Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

কোচিং-সৃজনশীল : ঝাঁকিতে ঝুঁকি


মোস্তফা কামাল :

“কোচিং সেন্টারের মালিকরা একে বাণিজ্য না বলে ‘শ্যাডো এডুকেশন’ বা ‘ছায়া শিক্ষা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য পান। বাজার এবং বাস্তবতা দৃষ্টেই এমন ভাবনা বা দাবি তাদের। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই যে দেখতে দেখতে কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে, এ সত্যটা কি আমলে নিচ্ছি আমরা? আমাদের সন্তানরা যত না শিক্ষার্থী, তারচেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী। পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও নানা পরীক্ষা লেগেই থাকছে। এতে তারা শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী হয়ে উঠেছে।…”

  • কোচিং নিয়ে কোর্টকাচারি পর্ব আপাতত শেষ। ভালো রকমের ঝাঁকি গেছে কোচিং সেন্টার ও সংশ্লিষ্টদের ওপর দিয়ে। একদম বন্ধের নির্দেশনা দেননি আদালত। হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত নন, শুধু তারাই ফ্রিল্যান্স হিসেবে কোচিং করাতে পারবেন। তবে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালের নীতিমালা বহাল রাখা হয়েছে।

সেই নীতিমালা অনুসারে দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না। ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ থেকে এমন নির্দেশনা আসে।

 তর্ক-বিতর্ক এবং সিদ্ধান্ত পর্বে বারবার আঙুল যাচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলোর দিকে। প্রমাণ না থাকলেও এসএসসি-এইচএসসিতে প্রশ্নফাঁসে দায়ী করা হয়েছে কোচিং সেন্টারকে। এ দুটি পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকরও হয়েছে। এর ফল কী মিলেছে, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এতে লাভই বা হয়েছে কার? লাভের প্রশ্ন এলে লসের প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু জবাব নেই। 

কোচিং আর কোচিং ব্যবসা নিয়ে কথামালা বিস্তর এবং অনেকদিনের। এর আগে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে সরকারি অনুমোদিত নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরও আগে কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগে মতিঝিল গভমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। দুদকের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ওই নোটিশ দেয় সরকার।

পরে ওই নোটিশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ নিয়ে শিক্ষকরা হাইকোর্টে রিট করেন। এরপর আসে গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই চিঠির কার্যকারিতা চার মাসের জন্য স্থগিতের রুল।

হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করার অনুমতি চেয়ে লিভ টু আপিল করে। পরে আপিল বিভাগ গত বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চেকে মামলার ওপর জারি করা রুল নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। এর দীর্ঘদিন পর চূড়ান্ত শুনানি শেষ করে গত ৭ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়।

তর্ক-বিতর্ক এবং সিদ্ধান্ত পর্বে বারবার আঙুল যাচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলোর দিকে। প্রমাণ না থাকলেও এসএসসি-এইচএসসিতে প্রশ্নফাঁসে দায়ী করা হয়েছে কোচিং সেন্টারকে। এ দুটি পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকরও হয়েছে। এর ফল কী মিলেছে, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এতে লাভই বা হয়েছে কার? লাভের প্রশ্ন এলে লসের প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু জবাব নেই। দেশে দিন দিন পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে প্রশ্নফাঁসের ঘটনাও। এর দায়ে কখনো বহুনির্বাচনী পরীক্ষা তুলে দেয়ার কথা ভাবা হয়। বন্ধ রাখা হয় কোচিং সেন্টার। এর সুফল-কুফল জানা হয় না। এভাবে আরও কত কিছুর দায়ে যদি আরও কত কিছু বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা হয় ঠেকাবে কে?

কোচিং সেন্টারের মালিকরা একে বাণিজ্য না বলে ‘শ্যাডো এডুকেশন’ বা ‘ছায়া শিক্ষা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য পান। বাজার এবং বাস্তবতা দৃষ্টেই এমন ভাবনা বা দাবি তাদের। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই যে দেখতে দেখতে কোচিংনির্ভর হয়ে পড়েছে, এ সত্যটা কি আমলে নিচ্ছি আমরা? আমাদের সন্তানরা যত না শিক্ষার্থী, তারচেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী। পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও নানা পরীক্ষা লেগেই থাকছে। এতে তারা শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি পরীক্ষার্থী হয়ে উঠেছে।

শিক্ষা ব্যবস্থাসহ পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা যেখানে এসে ঠেকেছে সেখানে কোচিং নিষিদ্ধ করে দেয়ার জো আর নেই। নিষিদ্ধ করলে বরং এর প্রতি ঝোঁক আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়াল? উচ্চবিত্তরা ঠিকই বাসায় টিউটর রেখে তাদের সন্তানদের পড়াতে পারবে। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের কি হবে? শিক্ষা কি বড়লোকের বিলাসিতা হয়ে যাবে না? কোথাও কোথাও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১০০ এর উপরে। প্রায় অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল এখনও বোঝেন না। অর্থাৎ অদক্ষ শিক্ষক, বছরে বছরে সিলেবাস বদল, পাঠ্যবই পরীক্ষণসহ নানা আয়োজনে শিক্ষার্থীদের দশা সই।

