কোভিট-১৯ ফলপ্রসূভাবে মোকাবিলায় করণীয়


২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের আঁতুড়ঘর চীনের উহান শহরে হলেও, অনেক দেশ প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলো অনুসরণ না করায় বর্তমানে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে। কিউরিঅস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস পরিবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত- আলফা করোনাভাইরাস, বিটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস, ও ডেল্টা করোনাভাইরাস। চীনে ২০০২ সালে আবির্ভূত করোনাভাইরাস, SARS-Cov//সার্স-কোভ এবং ২০১৯ সালে আবির্ভূত SARS-Cov/ সার্স-কোভ-২ (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম-কোভ-২) উভয়েই বিটা করোনাভাইরাসের অন্তর্ভুক্ত।

২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক ভাইরাসের সংক্রমণে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ সালে বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ হচ্ছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর করোনাভাইরাসের ৭ম প্রজাতি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ নামে সুপরিচিত। ‘

করোনাভাইরাস পরিবারের ভাইরাসগুলোর বাহিরের স্পাইক প্রোটিনের আবরণ মুকুটের সদৃশ্য হওয়ায় এর নাম করোনাভাইরাস। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস যা প্রধানত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (অর্থাৎ ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। এই ভাইরাসের কারণে শ্বাসযন্ত্রের মারাত্মক সংক্রমণ হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান লক্ষণগুলো হচ্ছে- জ্বর, শুষ্ক কাশি, শ্বাসকষ্ট ও ক্লান্তি। আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, ও শরীরে ব্যথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসে সমস্যা বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিশাল ঝুঁকি রয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যে কোনো বয়সের লোকই নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।

সিএনএন হেলথ কর্তৃক ৩১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কিছু শিশুসহ ২০-৫০ বছর বয়স্ক অসংখ্য মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে, আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ১২ দিনের মধ্যে প্রায় ৯৭.৫% মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। দ্য জার্নাল এনালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে (রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় পৃথক রাখা) বা সক্রিয় পর্যবেক্ষণ করা উচিত। কারণ আক্রান্ত হওয়া থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সংক্রমণের বিস্তার ঘটাতে পারে। মারাত্মক আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘতর সময় সক্রিয় মনিটর করা প্রয়োজন।

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস তরল পদার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রো-ড্রপলেট(micro-droplets) আকারে বাতাসে ভেসে থাকে। এই মারণ ভাইরাস বাতাস ছাড়াও, প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল, পিজবোর্ড (পুরু ও শক্ত কাগজবিশেষ) সহ অন্যান্য বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে। ফলে ভাইরাসটি বাতাসসহ বাড়ি/ঘর/ শপ/প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত জিনিষপত্র, গণপরিবহনে ব্যবহৃত আসন বা বডি পার্টসের মাধ্যমে দ্রুত বিস্তার করেছে ও করছে। এই ভাইরাস মূলত দুইভাবে, থুতু/হাঁচি/কাশির তরল ড্রপলেট এবং সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হাত।

সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর সরকার তাদের দেশের সাধারণ জনগণকে ‘মাস্ক’ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেছিল। তাঁরা লক্ষণবিহীন (asymptomatic)  অবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে জ্ঞাত ছিলেন না। চীনের কোভিড-১৯ রোগ বিশেষজ্ঞগণের প্রমাণ পেয়েছেন, লক্ষণবিহীন (asymptomatic) আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি না দিলেও, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে যে থুত্রু মাইক্রো-ড্রপলেট বের হয় তা ভাইরাস সংক্রমণ করে। দ্য জার্নাল এনালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস যে কোন ব্যক্তিকে আক্রান্ত করার পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচ দিন সময় লাগে।

সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণবিহীন অবস্থায় (ধংুসঢ়ঃড়সধঃরপ) আক্রান্ত হওয়ার প্রথম পাঁচদিনে প্রতি মিলিলিটার থুতুতে সত্তর লক্ষ কপি ভাইরাস এবং কফেও একইভাবে উচ্চমাত্রায় কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাস বহন করে। সুস্থ ব্যক্তি মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করলে কোভিট-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির ভাইরাস বহনকৃত মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে অনেকাংশে রক্ষা পায়। ঘ৯৫ মাস্ক ভাইরাসের মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে ৯৫% সুরক্ষা করে এবং ঘ৯৯ মাস্ক ভাইরাসের মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে ৯৯% সুরক্ষা করে (সূত্র: রয়টার্স)। এখানে ‘ঘ’ দ্বারা অন্তত ০.৩ মাইক্রোন ব্যাসের ক্ষুদ্র কণা ব্লক করার শতকরা সম্পর্ক বুঝায়। সম্প্রতি ইউএসএ সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) পরামর্শ দিয়েছেন, সার্জিকাল/মেডিক্যাল মাস্ক না পাওয়া গেলে যে কোন কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করার জন্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য ইতোমধ্যে নিম্নোক্ত তিনটি সুপারিশ করেছেন।

