চল যাই : পর্দায় মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধশিশু ও মুজিব নামের আকাশ


ইউএনভি ডেস্ক:

‘কানবি না শুয়োরের বাচ্চা। চুপ। তুই একটা শুয়োরের বাচ্চা, আমি একটা শুয়োরের বাচ্চা। এই দ্যাশে তোরও জায়গা নাই, আমারও জায়গা নাই।’ এই সংলাপ যে চরিত্রের মুখে শোনা যাচ্ছে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছেন। নাম নিখিল। সনাতন ধর্মের মানুষটা যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দেখলেন, তাঁর কিশোরী প্রেমিকা ধর্ষিতা হয়ে শহীদ হয়েছে। শহীদ হয়েছেন কিশোরীর ভাইও। আর ভাবী ধর্ষিতা হয়ে গর্ভবতী।

চল যাই : পর্দায় মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধশিশু ও মুজিব নামের আকাশ

বীরাঙ্গনা ভাবী ও তাঁর গর্ভের সন্তানকে সবাই দেখছে ঘৃণা আর অসম্মানের চোখে। সেই অসম্মান সইতে না পেরে শিশুপুত্রকে ফেলে বীরাঙ্গনা গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরলেন। কিন্তু হায়! মৃত্যুর পরে ‘পাকিস্তানের এঁটো’ ‘আত্মহত্যাকারী’কে কেউ কবর দিতে এগিয়ে এলো না। অগত্যা হিন্দু নিখিল মুসলিম নারীটির কবর খুঁড়ছেন। তখন তুমুল বৃষ্টিপাত। অবিরাম বৃষ্টির শব্দের সাথে একটানা কেঁদে চলেছে সদ্যমৃত বীরাঙ্গনার প্রসবকৃত ‘যুদ্ধশিশু’। বুকের ভেতর পাষাণ চেপে রাখা নিখিল তখন শিশুটিকে বলছে, ‘চুপ। কানবি না শুয়োরের বাচ্চা। এই দ্যাশে তোরও জায়গা নাই, আমারও জায়গা নাই।’

কী সহজে, কত সংক্ষেপে বলা হলো দীর্ঘ করুণ এক বাস্তবতা! এই বাস্তবতা একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের। যেখানে বীরাঙ্গনারা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন। যেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে ভুগছেন এক অদ্ভুত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে।

আরোও পড়ুন:কারিনার কাজকে নিয়মিত অনুসরণ করি :সারা

সংগ্রামের ৭১, যুদ্ধপরবর্তী বাংলা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নির্মিত সিনেমাটির নাম ‘চল যাই’। নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি উক্তিকে উপজীব্য করে। কী সেই উক্তি? তার আগে বলি, দেশে তখন তুমুল আলোচনা, কী হবে ‘যুদ্ধশিশু’দের পরিচয়? ওদের শরীরে তো নাপাক পাকিস্তানিদের রক্ত বইছে। ছিঃ ছিঃ! আমরা এই ‘আবর্জনা লইয়া কী করিব’? চারিদিকে যখন এই ঘৃণা আর অকৃতজ্ঞের গুঞ্জন, তখন এক মানবিককণ্ঠ বেজে ওঠে। ঝংকার তুলে বলেছিল, ‘বলে দাও ওদের পিতার নাম শেখ মুজিব, বাড়ির ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২।’ এই যে মানবিকতা, উদারতা, এই-ই তো জাতির জনকের ট্রেডমার্ক। যাদের মায়ের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, তারা আমাদের পর কেন হবে? তারা কেন হবে জারজ? তারা আমাদেরই ভাই, আমাদেরই রক্ত। এই মহান দীক্ষা ও স্বীকৃতি দিয়ে ‘যুদ্ধশিশুদের’ পরিচয় নিশ্চিত করলেন জাতির পিতা। কিন্তু স্বাধীনতার এতোদিন পর, তরুণ প্রজন্ম কীভাবে দেখছে সেই যুদ্ধশিশুদের? তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় স্বাধীনতার রঙটা কী? সেটা বুঝতে হলে দেখতে হবে ‘চল যাই’।

পরিচালক মাসুমা রহমান তানি একদল তরুণের ঢাকা থেকে টুংগীপাড়ায় যাত্রার ভেতর দিয়ে ‘চল যাই’-এর গল্প বলেছেন। উঠে এসেছে যুদ্ধ, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের চিত্র। সেই চিত্রে তুলি বুলিয়েছেন আমেরিকা থেকে আসা এক যুবক। যিনি শুধু শিকড়ের টানে এদেশে ফিরে ফিরে আসেন। আর জিয়ারত করতে যান শেখ মুজিবের মাজার। বস্তুত তারই বয়ানে আমরা তথা তরুণ দলটি শুনতে পায় একাত্তরের ইতিহাস। নিরস্ত্র বাংগালির যুদ্ধদিনের কথা, স্বাধীন পতাকা আর পতাকা লাভের পরবর্তী যত কথা। তারপর শেষ দৃশ্যে এসে তরুণদল তথা আমরা জানতে পারি, আমেরিকা ফেরত এই মানুষটিই সেই যুদ্ধশিশু, যার মা গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরেছিলেন। যার মায়ের কবর খুঁড়তে খুঁড়তে মুক্তিযোদ্ধা নিখিল বুকভরা বেদনায় বলেছিলেন, তুই একটা শুয়োরের বাচ্চা, আমি একটা শুয়োরের বাচ্চা। এই দেশে তোরও জায়গা নাই, আমারও জায়গা নাই।

