চাই পুরুষের অধিকার


ইউএনভি ডেস্ক:

প্রশ্ন করা যেতে পারে- আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কেনো নেই? এটা কি একচোখা আচরণ নয়? সব দেখেশুনে মনে হয়, এ দুনিয়ায় শুধু মেয়েদের ‘মানুষ’ হলেই চলে, তাদেরই শুধু নিরাপত্তা প্রয়োজন, তারাই যতো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করবে। পক্ষান্তরে ছেলেদের সেগুলোর প্রয়োজন নেই।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আপনি যদি দুজনের মধ্যে একজন যে অধিক যোগ্য তাকে তার মূল্য না দিয়ে অযোগ্যকে অধিক মূল্য দেন, তাহলে যোগ্য ব্যক্তির ক্ষোভ ও হিংসা অযোগ্য ব্যক্তির উপর পড়বে এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কোনো না কোনোভাবে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। নারীর উপর পুরুষজাতির ক্রমশ জমে থাকা ক্ষোভ এখন সমাজে ‘পুরুষের অধিকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে উসকে দিচ্ছে।

মহিলাদের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে ১৮৭২ সাল থেকে ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯১২ সালে ভোট দানের অধিকারে প্রকাশ্যে তারা মিছিল করে নিউইয়র্কে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সালে নারী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মর্যাদা থেকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সব কাজে প্রথম শ্রেণির দাবি করে পশ্চিমের শিল্পাঞ্চলের দেশগুলোতে আন্দোলন শুরু করে। এটা ছিল দ্বিতীয় দফার নারীবাদী আন্দোলন। যাকে বলা হয় দি উইমেন লিবারেশন মুভমেন্ট- সংক্ষেপে ডব্লিউএলএম। এই আন্দোলন সারা পৃথিবীতে বিস্তর প্রভাব ফেলে। মেয়েরা ছেলেদের মতো সকল বিষয়ে সমান অধিকার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চায়।

এই সময় থেকেই লক্ষ্য করা যায়- মহিলারা পুরুষের মতো সব কাজে যেতে চায় না। তারা নির্বাচিত কতগুলো কাজে পুরুষের পাশে থাকতে চায়। যে সব কাজে জীবনের ঝুঁকি সেসব ক্ষেত্রে তারা থাকতে চায় না। এখান থেকেই পুরুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বের শুরু। পুরুষের মনে হলো, মহিলারা পুরুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। পুরুষের সঙ্গে কাজে সমতুল্য নয় অথচ সমতুল্যের দাবি করছে। ফলে সমাজ দুই ভাগ হয়ে গেলো ১৯৭০ সালে। এক ভাগ নারীবাদকে প্রশ্রয় দিলো। অন্য ভাগ নারীবাদের বিরুদ্ধে চলে গেলো।

স্বাভাবিকভাবে কোনো এক গোষ্ঠীর যদি কিছুসংখ্যক মানুষ জোট বেঁধে আলাদা বিশেষ সুযোগ সংরক্ষণের দাবি তোলে, তাহলে গোষ্ঠী দুই ভাগ হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়। শুরু হয় শত্রুতা। সারা বিশ্বে পুরুষের শত্রু হয়ে দাঁড়াল নারীবাদ। দেখা গেলো, নারীরা তাদের প্রচার ও একপেশে দাবি দাওয়া নিয়ে পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এমনকি তারা কোথাও পুরুষের অধিকারও ছিনিয়ে নিয়েছে। পুরুষকে বঞ্চিত করেছে। মহিলারা আইনকে তাদের দিকে একপক্ষ বিচার বানাতে পেরেছে। তারা সমাজকে বোঝাতে পেরেছে- তারা যা বলে তাই বিশ্বাসযোগ্য।

গবেষকরা বলেন, পুরুষের আত্মহত্যার হার বিয়ের পর, মানে মেয়েদের সঙ্গে তার জীবন শুরু হলে দ্বিগুণের বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আত্মহত্যার নিরিখে ৪২ জন মহিলা হলে ৯০ জন হয় পুরুষ। এছাড়া পুরুষ যাবে কোথায়? পুরুষ কথা বললে বাঁচাল, হ্যাংলা। না বললে আত্মম্ভরী, কার্টেসি জানে না। ঘরে থাকলে মেনিমুখো, ঘরকুণো। না থাকলে বাউণ্ডুলে, উড়নচণ্ডী। বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, ৪৫ এর আগে পুরুষ বেশি মরে। অধিকাংশই মরে পরিবারে তার স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তির কারণে।