১.মানুষের হাতে থাকা করোনাভাইরাস নির্মূল করতে ঘনঘন সাবান বা অন্তত ৬০% অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করা।

২. মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করে শ্বসন স্বাস্থ্যবিধি পালন।

৩. অন্য মানুষ থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) দূরত্ব বজায় রেখে ভাইরাসযুক্ত তরল মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা।

কোভিট-১৯ রোগের কোন মেডিসিন ও ভ্যাকসিন না থাকায় বর্তমানে বিশ্বের বেশ কিছু আক্রান্ত দেশ অতিরিক্ত নন-ফার্মাসিউটিক্যাল কৌশল (যেমন, কোয়ারেন্টাইনে থাকা/রাখা, লকডাউন ইত্যাদি) অনুসরণ করছেন।

ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অগ্রাধিকার দিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সাফল্য পেয়েছে। নিম্নের গ্রাফটি হলো– সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ধরে রাখার মূলনীতি। খাড়াভাবে বৃদ্ধি পাওয়া কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দেখে বোঝা যায়, তা দেশগুলোর বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামর্থ্যকে অতিক্রম করে গেছে। ইতালিতে এই খাড়া বৃদ্ধির সময়কালে গড়ে প্রতিদিন পাঁচ হাজার আক্রান্ত হয়েছে এবং চীনে সবচেয়ে খারাপ দিনে প্রায় ১৪ হাজার আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে এই খাড়া বৃদ্ধির সময়কালে চীন ও ইতালিকে ছাড়িয়ে গেছে। গ্রাফের সমতল ঢাল নির্দেশ করছে একই সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে কিন্তু ধীর গতিতে। তাতে করে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিজেদের ওপর চাপ না নিয়ে এবং সীমিত সরঞ্জামের মাধ্যমে সব রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ হ্রাসকারী/বিচ্ছিন্নকারী পদক্ষেপ নিয়ে সংক্রমণের গতি কমানো যায়। তাতে করে মৃত্যুহার কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, এবং হংকং “ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ” অনুসরণ করে “গতিপথ পাল্টে দেওয়ায়” সফলতা পেয়েছে।

‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ নীতি অনুসরণ করে সবচেয়ে বেশী সফল হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া কারণ হিসেবে ২০১৫ সালের মার্সকরোনাভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো, দ্রুত সক্রিয়ভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় দেশের বিদ্যমান উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নমুনা পরীক্ষার বিবরণী অনুযায়ী হাজার হাজার মানুষের কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের পরীক্ষা করে অনাক্রান্ত মানুষকে আক্রান্ত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা, পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে (সূত্রঃ ইউএসএ সংবাদমাধ্যম টাইম নিউজ পেপার)। বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ডায়াগোনেস্টিক টেস্টের মাধ্যমে আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত করা জরুরী।

সকল ভাইরাসই মানুষকে আক্রান্ত না করা পর্যন্ত জীবনবিহীন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তারা সংস্পর্শ, শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানুষের দেহের প্রোটিন খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং মানুষের কোষগুলিকে আক্রমণ করে। মানুষের দেহে বংশ বিস্তারের পর অন্যদের সংক্রমিত করতে থাকে। মানুষের দেহই কোভিড-১৯ সহ সকল ভাইরাসের খাদ্য তথা বেঁচে থাকার উৎস। ৩১ মার্চ, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম “টাইম” নিউজ পেপারের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/শারীরিক দূরত্বেবা কোয়ারেন্টাইনে রেখে এই বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব। এইভাবে, ভাইরাসের নতুন সংক্রমণ রোধ করলে ভাইরাসটি টিকে থাকার মাধ্যম না পেয়ে খাদ্যাভাবে অনেকাংশে নির্মুল হয়ে যাবে।

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


শর্টলিংকঃ