ক্ষুদে বিজ্ঞানী জাহিদ এখন রিকশা চালান


বিশেষ প্রতিবেদক :

১৯৮০ সালে পুঠিয়া উপজেলায় অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলায় তিনি তৃতীয় ক্ষুদে বিজ্ঞানীর স্থান অর্জন করেন। সেখানে তার প্রজেক্ট ছিল ম্যাজিক লন্ঠন। এটার কাজ অনেকটা সিনেমা স্লাইডের মতো। নির্বাক স্থিরচিত্র দেখানোর মতো। টাকা স্বল্পতার কারণে সেই প্রজেক্ট পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়।

একসময়ের ক্ষুদে বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান

রোববার (০৩ মার্চ) সন্ধ্যায় সাড়ে ৬টা। রাজশাহী নগরীর পিএন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। তার কথা বলার ভঙ্গি, ভাষাশৈলি, শব্দ চয়ন শুনে চায়ের দোকানে থাকা প্রায় সবাই আগ্রহের দৃষ্টিতে দেখছেন।

তবে পরনে কিছুটা অপরিচ্ছন্ন পোশাক। চা খেয়ে উঠে পাশেই রাখা রিকশায় চেপে বসলেন। একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, পেশায় তিনি একজন রিকশা চালক।

নাম জাহিদ হাসান। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে বসবাস করেন। তার এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় মেয়ে বিবাহিত ও ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশুনা করে।

আলাপচারিতায় জানালেন জীবন যুদ্ধের কথা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কেনো আজ তিনি এই পেশায় এসেছেন।

জাহিদ হাসান জানান, ১৯৮২ সালে বানেশ্বর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। বিভিন্ন জটিলতায় আর পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এর আগে ১৯৮০ সালে পুঠিয়া উপজেলায় অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান মেলায় তিনি তৃতীয় ক্ষুদে বিজ্ঞানীর স্থান অর্জন করেন। সেখানে তার প্রজেক্ট ছিল ম্যাজিক লন্ঠন।

এটার কাজ অনেকটা সিনেমা স্লাইডের মতো। নির্বাক স্থিরচিত্র দেখানোর মতো। টাকা স্বল্পতার কারণে সেই প্রজেক্ট পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়।

আক্ষেপের সুরে জাহিদ বলেন, ‘তখন বাবার টাকায় খেতাম-পরতাম। জীবনের মানে বুঝতাম না। চেষ্টা করলেই হয়তো একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু আমি চাইতাম আমি চাকরি করব না, নিজেই কিছু করবো।’

‘আস্তে আস্তে জীবনে বাস্তবতা খুব ভালো ভাবে বুঝতে শিখলাম। তবে যখন সেটা বুঝতে পারলাম তখন আর কিছু করার উপায় নাই’ বলেন তিনি।

জাহিদ হাসান আরও জানান, ১৯৮৩ সাল থেকে তার সংসার জীবন শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় জীবন সংগ্রামও। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় গিয়ে একটি গার্মেন্টেসে কাজ নেন।

২০০০ সালের দিকে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে যান। সেখানে অটোটেম্পু চালাতেন। এরপরে ২০১২ সালে আবার ফিরে যান ঢাকা শহরে। চার বছর অটোরিকশা চালান তিনি। এরপর আবার নিজ শহর রাজশাহীতে এসে রিকশা চালানো শুরু করেন।

জাহিদ হাসান বলেন, খুব ক্লান্ত লাগে। রিকশা চালানো আর সম্ভব হয় না। শীতের সময় প্র্রায়ই ঠান্ডা-জ্বর নিয়ে কাজ করেছি। সামনে গরমের দিন আসছে। গরমে তো আরও বেশি কষ্ট হয়। মাঝে-মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

‘তারপরে পেটের দায়ে কাজ করতে হচ্ছে। তবে বর্তমানে অটোরিকশা আসার ফলে কিছুটা সুবিধা হয়েছে’ বলেন জাহিদ।

তিনি বলেন, বেশি খারাপ লাগে যখন কলেজ-ভার্সিটির ছেলেরা ভাড়ার জন্য বাজে ব্যবহার করে। আমি আশি সালে ম্যাট্রিক পাশ করেছি। অথচ ক্লাস নাইন-টেনে পড়া ছেলেরাও আজে-বাজে গালি দিয়ে কথা বলে। সারাটা জীবন অবহেলায় কেটে গেলো বলে দীর্ঘ্শ্বাস ছাড়েন ভাগ্য বিড়ম্বনায় রিকশাচালক হয়ে ওঠা জাহিদ।

জাহিদের নিজেকে নিয়ে আর ভাবার অবকাশ নেই। এখন নিজের সন্তানদের নিয়ে তার স্বপ্ন। তবে তা নিয়েও শঙ্কার শেষ নেই। বলেন, ‘আমার জীবনের একটাই স্বপ্ন এখন। আমার ছেলেটা ভালো একটা চাকরি করবে।’

‘কিন্তু টাকার অভাবে ছেলেকে ভালোভাবে পড়াশুনা করাতে পারছি না। জানি না আমার স্বপ্নপূরণ করতে পারব কিনা’ তা নিয়ে সংশয়ে তিনি।

ক্ষুদে বিজ্ঞানী জাহিদ এখন রিকশা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করছেন

জাহিদ হাসান বলেন, ‘শহরে এখন রিকশার সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। ফলে আগের চেয়ে ভাড়া কমে গেছে। পরের রিকশায় ভাড়ায় চালায়। ওদিকে মালিকের জামানতের পরিমাণ বাড়তেই আছে। বেঁচে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। নিজের একটা রিকশা থাকলে ভালো ভাবে পরিবারের খরচ বহন করতে পারতাম। কিন্তু সেই সামর্থ্য নেই।’

জাহিদ হাসানের এ জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পুঠিয়ার বানেশ্বর ইউনিয়নের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যতা পাওয়া গেছে। সাবেক ইউপি সদস্য সিরাজুল ইসলাম (৫৯) বলেন, ‘জাহিদ খুব মেধাবী ছিল। ও বয়সে আমার কয়েক বছরের ছোটো। তবে এলাকায় সেসময় খুব নাম-ডাক ছিল।’

তিনি বলেন, সেই সময়ে তার মেধা নিয়ে আমরা কাছাকাছি বয়সী অনেকেই হিংসা করতাম। ভাবতাম জাহিদ এতো ভালো করে, আমরা কেন পারিনা। কিন্তু পরে কীভাবে যে কী হলো, কোনোভাবেই ও (জাহিদ) আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলো না। মাঝে-মধ্যে মোড়ের চায়ের দোকানে ওকে নিয়ে আমরা গল্পও করি।


শর্টলিংকঃ