এ অবস্থা উৎরাতে অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠান পঙ্গপালের মতো। নীতিনির্ধারকরা এগুলো বিবেচনায় না নিয়ে কোচিংয়ের লেজ ধরে টানাটানি করে সমস্যার মাথা হারিয়ে ফেলছেন কি-না ভাবা দরকার। ঘটনা অনেক গড়ালেও, অনেক সর্বনাশ হয়ে গেলেও সৃজনশীল ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনার সময় ফুরিয়ে যায়নি। এ ঝুঁকি থেকে মুক্তি খোঁজা জরুরি।

অস্বীকার বা আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই সৃজনশীল পদ্ধতিটির ধুঁকে ধুঁকে মরার হালতথ্য। দক্ষ শিক্ষকের অভাব ব্যাপক। ক্লাসে পড়ানো, প্রশ্ন তৈরি এবং পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে সৃজনশীল পদ্ধতি। পাকা শিক্ষকের অভাব ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে সৃজনশীল পদ্ধতিটি বোঝার মতো শিক্ষার্থীদের কাছে।

এ দুর্গতি থেকে বাঁচতে তারা কোচিংয়ের পাশাপাশি আত্মসমর্পণ করছে গাইড বইয়ের কাছেও। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু পাঠদান নয়; প্রশ্ন তৈরিও হচ্ছে গাইড বই অনুসরণ করে। নামকরা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত শিক্ষা গাইডও এ ফাঁকে বেশ আকর্ষণীয় শিক্ষার্থীদের কাছে। হাস্যকর বিষয় হচ্ছে : এসব পত্রিকার ভেতরে গাইড আর মূল অংশে লেখা হচ্ছে গাইডের বিরুদ্ধে। ডাবলস্ট্যান্ডার্ডের তাজা উদাহরণ।

গোলমালটা করা হয়েছে শুরুতেই। শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে যেন শিক্ষার্থীদের মুখস্থ বিদ্যার প্রতিফলন না ঘটে, সেই টার্গেটে ২০০৮ সাল থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করে সরকার। শিক্ষকদের উপযুক্ত করে গড়ে না তুলে সৃজনশীল পদ্ধতি আরোপ গোলমালের ডালপালা তাজা করেই চলছে। বলা হয়েছিল সৃজনশীল পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে পরীক্ষায় কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখবে না। এজন্য তাদের অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে ক্লাসে পাঠদানের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে। পরীক্ষার প্রশ্ন হবে সৃজনশীল উত্তর দেয়ার উপযোগী করে। কিন্তু বাস্তবতা ধারে কাছেও নয়।

সূত্র জানায়, সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় মোট শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। অথচ সরকারি হিসাবে পাঁচ লাখ শিক্ষককে সৃজনশীলের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সাড়ে তিন লাখ শিক্ষকের ভেতর থেকে মুখ চেনাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঁচ লাখের সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বড় জোর তাদের ৯ হাজার জনকে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কারো কারো প্রশিক্ষণ তিনদিনের। তাদের ওপর ভর করেই চলছে সৃজলশীল পদ্ধতি। তারাই শিক্ষক, প্রশ্ন প্রণয়নকারী, পরীক্ষক ইত্যাদি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষকদের ৬৫.২০ শতাংশ সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। অবশিষ্ট ৩৪.৮০ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন না। তারওপর গত ক’বছর ধরে বিভিন্ন শ্রেণিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন পাঠ্যবই। কিন্তু ওইসব বিষয়ে শিক্ষক তৈরি করা হয়নি।

তাদের সক্ষম করে গড়ে তুললে পাঠদান, পরীক্ষা, খাতা মূল্যায়নে এতদিনে সাবলীলতা চলে আসতো। তা না হওয়ায় অনুপযুক্ত শিক্ষকরা গোঁজামিলে সব চালিয়ে দিচ্ছেন। আর মিল খুঁজতে শিক্ষার্থীরা নিচ্ছে কোচিং ও গাইডের আশ্রয়। তাদের এ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থা থেকে রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। ছাত্রছাত্রীরা কেন কোচিং করে? অভিভাবকরা কেন তাদের কোচিংয়ে পাঠান?

বিভিন্ন প্রফেশনাল ডিগ্রি, মেডিকেল, বুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি, উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমনের গাইডলাইন পেতে, সরকারি-বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্যও কেন কোচিংয়ে ছুটে যায়? গাইডের পর গাইড কেনে? প্রশ্ন তৈরি, পরিবহন কিংবা বিতরণের মতো জায়গাগুলোতে কোচিং সেন্টারের কোনো ভূমিকা নেই। তাদের হাতে কোনো নাম্বারও নেই। তারপরও কেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা কোচিং সেন্টারে লাইন ধরে? – এসব জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজা দরকার।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(সৌজন্যে-জাগো নিউজ)


Exit mobile version