গত দুদিন আগে রাজশাহী পদ্মায় বরযাত্রীর নৌকাডুবিতে বিয়ের আনন্দ শোকের মাতমে পরিণত হয়েছে। পদ্মার বুকে সলিল সমাধি হয়েছে হাজারও স্বপ্নের। এ পর্যন্ত লাশ মিলেছে ৮ জনের, একের পর এক লাশগুলি ভেসে উঠেছে। বরকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও এখনও নিখোঁজ নাববধু। পদ্মাপাড়ে নিখোঁজ স্বজনদের আহাজারি সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে এ প্রবাসেও ভয়ানক ভাবে আঘাত হেনেছে; ঠিক বুকের মাঝখানে।
সবচাইতে মর্মাহত হয়েছি দুটি লাশের ছবি দেখে। বাবা ও মেয়ে; ডুবে যাওয়ার সময়ও পরম মমতায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন বাবা। মেয়েটির বয়স সাত বছর, আমার বড় মেয়ের সমান। সারারাত ঘুমাতে পারিনি, ঘুমে চোখ ভারী হয়ে আসলেও এক অজানা আতঙ্ক তাড়া করেছে সারারাত; আমার মেয়ে ভালো আছে তো ?
নতুন বছরে প্রথম দু’মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০১০ জন।যাদের মধ্যে নারী, শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ রয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, জানুয়ারি মাসে ৫৩১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৭ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১১৪১ জন। অপরদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে দেশে ৩৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৬৩ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অন্তত ৯৪৮ জন। গত ৬ মার্চ ২০ ঘণ্টায় দেশের ৯ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, কুমিল্লা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও পঞ্চগড় জেলায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহতও হন অনেকে। একটা আতঙ্ক তাড়া করে ফেরে সবসময়; আমার মেয়েরা ঠিকমত বাড়ি পৌঁছেছে তো ?
কোন এক অজানা বিবর্তনে আমাদের চামড়া গন্ডারের চেয়েও মোটা হয়ে গেছে। কেহ হয়তো উপলব্ধি করতে পারছেন আর কেহ হয়তো পারছেন না। সড়কে এতগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে অথচ সকলে নির্বিকার ! আর চুপ না থেকেই বা কি করার আছে ? কাল যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদ জানাবো তার পরেরদিন হয়তো শ্রমিকপক্ষ নামধারী সন্ত্রাসীরা আপনার আমার ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিবে আর হয়ত মহামান্য রাষ্ট্রযন্ত্র নিরবে দেখে যাবেন !
আমি লজ্জিত, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আমার শহর রাজশাহীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ইলিয়াস কাঞ্চনের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। যে লোকটি নিঃস্বার্থ ভাবে বাংলাদেশের সড়ককে নিরাপদ করার জন্য নিরব আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সেই ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে শত শত লোক অকথ্য ভাষার স্লোগান দিচ্ছিলেন। মিছিল দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন দানবের উল্লাস নৃত্য! মহামান্য রাষ্ট্রযন্ত্র ! সড়কের দানবদের এই প্রলয় কান্ড থামানোর জন্য আপনার কি কিছুই করার নেই?
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন জানতে পারলাম দেশে তিন ব্যক্তির দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম দেশে প্রবেশের সময় হয়তো এয়ারপোর্টে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। পরে জনলাম, আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেরাই ফোন করে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন আইইডিসিআরকে; পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে তারা আক্রান্ত।
গত ২১ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্ক্রিনিং শুরু হয়৷ প্রথম দিকে শুধু চীন থেকে আসা যাত্রীদেরই স্ক্রিনিং-এর আওতায় আনা হলেও ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সব যাত্রীকেই স্ক্রিনিং করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ করা হচ্ছে বা হচ্ছিল ? জানা গেছে শাহজালালের তিনটি থার্মাল স্ক্যানার এর মধ্যে দুটিই অকেজো আর যে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কাজ চলছে তাও মেয়াদোত্তীর্ণ৷
যেকোনো সময় অকেজো হয়ে যেতে পারে, আর অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে কখনোই থার্মাল স্ক্যানার ছিল না৷ তাছাড়া দেশের কোনোও স্থলবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার নেই৷ ২১টি নারিকেল গাছ আমরা ১৩ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে পারি আর ১০ লাখ টাকা দামের থার্মাল স্ক্যানার কিনতে পারি না ? অনেকেই হয়তো বলবেন টেন্ডার প্রক্রিয়া, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিভিন্ন কারণে দ্রুত কেনা যাচ্ছে না থার্মাল স্ক্যানার। তাহলে আমার প্রশ্ন বাবারে তোমাদের ‘বাবারা’ যখন অসুস্থ হয় তখন ঘণ্টার মধ্যে কেমন করে সিঙ্গাপুর পৌঁছে যাও?
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য মতে, গত ২১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে আসা মোট চার লাখ ৬৩ হাজার ৭১২ জন ( ৬ মার্চ পর্যন্ত ) যাত্রীকে স্ক্যান করা হয়েছে৷ তাতে তখন পর্যন্ত কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ আজ যে দেশে তিনজন আক্রান্ত পাওয়া গেল তারা নিশ্চয় টুপ করে আকাশ থেকে পড়ে নি। সঠিক পদ্ধতিতে ও প্রযুক্তিতে স্ক্যান করলে হয়তো এয়ারপোর্টে সনাক্ত সম্ভব হত তাদের। মেয়াদোত্তীর্ণ মেশিনে সঠিক ফলাফল দিবে এমন আশা করাটা কত বড় বোকামি সেটা একবারও আমাদের ভাবনায় আসেনি ? আরও সতর্ক হতে পারতাম না আমরা ?
করোনা ভাইরাস নিয়ে আজ প্রথম মিডিয়ায় কথা বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই ‘। আপনি বঙ্গবন্ধুকন্যা, মমতাময়ী রাষ্ট্রনায়ক আপনার উপরে শতভাগ আস্থা আছে আমাদের কিন্তু বিশ্বাস করিনা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্তরের সাধু চোরদের। যারা আমজনতার জীবন-জীবিকা নিয়ে খেলারাম এর মতো খেলে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই। করোনা ভাইরাস নিয়ে তাদের খেলাটা বন্ধ হওয়া জরুরী তা নাহলে খেলার ফাঁকে যে মহামারীটা শুরু হবে তা থামানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
লেখকঃ এম এ আমিন রিংকু, গণমাধ্যম কর্মী।