগানিস্তান। অন্যদিকে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে একের পর এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার দেশটিতে এনে দিয়েছিল আধুনিকতার স্পর্শ। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আধুনিক হয়ে উঠছিল আফগান শহরাঞ্চল। বিশেষ করে রাজধানী কাবুলে এ সমৃদ্ধি চূড়ায় উঠে দাঁড়ায়। শহরটি পরিচিতি পায় ‘মধ্য এশিয়ার প্যারিস’ হিসেবে। অন্যদিকে সামাজিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল অনেক। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনো লিঙ্গবৈষম্যের অস্তিত্ব ছিল না। সামাজিক কাঠামো থেকেও তা একটু একটু করে বিদায় নিচ্ছিল। সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই দাবি করেন, নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকে ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকেও পেছনে ফেলে দিয়েছিল আফগানিস্তান। যদিও রুশ আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটি একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারের দিকে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে রূপ নেয় তালেবান শাসনামলে। বর্তমানে সে পরিস্থিতিরই প্রত্যাবর্তনের শঙ্কা জেঁকে বসেছে দেশটিতে।


শর্টলিংকঃ