চীনের টিকা ট্রায়ালে প্রস্তুত ঢাকার সাত হাসপাতাল


ইউএনভি ডেস্ক:

চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনা প্রতিরোধী টিকা বাংলাদেশে ট্রায়ালের জোরালো প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে রাজধানীর সাতটি হাসপাতাল প্রস্তুতের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। একই সঙ্গে এ টিকার ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও প্রস্তুত করা হচ্ছে।

ট্রায়ালের নেতৃত্বে থাকা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ও চীনের প্রতিনিধি দলের পরামর্শ মেনে সবকিছু করা হচ্ছে। টিকার ট্রায়ালের জন্য হাসপাতালের আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে। চীনের টিকা দেশে পৌঁছালেই ট্রায়াল শুরু হবে।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসেই চীনা টিকার ট্রায়াল শুরু করা যাবে। এদিকে ভারতের বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে তাদের টিকার ট্রায়ালে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ লক্ষ্যে ভারতের হাইকমিশনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ কিংবা কোন প্রক্রিয়ায় সেই টিকার ট্রায়াল হবে, তা এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। টিকার বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে সরকারের। রাশিয়াও টিকা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, টিকা নিয়ে ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। দুটি দেশই বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সহায়তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। যেসব দেশ নিজেরা টিকা উদ্ভাবন করতে পারবে না, তাদের অন্য দেশ থেকে টিকা কিনতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিকভাবে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে এসব দেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারবে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের পাশাপাশি কোভ্যাক্সের মাধ্যমে টিকা পাওয়ার প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৮ জুলাই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) চীনা টিকার ট্রায়ালের জন্য আইসিডিডিআর,বিকে অনুমোদন দেয়। এরপর সরকারিভাবে ২৭ আগস্ট এই টিকা ট্রায়ালের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যায়। ওই দিনই চীনের টিকা ট্রায়ালের জন্য দেশে আনার অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। চীনের টিকা পৌঁছানোর পর চলতি মাসেই এ ট্রায়াল শুরু হতে পারে। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-২, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে চীনা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে।

ট্রায়ালের নেতৃত্বে থাকা আইসিডিডিআর,বির একটি প্রতিনিধি দল ইতোমধ্যে সংশ্নিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। বিশেষ করে টিকা ট্রায়ালের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এই সাত হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী মিলে চার হাজার ২শ’র বেশি ব্যক্তির ওপর টিকার ট্রায়াল হবে। এজন্য প্রায় আড়াইশ’ গবেষক ও মাঠকর্মী নিয়োগ করে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলছে।

চীনের টিকা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক ও আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে ট্রায়ালের বিষয়ে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ট্রায়ালে টিকা নিরাপদ ও কার্যকর প্রমাণিত হলে সিনোভ্যাক এক লাখ ১০ হাজার ডোজ বাংলাদেশকে বিনামূল্যে দেবে। একই সঙ্গে টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তিও বাংলাদেশকে সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। যাতে চীনা টিকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশেও এর উৎপাদন করা সম্ভব হয়।

চীনা টিকা ট্রায়ালের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. কে জামান। তিনি সমকালকে বলেন, চীনা টিকা ট্রায়ালের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন টিকার জন্য অপেক্ষা করছি। চলতি মাসেই টিকা আসার কথা রয়েছে। টিকা আসার পরপরই ট্রায়াল শুরু করা যাবে।

ড. কে জামান আরও বলেন, সিনোভ্যাক কোম্পানির টিকাটি প্রথম দুই ধাপে প্রাণীদেহে প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে সফলতা পাওয়া গেছে। এরপর ফেইস-১-এ ১৪৪ জনের ওপর এবং ফেইস-২-এ ৬০০ জনের ওপর ট্রায়াল করা হয়েছে। এতে টিকাটি নিরাপদ ও মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার প্রমাণ মিলেছে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় চীনের এই টিকাটির ট্রায়াল চলছে। সৌদি আরব, তুরস্ক ও চিলিতেও ট্রায়াল শুরু হবে বলে জানান তিনি।

