- ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ - https://universal24news.com -

কামাল লোহানীর শ্রীচরণে গুরুদক্ষিণা


কামাল লোহানী চলে গেলেন। চলে গেলেন চিরঅসীমের যাত্রাপথে। এমন এক পাষণ্ড সময়ে তিনি বিদায় নিলেন যে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজনটুকুও করা গেলো না। এ বড় নিষ্ঠুর সময়। মহামারী করোনা আমাদের সব স্বাভাবিকতাকে কেড়ে নিয়েছে।

শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতায় হয়তো তাঁকে শেষ বিদায় জানানো গেলো না, কিন্তু তিনি আমাদের অন্তরের পরম শ্রদ্ধায় স্মরিত হবেন চিরকাল। কামাল লোহানীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি। ২০০৩ সাল থেকে। রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সামাজিক সংগ্রাম আর পারিবারিক জীবনের বহু পরতে তিনি আমার অস্তিত্বে মিশে থাকবেন।

স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র মৈত্রীর রাজনীতিতে আমার যোগ। ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুবাদে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও সম্পৃক্ততা হলো। ওই বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে একদিন ওয়ার্কার্স পার্টি অফিসে গিয়েছি। পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তার কক্ষে বসে আছেন। একা। তিনি ডাকলেন আমাকে।

কোনো একদিন তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো, কিন্তু সেও তো কয়েকমাস আগে। কিন্তু যতোদূর বুঝলাম, কমরেড মেননের অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। আমি তখন দলের নিতান্তই সাধারণ এক কর্মি। স্বভাবতই বেশ ভয় ও জড়তা নিয়ে তার কক্ষে ঢুকলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমার সম্পর্কে। জানলেন, আমি সাংবাদিকতার নবীন ছাত্র। তিনি আমাকে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি পার্টি পত্রিকা সাপ্তাহিক নতুন কথায় কাজ করতে নির্দেশ দিলেন।

তিনি আমাকে বুঝে নেওয়ার লক্ষ্যে দুটো ফিচার লেখার অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। এক সপ্তাহ পরে আমি লিখে নিয়ে এসে তাকে দেখালাম। তিনি কাটাছেড়া করে ঠিকটাক করে দিলেন। তারপর বললেন, শনিবার দুপুরে তুমি আবার আসবে। এলাম যথাসময়ে। পার্টি অফিসেরই দুটো ঘরে নতুন কথার কাজ চলতো। তিনি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন সে ঘরে। সফেদ বসনের আপাত-গম্ভীর এক কর্মযোগীর হাতে তিনি আমাকে তুলে দিয়ে বললেন- ছেলেটাকে দিলাম, লেখা শেখান।

সেই সফেদ পুরুষ ছিলেন কামাল লোহানী। পরে ধীরে ধীরে জেনেছি, সফেদ পোশাকের মতোই তাঁর মনন ছিলো আরো ধবধবে সফেদ। নভেম্বর ২০০৩। পরিচয় হলো দেশের নামজাদা সাংবাদিক ও সংস্কৃতিজন কামাল লোহানীর সাথে। প্রথম দিকে বেশ ভয়ে ভয়ে কথা বলতাম। এতো বড় মাপের মানুষ! এতো বিদগ্ধজন! কীভাবে নেবেন আমার মতো এক ছোকরাকে! কাজের সুবাদে যতো তার কাছে যাবার সুযোগ হয়েছে, ততোই জেনেছি, রাশভারী ধরনের মানুষ তিনি নন, বরং অনেক বেশি প্রাণোচ্ছ্বল, অনেক বেশি বন্ধুসুলভ, অভিভাবকসুলভ।

তিনি তখন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। বহু বড় বড় জায়গায় সাংবাদিকতা করে এসে নতুন কথার মতো দীন এক পত্রিকায় মাত্র ছয় হাজার টাকা সম্মানীতে কাজ করার তাঁর কোনো প্রয়োজন ছিলো না। এর চেয়ে বহুগুণ পয়সা তিনি উপার্জন করতে পারতেন করপোরেট গণমাধ্যমগুলোতে গেলে। সে সুযোগের অভাব তাঁর কোনোদিন ছিলো না। কিন্তু রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থান থেকেই তিনি মূলত নতুন কথায় ছিলেন।

