চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘অসময়ের তরকারি’ কুমড়াবড়ি


চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন চলছে কুমড়াবড়ি তৈরির মৌসুম। পৌর এলাকার তহাবাজারের চালকুমড়া বাজারে লেগে থাকছে ক্রেতাদের ভিড়। অন্যদিকে রিকশাভ্যানে করে পাড়া-মহল্লায় চলছে বড় বড় চালকুমড়া বিক্রি। গত বছরের তুলনায় এবার দামও কম। এতে গৃহিণীরা খুশি হলেও ব্যবসায়ীদের মন খারাপ।

সরেজমিনে মহানন্দা নদীর তীরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার তহাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর চালকুমড়ার আমদানি এবং ক্রেতাদের আনাগোনা। সেদিন সকালে মেঘলা আকাশ থাকায় অন্য দিনের তুলনায় ক্রেতাদের ভিড় কম বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ক্রেতাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাও প্রচুর।

এ সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার নামোনিমগাছি মহল্লার আনোয়ারা বেগম ও সানোয়ারা বেগম নামের ২ বোনকে দেখা গেল ১০টি কুমড়া কিনতে। তাঁরা জানান, গত বছর দাম বেশি থাকায় চারটা কিনেছিলেন। এবার কিনেছেন ১০টি। গতবার যে কুমড়া কিনেছিলেন ২০০ টাকায়, এবার কিনলেন ৫০ টাকায়। এ জন্য তাঁরা দারুণ খুশি। এবার বেশি করে কুমড়াবড়ি বানাতে পারবেন। বিলি করবেন আত্মীয়স্বজনের মধ্যে।

সানোয়ারা বেগম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কুমড়াবড়ি পছন্দ করে না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। কুমড়াবড়ি হচ্ছে অসময়ের বন্ধুর মতো। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, দেখা গেল, বাড়িতে হঠাৎ কোনো কুটুম এসেছে। কিন্তু বাড়িতে কোনো ভালো তরকারি নেই। তখন কুমড়াবড়িই ভরসা। বেগুনের সঙ্গে কুমড়াবড়ি বা শুধু কুমড়াবড়ি রান্না করে দিলে কুটুম বেজার তো হবেনই না, বরং পছন্দের শৌখিন তরকারি পেয়ে খুশিতে আটখানা হবেন। গৃহস্থেরও মুখরক্ষা হবে। এ জন্য চাঁপাইয়ের লোকজন, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের কাছে কুমড়াবড়ি অসময়ের বন্ধুই।

বাজারে আসা বীণাপাণি চৌধুরীও জানান, এবার চালকুমড়া তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় বেশি করে কিনবেন বলে ভাবছেন।

কথা হয় চালকুমড়া ব্যবসায়ী রাজিব আহমেদ, মাসুদুল হক, আড়তদার খোকা মিয়া ও আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, স্থানীয় চালকুমড়া দিয়ে এ বাজারের চাহিদা মেটে না। তাই রাজশাহী, নাটোর, এমনকি বগুড়া ও খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন ভোরে কমপক্ষে দুই হাজার চালকুমড়া আসে এ বাজারে। গতবারের তুলনায় এবার রীতিমতো পানির দামে কুমড়া বিক্রি হচ্ছে। গতবারের চার ভাগের এক ভাগ দাম এবার। বেশি কিনলে এর কমেও চালকুমড়া বিক্রি করছেন তাঁরা।

চালকুমড়ার কম দামের ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকবার দাম ভালো থাকায় এবার অনেকেই বাড়িতেও কুমড়া চাষ করেছেন। জালিকুমড়ার মৌসুমে এ ফসলের ব্যাপক দরপতন হয়। ১৫–২০ টাকার কুমড়া তখন বিক্রি হয় ৪–৫ টাকায়। এ জন্য অনেক চাষিই জালিকুমড়া বিক্রি না করে গাছেই রেখে দিয়েছিলেন। ফলে বাজারে প্রচুর চালকুমড়া নেমেছে। দামও কমে গেছে।

কুমড়াবড়ি তৈরির প্রক্রিয়া: প্রথমে মাষকলাই পানির ভেতর দিয়ে তিন–চার ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর পানি থেকে তুলে চট দিয়ে তা ভালোভাবে কচলাতে হয়। এতে মাষকলাইয়ের ওপরের কালো আবরণ উঠে যাবে। পরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে তা কড়া রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করা হয়। তবে গুঁড়া যেন খুব মিহি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এরপর পাকা চালকুমড়া লম্বা দিকে মাঝামাঝি করে কেটে তা কুরানি (বড়ির জন্য চালকুমড়ার শাঁস ওঠাতে কাঁসার তৈরি বিশেষ ধরনের কুরানি) দিয়ে কুরে ধুয়ে বিচি আলাদা করে নিতে হবে। শুকানো কলাইয়ের গুঁড়া ও কুরানো কুমড়ো একটি পাতিলে মিশিয়ে দীর্ঘক্ষণ নাড়াচাড়া করতে হয়।

মিশ্রণ ঠিকভাবে হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য নারীরা মাঝেমধ্যে ওই মিশ্রণ বড়ির আকৃতি করে পানির পাত্রে ছেড়ে দেন। তখন এই মিশ্রণ যদি ডুবে যায়, তবে আরও মাখাতে হয়। একসময় মিশ্রণের বড়ি পানিতে যখন আংশিক ভেসে থাকবে, তখন বোঝা যাবে যে বড়ি তৈরি উপযোগী হয়েছে। এরপর মশারি কিংবা প্লাস্টিকের জাল দড়ির খাটের ওপর বেঁধে ওই মিশ্রণ বড়ি আকৃতি করে লাইন করে বসিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক দিন কড়া রোদে শুকালে এ বড়ি সারা বছর ঘরে রেখে খাওয়া যায়।


শর্টলিংকঃ