অথচ পুরুষদের অধিকারের কথা বললেই নারীবাদীরা লাফ দিয়ে ওঠেন। মানে নারীদের অধিকারের কথা বলে পুরুষদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা দেন। পুরুষদের উপর সব দোষ চাপানোর ক্ষেত্রে সব নারী ঐক্যবদ্ধ। নারীদের অধিকারের কথা বলার লাখো পুরুষ মানুষ রয়েছে। পুরুষদের অধিকারের কথা বলার, পুরুষ নির্যাতনের কথা বলার নারী একজনও পাবেন না। কোনো পুরুষ নির্যাতিত হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই দোষের ভাগ নির্যাতিত পুরুষের কাঁধেই ফেলা হয়। নারীরা যেনো খারাপ হতেই পারে না। সকল সমস্যার জন্য সব সময় পুরুষদের দায়ী করা যেনো একটা সামাজিক ব্যাধি।

বাংলাদেশে অনেকগুলো আইনি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি হয়েছে শুধু নারীর জন্য। ধর্ষণের মামলায় নারীর পক্ষে শক্ত আইন থাকলেও মিথ্যে নারী নির্যাতনের মামলায় ফেঁসে যাওয়া পুরুষের পক্ষে শক্ত কথা বলার কেউ নেই। নারীর দ্বারা নিপীড়নের শিকার হলে আলাদা করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কেম। পুরুষের মানবাধিকার দেখার কেউ নেই। তাই হয়তো দরকার, পুরুষের আইন সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী এনজিও সংগঠন। যারা পুরুষের আইনি জায়গাগুলোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, পুরুষের অধিকার পেতে চাওয়া মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ চান কোনো ছাড় নয়, একদম নিত্তির মাপে সমান অধিকার হতে হবে। আরেক দল সরাসরি আগে থেকেই নারী বিদ্বেষী। আরেক দল ‘পুরুষ তাদের মতো থাকুক, নারী থাকুক তার মতো’ এই মনোভাবে বিশ্বাসী। গবেষকদের মতে, পুরুষের সুরক্ষার জন্য কিছু বিষয় জরুরি। এক, পুরুষের স্বাধীনতা লিঙ্গ বৈষম্য থেকে। তাই পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য, পুরুষ জাত সম্প্রদায় সবখানে সমমান। পুরুষও যৌনতা হয়রানিমুক্ত নয়।

নারীর সম্মতি ও প্রশ্রয় ব্যাতিরেকে পুরুষ সন্ত্রাসী, মাদকাসক্ত বা খারাপ হতে পারে না। দুই, পরিবারের একমাত্র রোজগার করার দায়িত্ব পুরুষের উপর থেকে সরানো। তিন, পুরুষের আবেগকে মানুষের মতো দুঃখ ও সুখের প্রকাশ বলে গ্রহণ। যেমন, বলা হয় পুরুষ মানুষের কান্না শোভা পায় না। ওটা কাপুরুষের কাজ। চার, পুরুষের পুরুষত্ব যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মোকাবিলা করার জন্য সুরক্ষা। পাঁচ, বিবাহের যৌতুক না নিলেও বিচ্ছেদের সময় খোরপোষ দাবি করে বৈষম্য থেকে মুক্তি। ছয়, সন্তানের কাস্টডিয়ান। সাত, নারীবাদী চিন্তা ধারণার ভুল ভাঙাতে লিঙ্গ বৈষম্যহীন বিচার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ইত্যাদি।

নারী বাড়ি চান? ক্ষমতা চান? সন্মান চান? অধিকার চান? পুরুষ সব দিতে ইচ্ছুক। আজীবন ভার বহন করতেও ইচ্ছুক। বিনিময়ে শুধু একটু নির্ভেজাল ভালোবাসা চায় পুরুষ। নিঃশর্ত, শাড়ি-গাড়ি-চুড়ির দাবিহীন ভালোবাসা। স্বামী বিবেকানন্দ যথার্থই বলেছেন: ‘ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়’।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


শর্টলিংকঃ