নতুন কথার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি রাশেদ খান মেনন, নামকাওয়াস্তে হাজেরা সুলতানা সম্পাদক ও প্রকাশক। আর কিছু তরুণ কাজ করতেন। অকালপ্রয়াত বাবুল আক্তার তখন পত্রিকার ব্যবস্থাপক। বার্তা সম্পাদক মামুন ফরাজী, অন্য দৈনিক পত্রিকায় কাজের পাশাপাশি পার্টি দায়িত্ব হিসেবেই এখানে কাজ করতেন। কম্পিউটার অপারেটর এম এম মিলটন, বর্তমানে তিনি ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে আছেন। আরো কয়েকজন কাজ করতেন। আর দলনেতা কামাল লোহানী।

নতুন কথা বের হয় প্রতি সপ্তাহের রবিবার। তিনি শনিবার আসতেন। একটা আধাভাঙ্গা কাঠের চেয়ারে তিনি বসতেন। লেখাগুলোতে চোখ বুলাতেন, শিরোনাম ঠিক করতেন। তারপর ব্রডশিট কাগজে আট কলাম বানিয়ে একটা ডামি পত্রিকা এঁকে দিতেন। তার ডামি অনুসারেই বাবুল আক্তার পেস্টিং করতেন ট্রেসিং পেপার কেটেকেটে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম মানুষটাকে আর কাজটাকে। আর কেবলই ভাবতাম, এতো বড় একজন মানুষ কেন এই নতুন কথায় পড়ে আছেন!

ওই সময়ে ২০০৫ সালে নতুন কথার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান হলো। সে অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী, রাশেদ খান মেনন প্রমুখের সাথে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন আরেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক আতাউস সামাদ। সে অনুষ্ঠানে নতুন কথার ইতিহাস সম্পর্কে অনেককিছু জানলাম। জানলাম, কমরেড অমল সেনের হাত ধরে ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা এ পত্রিকায় কাজ করেছেন দেশের অনেক নামকরা সাংবাদিক।

কেউ হয়তো বিশ টাকা-পঁচিশ টাকা বেতনেও, কেউ এমনিই। শুভ রহমান, আবেদ খান, মতিউর রহমান চৌধুরীর মতো বিখ্যাত সাংবাদিকরা। এরশাদের আমলে নতুন কথার এক সংবাদের সূত্র ধরে সম্পাদক হাজেরা সুলতানাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে অনেক নির্যাতনও করা হয়েছে। বুঝলাম কোন আদর্শবোধের কারণে কামাল লোহানীর মতো এতো বড় মাপের সাংবাদিক মাত্র ছয় হাজার টাকা পকেট খরচ পেয়েও এখানে কাজ করতে পারেন।

ওই অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধেয় আতাউস সামাদ সংবাদপত্রের আদর্শ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলেন। তিনি এবং কামাল লোহানী দাবি জানালেন রাশেদ খান মেননের কাছে- পত্রিকাটি যেন কষ্ট করে হলেও দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। সে দাবি আরো পনেরো বছরেও আজও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি অনেক সুযোগ তৈরি হওয়া সত্বেও।

এমনকি আজকের দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সামান্য অনলাইন ভার্সনও চালু করা হয়নি কেবল ইচ্ছার অভাবে। বছর আড়াই হতে চললো, নতুন কথার সাথে আমি সম্পর্কহীন, ওয়ার্কার্স পার্টির সাথেও নেই আমি বছর দেড়েক হলো। কিন্তু সব বাদ দিয়েও পত্রিকাটির বর্তমান ব্যবস্থাপক মিলটন ভাইয়ের কাছে অন্তত নতুন কথার খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। জানলাম, এখন এই করোনাকালে এসে পত্রিকাটি এক প্রকার বন্ধই হয়ে রয়েছে।

এর কিছুদিন পরে দেশে চালু হলো এক নতুন দৈনিক পত্রিকা। আমার দেশ। বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর মালিকানায়। জনাব ফালুর তরফ থেকে কামাল লোহানীকে সম্পাদক হতে আহ্বান করা হলো। সরাসরি নাকচ করে দিলেন তিনি। উচ্চ বেতন, গাড়ি আর ফ্ল্যাটের প্রস্তাব দেওয়া হলো। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, আদর্শগত কারণেই সেখানে যোগ দেওয়া তাঁর দ্বারা সম্ভব না। পরে তারা প্রস্তাব দিলেন তিনি যেন অন্তত উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।

