কোয়ারেন্টাইনে সুস্থ ও সতেজ থাকতে ৬ টি যোগাসন


এম এ আমিন রিংকু:

ঘরবন্দীর দিনগুলোতে আমাদের অনেকেরই অলস সময় কাটছে নানা উৎকণ্ঠায়। আর হুট করে কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা পড়াতে শরীরে বাঁধতে পারে নানা রোগ। এ সময়ে যোগ ব্যায়াম চর্চা করে আমরা পেতে পারি সুস্থ দেহ ও প্রশান্ত মন।

যোগব্যায়াম একটি শাস্ত্রীয় কৌশল, যা পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুনি ঋষিরা তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা এবং দীর্ঘজীবনের জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশল আবিষ্কার বা আয়ত্ত করেন। ওজন কমানো থেকে শুরু করে শক্তিশালী নমনীয় শরীর, উজ্জ্বল ত্বক, শান্ত মন, ভালো স্বাস্থ্য ইত্যাদি যা কিছু আমরা পেতে চাই সব কিছুর চাবি আছে যোগাসনে।

আসুন আজ আমরা যোগব্যায়ামের ছয়টি আসনের সাথে পরিচিত হই, যেগুলো আমাদের দেহমনকে করবে সতেজ ও চনমনে।

পদহস্তাসন

মেরুদণ্ড ও সায়াটিক স্নায়ুর নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়, কোমর, নিতম্ব, পেট, উরুর অংশের মেদ কমে এবং এই সকল অংশের পেশী সবল হয়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে এছাড়াও বহুমূত্র, নিম্ন রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, অজীর্ণ নিরাময় হয়।

পদ্ধতি
প্রথমে দুই পা সোজা করে দাঁড়ান। উভয় পায়ের গোড়ালি ও বুড়ো আঙুল একত্রিত করুন। এবার দুই হাত কানের পাশ ঘেঁষে সোজা মাথার উপর তুলুন। হাতের তালুদ্বয়কে একত্রিত করে, এক হাতের বুড়ো আঙুল অপর হাতের বুড়ো আঙুল দ্বারা জড়িয়ে ধরুন।

এবার কোমর থেকে শরীরের উর্ধাংশ সামনের দিকে বাঁকিয়ে, মাথাকে পায়ের পাতার উপরে নিয়ে আসুন। এই সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, চিবুক যেন বুকের সাথে না লাগে এবং পা দুটো অবশ্যই সোজা রাখতে হবে।

এবার হাত দুটো দুই পায়ের হাঁটুর পাশ দিয়ে প্রসারিত করুন। এরপর কনুই থেকে ভাজ করে হাত দুটিকে পায়ের সাথে যুক্ত করুন। হাতের অগ্রভাগ টেনে এনে আঙুল দ্বারা পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করুন। এই সময় হাতের অগ্রভাগ পায়ের সাথে যুক্ত হয়ে থাকবে।

এবার মাথাকে টান টান করে পায়ের নিচের দিকে প্রসারিত করুন। এই অবস্থায় ১০ সেকেণ্ড শরীর স্থির রেখে অবস্থান করুন। এই সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। ১০ সেকেণ্ড পরে, হাত দুটো মুক্ত করে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ান।

তারপর ১০ সেকেণ্ড শবাসনে বিশ্রাম নিন। এরপর একই ভাবে আরও দুই বার আসনটি করুন।

সতর্কতা
যাঁদের উচ্চ-রক্তচাপ আছে এবং কোমরের বাতে ভুগছেন, তাঁরা এই আসনটি করবেন না।

পদহস্তাসন শিখুন ভিডিওতে

 

অর্ধচন্দ্রাসন

আমরা এখন শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছি এ সময়টাতে অতিরিক্ত মেদ ও চর্বি জমে যাচ্ছে আমাদের শরীরে। এ ধরনের মেদ দূর করা ছাড়াও পিঠে ব্যথা এবং পিঠে অতিরিক্ত চর্বিজনিত সমস্যা মাদানী অর্ধচন্দ্রাসন খুবই উপকারী