আসলেই কি তাই? আপনি কোন চোখে দেখবেন একজন যুদ্ধশিশুকে? কতখানি অনুভব করেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্যাক্রিফাইস? কীভাবে মাপেন বটবৃক্ষ শেখ মুজিবকে? এসবই বলে গেলেন মাসুমা তানি। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘চল যাই’তে। তার এ প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু কতটা স্বার্থকভাবে তিনি তা করলেন? সেটাও বিবেচ্য।

আমার মনে হয়েছে, প্রথম চলচ্চিত্রে তানির সফলতা, ব্যর্থতা সমানুপাতিক। তিনি দর্শককে তাঁর বক্তব্য প্রায়শই দুগ্ধপোষ্য শিশু কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মতো মুখে তুলে খাওয়াতে চেয়েছেন। তা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় অনেক সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সিনেমার শুরুর দিকে (অভিনেতা মিলনের পর্দায় আবির্ভাবের আগে) বাহুল্য সংলাপ আমাকে বিরক্ত করেছে। কিন্তু এই বিরক্তি এবং ক্লান্তি সিনেমার প্রথমার্ধের পর দারুণভাবে পুশিয়ে গেছে। বিশেষত ‘যুদ্ধপর্বের’ চিত্রায়ন, লোকেশন ও নির্মাণ ছিল নান্দনিক। বেশ পরিপাটি আর যত্নের ছাপ ছিল কাজে। খুব সহজ আর সাদামাটা গল্পও দারুণ সিনেমাটিক হয়ে উঠেছে এই অংশে।

এই পর্বে মুক্তিযোদ্ধা নিখিল ওরফে তূর্যর সরল-সাবলিল অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি অভিনয়ে নিয়মিত হলে রাজত্ব করার যোগ্যতা রাখেন, আমি তা লিখে দিচ্ছি। তাঁর কিশোরী প্রেমিকার চরিত্র অভিনয় করেছে আয়াত। তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আমার ছোটসিনেমা ‘গরল-অমৃত’তে (খড়াব ধৎড়ঁহফ ঁং) অভিনয় করেছিল। অভিনয় ছিল তার প্রেম। বড় অভিনেত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। তার প্রমাণ তিনি ‘চল যাই’তে রেখে গেছেন। কিন্তু আফসোস, ছাপ রেখে তিনি চলেই গেছেন। না ফেরার দেশে। ‘চল যাই’ রিজিলের কিছু দিন আগে। পর্দায় আমি যতবার আয়াতকে দেখেছি ততোবার আমার মনখারাপ হয়েছে।

সে যত ভালো অভিনয় করেছে, ততোবেশি বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে মন। তরুণদলের ভেতর সাব্বির হাসান লিখনের অভিনয় ছিল ন্যাচারাল। বাকিরাও যদি আরেকটু ন্যাচারাল হতেন সিনেমাটা বিশেষ মাত্রা পেতো। আনিসুর রহমান মিলন যে মাপের অভিনেতা, তাকে প্রোপারলি ইউজ করা হয়নি। তবে বীরাঙ্গনা চরিত্রে লুসি তৃপ্তি গোমেজের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। অভিনয় নিয়ে আর নয়, কিন্তু একজনের অভিনয় বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। গ্যারেজবয় চরিত্রে সীমান্ত। মাত্র একটা দৃশ্যে তাকে দেখা গেছে। কিন্তু হল থেকে বের হওয়ার পরেও তিনি মনে রয়ে গেছেন।

সিনেমায় কতগুলো শ্রুতিমধুর গান ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর ভেতর বিশেষভাবে কানে লেগে আছে ‘নীল ইমারত’ গানটি। কিন্তু ছবির রঙ ও শব্দবিন্যাস নিয়ে অযথা শব্দব্যয় করতে চাচ্ছি না। আশা করি তানি তাঁর পরের সিনেমায় এসব দুর্বলতা দূর করতে মনোযোগী হবেন। তবে দিনশেষে ‘চল যাই’ এমন এক সিনেমা যাকে শুধুই শক্তি ও দুর্বলতা কিংবা সাফল্য ও ব্যর্থতার নিক্তিতে মাপলে চলে না। কেননা, সিনেমাটি যারা দেখবেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ, বীরাঙ্গনা, যুদ্ধশিশু ও এ দেশের পতাকাকে নতুন করে দেখার সুযোগ পাবেন। মুখোমুখি হবেন মুজিব নামের এক মহান আকাশের।


শর্টলিংকঃ