লোহানী ভাই তাও প্রত্যাখ্যান করলেন। এরপর প্রস্তাব এলো অন্তত তাঁর নাম প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হবে, তার বিনিময়েও তারা তাকে মোটা অঙ্কের সম্মানি দিতে রাজি। তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন দৃঢ়তার সাথে। শেষ পর্যন্ত আমার দেশ পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় তাঁর কাছে একটা লেখা চাওয়া হয়েছিলো। কামাল লোহানী এমন উচ্চ আদর্শের মানুষ যে ওই পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যা তো দূরের কথা, আমৃত্যু কোনোদিন এক লাইনও লেখা দেননি।

তিনি জামায়াতী পত্রিকা নয়া দিগন্তেও কোনোদিন লেখা দেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল অনেক সাংবাদিক-রাজনীতিক নিয়মিত আমার দেশ ও নয়া দিগন্তে লিখে পয়সা কামিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ঘরানার তো বটেই, এমনকি হায়দার আকবর খান রনোর মতো বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতারাও। আর নতুন কথার অনুষ্ঠানে সংবাদপত্রের আদর্শ নিয়ে কথা বলা শ্রদ্ধেয় আতাউস সামাদ তো হয়ে গেলেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক। কিন্তু কামাল লোহানীকে এসব বিচ্যুতি কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও না। অন্য অনেকের সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের এটা ছিলো বড় পার্থক্য।

লোহানী ভাইয়ের সাংবাদিকতার মূল্যায়ন করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবু খুব কাছ থেকে দেখেছি তাঁর নিজস্ব ধরন। তাঁর লেখার একটা আলাদা স্টাইল ছিলো। গতানুগতিক কাটকাট বাক্যে লিখতেন না তিনি। একটু কাব্যিক ঢঙে আবেগী বাক্যগাঁথায় তিনি লিখতেন। আমরা ছোটরা এ ঢঙের নাম দিয়েছিলাম- ‘লোহানীয় স্টাইল’। আমি কোনো লেখা পড়েই বলে দিতে পারি- এটা লোহানী ভাইয়ের লেখা কিনা।

শিরোনাম নির্ধারণে এতো দারুণ বৈচিত্র্য তিনি আনতে পারতেন, কেবল মুগ্ধ হয়ে পড়তাম আমি। ফখরুদ্দিন সরকারের সময় ঘূর্ণিঝড় সিডরের আক্রমণের পর ত্রাণকাজ ঠিকমতো চালাতে পারেনি ওই সরকার। ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার দুর্গত এলাকায়। এক প্যাকেট ত্রাণ ঘিরে শত বুভুক্ষু হাতের একটা ছবিকে লিড ছবি করে শিরোনাম দিলেন “আজ দিকে দিকে আর্তের হাহাকার হায়রেৃ”। আইয়ুব শাহীর দুঃশাসনের প্রতিবাদে শেখ লুৎফর রহমানের বিখ্যাত গণসঙ্গীত থেকে লাইন উদ্ধৃত করে।

বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান হয়ে ওঠেন দেশের দুর্নীতির প্রধান ভরকেন্দ্র। তখন ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে তার পরিচয় দেওয়া হতো দেশের তারুণ্যের রোলমডেল বলে। কামাল লোহানী নতুন কথায় শিরোনাম করলেন- “তারুণ্যের নয়, দুর্নীতির রোলমডেল”। ফখরুদ্দিন সরকারের সময় তারেক রহমান যখন গ্রেফতার হলেন, তখন তিনি শিরোনাম করলেন- “দুর্নীতির বরপুত্রের পতনের পথে যাত্রা”।

এমনই আরো বহু বৈচিত্র্যময় শিরোনাম ও সংবাদ লেখার কথা স্মরণ করা যায়। সে সময় নতুন কথার লিড আইটেম এবং সম্পাদকীয় লিখতেন মূলত কামাল লোহানী ও রাশেদ খান মেনন। শুরুর দিকে তো আমার লেখা হতোই না। তিনি অ্যাসাইনমেন্ট দিতেন, আমি লিখে আনতাম, তিনি পড়ে ফেলে দিতেন। বলতেন- আবার লেখো। ওনার সামনে বসে আমাকে আবার লিখতে হতো।

কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গিতে এমন সম্মোহনী নির্দেশনা থাকতো যে কখনো আমার লেখা ছিঁড়ে ফেলা কিংবা আবার লেখার নির্দেশ দেওয়ার কারণে মন খারাপ হতো না। আমাকে তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। একটা পর্যায়ে আমার উপর লোহানী ভাই ও মেনন ভাইয়ের নির্ভরতা বাড়তে থাকে। আমার দায়িত্ব ও লেখার চাপও বাড়তে থাকে। মাঝে মাঝে লোহানী ভাই অফিসে আসতে না পারলে ডামি মেকআপের কাজও করা শুরু করলাম। তারপর একসময় বার্তা সম্পাদক মামুন ফরাজী দায়িত্ব ছেড়ে দিলে আপৎকালীন দায়িত্বও আমাকে সামলাতে হয়েছে।

কামাল লোহানী একাধারে গণশিল্পী সংস্থার সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সাংস্কৃতিক গণসংগঠন হিসেবে কাজ করতো গণশিল্পী সংস্থা। লোহানী ভাই এ সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আর তাঁর যে অসাধারণ বক্তৃতা- মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম আমরা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করতেন অনর্গল। অতীত জীবনের সক্রিয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে আমি আর আলোচনা করতে চাই না। সেসব সবাই জানেন এবং তার সমসাময়িক বিদগ্ধজনেরা নিশ্চয়ই লিখবেন।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেলেন তিনি। সেখানে বসেও গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চার বহু সুযোগ তিনি তৈরি করেছেন। ওই সময়ে রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কামাল লোহানী শিল্পকলায় চলে যাওয়ার কারণে নতুন কথা ছাড়লেন। মামুন ফরাজী বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব ছাড়লেন।

সব মিলিয়ে আকষ্মিক আমার উপর নতুন কথার দায়িত্ব এসে পড়লো। এদিকে আমি আবার তখন ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিলাম। আমি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলাম। সে সময়েও আমার ভরসার নাম ছিলেন কামাল লোহানী। কখনও কখনও বাবুল ভাই, মিলটন ভাই ও আমি আবার কখনো আমি একা শিল্পকলা একাডেমিতে চলে যেতাম। পত্রিকা নিয়ে তার পরামর্শ আনতাম। এমনকি সেখানে বসেও তিনি আমাকে শিরোনাম নির্ধারণ-সহ অন্যান্য সহযোগিতা করতেন।

২০১২ সালে আমি যখন দ্বিতীয়বারের মতো ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি নির্বাচিত হই, সে সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন কামাল লোহানী। টিএসসি মিলনায়তনে যে অসাধারণ বক্তৃতা তিনি করেছিলেন, আমার কানে এখনও বাজে।তার কথাগুলোও যদি কেবল অনুসরণ করা যেতো, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বিচ্যুতির কোনো সুযোগ থাকতো না।

ছাত্র মৈত্রীর দায়িত্ব ছাড়ার পরে ২০১৫ সালে আমি নতুন কথার নির্বাহী সম্পাদক হলাম। পত্রিকার ট্রেসিং পেস্টিং বাদ দিয়ে কম্পিউটারে মেকআপ করা শুরু করলাম। সাদাকালো পত্রিকাকে রঙিন করলাম। পত্রিকার আলাদা অফিস হলো।আমি নিশ্চিত জানি, পত্রিকার এ উন্নতিতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন যিনি তিনি কামাল লোহানী। ততোদিনে তিনি আর ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে নেই। বিভিন্ন কারণে পার্টির সাথে তাঁর আদর্শিক দূরত্ব তৈরি হলো।

ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতাসীন জোটের সাথী। এদিকে সাম্প্রদায়িকতার সাথে এ জোটের নানামুখী আপোসের প্রশ্নে কামাল লোহানী কখনোই খুশি ছিলেন না। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালীনও আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এ মানুষটির বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ হয়। ওই সময়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, লোকশিল্প জাদুঘর, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি-সহ এ জাতীয় মননচর্চা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসকল বিশিষ্ট সংস্কৃতিজন ও বুদ্ধিজীবীরা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাদের সবার এক মেয়াদ শেষে চুক্তি নবায়ন হলেও কামাল লোহানীই ছিলেন একমাত্র ব্যতিক্রম যার চুক্তি নবায়ন করে সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দেয়নি। জোট শরিক হিসেবে ওয়ার্কার্স পার্টির অবস্থান এবং পার্টির নেতৃত্বের সাথেও বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ এবং সর্বোপরি একটি লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির গণসংগঠন হিসেবে গণশিল্পী সংস্থার পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে তীব্র মতবিরোধে লোহানী ভাই গণশিল্পী সংস্থা ছেড়ে দেন।