প্রথমে তাড়াসনে দাঁড়ান। এ সময় দুই পা একসঙ্গে লেগে থাকবে বা দুই হাত দুই পাশে। দৃষ্টি সামনের দিকে। এভাবে দাঁড়ানোই হলো তাড়াসন।যোগব্যায়ামে দাঁড়ানোর প্রায় সব আসন শুরু হয় এ থেকে। দুই হাত শরীরের দুই পাশ দিয়ে দম নিতে নিতে ওপরে তুলে দুই হাতের তালু পরস্পর একসঙ্গে করুন। এ অবস্থায় নাভির ওপরের অংশ ওপরের দিকে এবং নিচের অংশ নিচের দিকে টানটান করুন।এবার দম নিতে নিতে কোমরের ওপরের অংশ (হাতসহ) যতটুকু সম্ভব পেছনের দিকে নিয়ে যান।নিঃশ্বাস স্বাভাবিক রেখে এ অবস্থায় এক সেকেন্ড থাকুন। এ সময় খেয়াল রাখুন যেন হাঁটু না ভাঙে।দম ছাড়তে ছাড়তে সোজা হয়ে দাঁড়ান। এ সময় আপনার হাত দুটো ওপরে ও তালু পরস্পর লাগানো থাকবে।এবার দুই হাত শরীরের দুই পাশ দিয়ে দম ছাড়তে ছাড়তে শরীরের দুই পাশে আনুন।এবার শবাসনে বিশ্রাম নিন। শরীরটা একেবারে ছেড়ে দিন। ৩০ মিনিট এভাবে থাকুন।

 

তালাসন

হঠযোগের প্রাথমিক আসন তালাসন এক ধরনের স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ। নিয়ম করে তালাসন করলে হাঁটু, গোড়ালি-সহ বিভিন্ন অস্থিসন্ধির নমনীয়তা বাড়ে। শুধু তাই নয়, নিয়মিত তালাসন অভ্যেস করতে পারলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ভাল হয়। দূষণ ও অন্যান্য কারণে যাঁরা অ্যাজমা ও অন্যান্য ফুসফুসের অসুখে ভুগছেন, তাঁরা নিয়ম করে প্রতিদিন তালাসন অভ্যেস করলে সুস্থ থাকবেন।

শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, পশ্চার এবং স্টেডিনেস ঠিক রাখতে তালাসন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। একই সঙ্গে এই আসন সাধারণ জ্বর সর্দি বা শ্বাসকষ্ট থেকে অনেকাংশে রক্ষা করতে পারবে। হজম ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি মেরুদণ্ডের নমনীয়তা ঠিক থাকে এবং ফ্ল্যাট ফুটের সমস্যা অনেকাংশে দূর করা যায় তালাসনের সাহায্যে।

তালগাছের মতো টানটান ও ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আসনটি করা হয় বলে এই আসনের এই রকম নাম।

শিখে নিন তালাসন

মেরুদণ্ড সোজা করে টানটান হয়ে মেঝেতে ম্যাটের ওপর দাঁড়ান। ম্যাট না থাকলে পরিষ্কার মেঝেতে দাঁড়াতে পারেন।

দুই পায়ের মাঝে ৪–৫ ইঞ্চি ফাঁক রাখুন।

দেওয়ালের দিকে সোজা তাকিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে নিতে হাত দু’টি মাথার উপরে তুলুন। দু’হাতের আঙুল ইন্টারলক করুন।

পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে গোড়ালি তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ান।

শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে মনে মনে ১০ থেকে ২০ গুনুন।

হাত নামিয়ে স্বাভাবিক পজিশনে ফিরে আসুন। একই ভাবে ৫–৭ বার অভ্যেস করুন।

শুরুতে অনেকের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াতে অসুবিধে হতে পারে। কিন্তু অভ্যেস করলে ঠিক হয়ে যাবে। যে কোন বয়সে এই আসন শুরু করা যায়। তবে অল্প বয়স থেকে অভ্যাস করলে ভাল হয়।

ভিডিওতে দেখুন তালাসন

 

ভদ্রাসন

এই আসন মূলত মুলাধার চক্র বা রুট চক্রকে সক্রিয় করে। এ আসন উরু, কোমর এবং নিতম্বকে শক্তিশালী করে, পায়ের নমনীয়তা বাড়ায়, মানসিক চাপ কমিয়ে মনোবল বাড়িয়ে দেয়, মানবদেহের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে তোলে, এই আসনে বসে মেডিটেশন করা হয়।