যোগ দিলেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীতে। উদীচী তাঁকে সভাপতি করলো পরপর দুইবার। সমাজের বিদগ্ধ ও গুণীজনের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ওয়ার্কার্স পার্টির তীব্র ঘাটতি আছে। সংগত কারণেই ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে এ স্তরের মানুষের সরাসরি যোগসূত্র বহু বছর ধরেই শূন্যের কাছাকাছি। এমনকি এতো ঘনিষ্ঠতা সত্বেও কমরেড কামাল লোহানীকে ওয়ার্কার্স পার্টি সভ্যপদ দিতে পারেনি। অথচ উপমহাদেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বামপন্থার সাথেই বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিজনদের সম্পৃক্ততা থাকার কথা সবচেয়ে বেশি।

উদীচীতে যোগ দেওয়ার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে সভ্যপদ প্রদান করে সম্মানিত করেছিলো বলে শুনেছি। সারাজীবন ওয়ার্কার্স পার্টি ঘরানার মতাদর্শ ধারণ করে এলেও ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ খ্যাত ফয়েজ আহমেদকেও মৃত্যুর কিছুদিন আগে সিপিবি পার্টি সভ্যপদ প্রদান করে সম্মানিত করে। ওয়ার্কার্স পার্টি কিন্তু তাঁকেও পার্টি সভ্যপদ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিলো। এমনকি কবি-সাংবাদিক শুভ রহমানেরও জীবনের শেষদিকের বহু বছর পার্টি সভ্যপদ ছিলো না।

জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত এমন একজন বুদ্ধিজীবীও বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভ্যপদে নেই। কিন্তু দেড় যুগের অভিজ্ঞতায় আমি ব্যক্তিগতভাবে লোহানী ভাইকে যতোখানি জানি, তাতে সিপিবি’র রাজনীতির সাথে অন্তরঙ্গতার কোনো সুযোগ তার ছিলো না। এসব বিভিন্ন বিষয়ে দুঃখের কথা তিনি আমাকেও বলেছেন। বিশেষ করে কিছু কট্টরপন্থী বাম দলের সাথে সিপিবি’র ঐক্য যে সঠিক পন্থা নয়, এমন কথাও তিনি বলেছেন আমাকে।

২০১৭ সালে রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ পালনের লক্ষ্যে সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলন ইত্যাদি বামপন্থীরা মিলে যখন একটি জাতীয় কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে তার প্রথম একটা-দুটো প্রস্তুতি সভায় যাওয়ার পর বিশুদ্ধতার নামে বামপন্থী সংকীর্ণতার চিত্র দেখে বিরক্ত হয়ে তিনি আর ও মুখো হননি। সে কথা নিজেই আমাকে বলেছেন। তিনি ওই জাতীয় কমিটিতে ওয়ার্কার্স পার্টিকে নেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তার সে প্রস্তাব মানা হয়নি। পরে ওয়ার্কার্স পার্টি পৃথকভাবেই রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ পালন করে।

কামাল লোহানী রাজনৈতিক সংগ্রামকে রাজনীতিকদের নেতৃত্বেই রাখার পক্ষে ছিলেন। অরাজনৈতিক কোনো ব্যক্তির হাতে রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার তিনি ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। যে কারণে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কিংবা রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি, এমনকি সাম্প্রতিককালের তারুণ্যের মহাসংগ্রাম গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বও অরাজনৈতিক লোকজনের হাতে চলে যাওয়ায় তিনি হতাশ ছিলেন।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ছিলেন কামাল লোহানী। কোনোভাবেই শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক এ আপোসের পথে হাঁটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি উদ্যোগী হয়ে অন্যান্যদের সাথে নিয়ে গঠন করলেন ‘বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিট‘। আমি ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি থাকাকালীন ছাত্র মৈত্রীও সংগঠনগতভাবে ওই জাতীয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত ছিলো সক্রিয়ভাবেই।

লোহানী ভাই এমন অনেক বিষয়েই প্রচণ্ডমাত্রায় অসন্তুষ্ট ছিলেন। সেসবের প্রকাশও ঘটিয়েছেন তীব্রভাবে। কখনো বক্তৃতায়, কখনো লেখায়। কিন্তু যখনই তাঁকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করতাম- ভাই, কেমন আছেন? তিনি একটা প্রাণভরা হাসি দিয়ে উত্তর দিতেন- ‘সুখেই আছি’। তাঁর সে সুখ যে কতোখানি বেদনাভরা, তা বুঝতাম ভালোভাবেই। হেফাজতে ইসলামের সাথে আপোস, অপরাপর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোসের রাজনীতিকে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভালোভাবে নেননি। তবে একথা একশোভাগ সত্য যে ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কচ্যুতি ঘটালেও লোহানী ভাইয়ের সাথে এক দিনের জন্যও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সম্পর্কচ্যুত হননি। বরং আমি যতোদূর জানি, সদাসর্বদা নিজের বড় ভাইয়ের মতো করেই কমরেড মেনন তাঁর খবরাখবর রেখেছেন।

বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানবিরোধী সংগ্রামের সকল পর্যায়ে কামাল লোহানী অবদান ছিলো। রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শব্দসৈনিক ছিলেন। যতোদূর জানি, তিনি বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব সামলেছেন। সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকার ওই শব্দসৈনিকদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভাষাসৈনিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে লোহানী ভাইদের দাবি পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ নিয়েই তিনি চলে গেলেন।

ব্যক্তিজীবনে লোহানী ভাই আমাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। আমার স্ত্রী প্রতিভা রায়কেও তিনি প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। একবার তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে লোহানী ভাইকে খাওয়াতে কিছুদিন দেরি হয়ে যায়। লোহানী ভাই আমাকে ফোন করেও বলেছেন- তোমার গিন্নীর রান্না না খেয়ে কিন্তু আমি মরবো না। আমাদের সৌভাগ্য যে তাঁকে আমরা অন্তত একদিন খাওয়াতে পেরেছিলাম। আমার পুত্রসন্তানের জন্ম হলো মার্চ মাসে। তাঁকে জানালাম। তিনি জানতে চাইলেন নাম কী রেখেছি, বললাম- প্রিয়ম শরণ্য। তিনি বললেন, মার্চে তোমার ছেলের জন্ম।

ওর আরেক নাম দিলাম- মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সাথে তাঁর সম্পর্কটি এমনই গভীর ছিলো। প্রিয়ম শরণ্য তথা মুক্তি’র অন্নপ্রাশনে লোহানী ভাইকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। আরো কিছু বিশিষ্টজন আমাদের ছোট্ট ঘরোয়া আয়োজনে নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই- আমাদের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত যে অতিথি ছিলেন, তিনি কামাল লোহানী।

তিনি তাঁর নামকরণ করা শিশুটির অন্নপ্রাশনে এসে আশীর্বাদ করে আমাদের তো বটেই, আমাদের শিশুপুত্রের সারাজীবনের জন্য আশীর্বাদক হয়ে ধন্য করেছেন। লোহানী ভাই জাতীয় পর্যায়ে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক ছিলেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো, আমার গুরুদেবের হাতেই আমার সন্তানের হাতেখড়ি দেবো। আগামী বছরের শুরুতে স্কুলে ভর্তির আগে এ কাজ সম্পাদনের ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আমার সে ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই লোহানী ভাই চলে গেলেন। আমার গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সুযোগও মেলেনি।

এমন অকালে তিনি চলে গেলেন যে শেষ একবার ছুঁয়েও দেখতে পারলাম না। গুরুর শ্রীচরণে একবার মাথা ঠুঁকে প্রণামও করার সুযোগ পেলাম না। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার অনেক উর্ধেও তিনি থাকবেন আমার সারাজীবনের গুরুদেব হয়ে। কমরেড কামাল লোহানী- অমর রইবেন।

লেখক:বাপ্পাদিত্য বসু, প্রাক্তন ছাত্রনেতা; সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ ফর ডেমোক্রেসি এন্ড ডেভেলপমেন্ট।