বসার নিয়ম

প্রথমে একটি ম্যাটে দুই পা সোজা করে বসুন। দুই পায়ের পাতা একসাথে থাকবে এবং দুই হাত কোমরের দুইপাশে সমানভাবে ও দুই হাতের তালু মাটিতে থাকবে। পিঠ ও মেরুদণ্ড সোজা করুন। প্রথমে দুই পা একসাথে (পায়ের পাতা জোড়ালাগা অবস্থায়) আপনার শরীরের কাছে নিয়ে আসুন। এবার দুই হাত দিয়ে দুই পায়ের পাতা ধরুন এবং পায়ের গোড়ালি শরীরের সাথে লাগিয়ে মাটিতে রাখুন। দুই উরু কোমর বরাবর খোলা রাখার চেষ্টা করুন। উরু এবং হাঁটু যেন মাটিতে লেগে থাকে। ঘাড় ও মাথা সোজা রাখুন। চোখ খোলা রাখুন। মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে তুলুন। এভাবে বসে থাকুন যতক্ষণ আপনি পারবেন।

সতর্কতা

যারা হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন তারা এই আসন এড়িয়ে চলুন।

ভিডিওতে ভদ্রাসন শিখুন

 

ত্রিকোনাসন

এই আসন কিন্তু আপনাকে এই ধরনের ব্যথা-বেদনা থেকে আরাম দেবে। এই যোগাসন আমাদের হজম ক্ষমতা বাড়ায়, বিশেষ করে যারা কনস্টিপেশনের সমস্যায় ভুগছেন তাঁদের জন্য এই আসন অত্যন্ত উপকারী।

পদ্ধতি

১. প্রথমে সোজা হয়ে দাড়াতে হবে। এরপর পা দুটি ফাঁক করে দাঁড়াতে হবে।
২. এবার হাত দুটি দু পাশে লম্বা করে দিন।
৩. এবার আস্তে আস্তে পাশের দিকে শরীরকে বেঁকিয়ে বাঁ হাত দিয়ে বাঁ পায়ের আঙুলকে স্পর্শ করুন। এবং ডান হাতটি অপরের দিকে একেবারে সোজা করে রাখুন। মাথা আপনার ডান হাতের দিকে থাকবে। পায়ের হাঁটু দুটি ভাঙা চলবে না। এই অবস্থায় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিন। ১০ অবধি গুনে একেবারে দুটি হাতকে না ভেঙে সোজা হয়ে দাঁড়ান।
৪. এবার একই ভাবে ডান হাত দিয়ে ডান পায়ের আঙুল স্পর্শ করুন।
৫. পর পর তিনবার এই আসনটি করুন।
৬. মাইগ্রেন বা লো ব্লাড প্রেসার থাকলে বা কারোর যদি ঘাড়ে বা কোমরে কোনো ব্যথা লেগে থাকে তাহলে সেই অবস্থায় এই আসন না করাই ভালো।

ভিডিওতে ত্রিকোনাসন শিখুন

বৃক্ষাসন

আসন অবস্থায় দেহকে বৃক্ষের মতো দেখায় বলে আসনটির নাম বৃক্ষাসন। এ আসন অভ্যাসে দেহের ভারসাম্য ঠিক থাকে। পায়ের ধমনী, শিরা, পেশী ও স্নায়ু সতেজ ও সক্রিয় থাকে এবং পায়ের, কোমরের ও মেরুদণ্ডের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও উরুর সংযোগস্থলের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। বাতরোগ হতে মুক্ত রাখে এবং পায়ের গঠন দৃঢ় ও সুন্দর হয়।

পদ্ধতি:
প্রথমে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ান। এখন হাত দু’টো নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকের কাছে রাখুন কিংবা নমস্কারের ভঙ্গিমায় রেখে মাথার উপরে তুলুন যেন হাত কানের সঙ্গে লেগে থাকে। এবার ডান পা উঠিয়ে বাঁ পায়ের উরুতে রাখুন। পায়ের পাতার নিচের দিকটা উরুর সঙ্গে লেগে থাকবে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ২০সেঃ থেকে ৩০সেঃ এ অবস্থায় থাকুন।

এরপর ডান পা নামিয়ে একইভাবে বাঁ পা উঠিয়ে আসনটি আবার করুন। এভাবে পা বদল করে করে আসনটি ছ’বার থেকে আটবার অভ্যাস করুন এবং প্রয়োজনমত শবাসনে বিশ্রাম নিন।

ভিডিওতে বৃক্ষাসন শিখুন

 


শর্টলিংকঃ