প্রথম ধাপে যারা পাবেন টিকা: চীনা টিকা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) দ্রুততম সময়ে টিকার অনুমোদন দিতে চায়। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা শুরুর পর তারা ছয় মাসও অপেক্ষা করতে চাচ্ছে না। আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরের মধ্যেই তারা টিকার অনুমোদন দিতে চায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ট্রায়ালের জন্য নির্ধারিত চার হাজার ২০০ জনের মধ্যে দুই হাজার অংশগ্রহণকারীকে টিকা দেওয়ার পর তিন মাস পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে। তাদের তথ্য নিয়ে মধ্যবর্তী ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এই ফলাফল সন্তোষজনক হলেই এফডিএ টিকার অনুমোদন দেবে। এটি জরুরি অনুমোদন। প্রথম দফায় এই টিকা করোনা মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা বিশেষ করে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বয়স্ক জনগোষ্ঠী পাবে। এর পরের ধাপে অন্যদের দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ড. কে জামান বলেন, ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ না করে অনুমোদন দিলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। সুতরাং পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়ার পর অনুমোদন দেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন তিনি। প্রথম দফায় কাদের টিকা পাওয়া উচিত- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথমে টিকা দেওয়া প্রয়োজন। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে যায় কিংবা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনসমাগম এলাকায় কাজ করতে হয়, শুরুতে তাদের এই টিকা দেওয়া প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, চীনের টিকার ট্রায়াল সফল হলে প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে দেশেও টিকা উৎপাদনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা ও পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস এই টিকা উৎপাদন করতে সক্ষম। এই তিনটি কোম্পানির মধ্যে ইনসেপ্টা ও পপুলার কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে টিকা তৈরিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

অন্য টিকার সর্বশেষ অবস্থা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৭৯টি করোনা প্রতিরোধী টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে ১৪৫টি প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ৩৪টি ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। ১২ আগস্ট রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে টিকা উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় ওই টিকাটি নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারত নিজেদের পাশাপাশি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকার চুক্তি হয়েছে। ওই টিকা পেতে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর বাইরে ভারতের বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড তাদের উৎপাদিত টিকা বাংলাদেশে ট্রায়ালে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রাশিয়া, চীন ও ভারতের বাইরে বিকল্প উপায়ে টিকা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টিকার চাহিদা পূরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) ও কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সিইপিআই) যৌথভাবে কভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্লোবাল অ্যাকসেস বা কোভ্যাক্স নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনামূল্যে, স্বল্পমূল্যে টিকা ক্রয় করে মজুদ করবে এই কোভ্যাক্স। ওই টিকা দরিদ্র দেশগুলোকে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করা হবে। গ্যাভির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশেও ওই টিকা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছে।

মানসম্পন্ন, সহজলভ্য এবং সুলভ মূল্যের টিকা নিতে চায় বাংলাদেশ:

করোনার টিকা পাওয়ার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, টিকার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী সরাসরি দেখভাল করছেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি চীনের একটি টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অক্সফোর্ডের টিকারও প্রতিশ্রুতি মিলেছে। চীনের মতো অন্যান্য দেশের টিকারও বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে কিনা এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ-সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ভারতের বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত টিকার বাংলাদেশে ট্রায়াল করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভারতের হাইকমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ভারতের টিকার ট্রায়ালও শুরু হবে। বিশেষ কোনো টিকার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে জাহিদ মালেক বলেন, টিকার বিষয়ে কোনো একটি দেশের প্রতি আমাদের বিশেষ দুর্বলতা নেই। গুণগত মানসম্পন্ন, সহজলভ্য এবং সুলভ মূল্য- এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় করে যে টিকাটি পাওয়া যাবে, সেটিই গ্রহণ করব। কারণ প্রতি ডোজ ৪০ ডলার করে কিনতে হলে ওই টিকা ক্রয় করা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং সার্বিক বিষয় চিন্তা করে দেশের মানুষের জন্য যে টিকাটি ভালো মনে হবে, সেটিই গ্রহণ করব।

টিকা ক্রয়ের জন্য অর্থের সংকট হবে না উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিনামূল্যে কেউই টিকা পাবে না। তবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য হয়তো একটু কম মূল্যে টিকা সরবরাহ করা হতে পারে। রাশিয়ার টিকা ১০ থেকে ১৫ ডলার, ফাইজারের টিকা ১৭ থেকে ৩০ ডলার, মডার্নার টিকা ৩০ থেকে ৪০ ডলার দাম পড়বে বলে শোনা যাচ্ছে। অক্সফোর্ড, ভারত ও চীনের টিকার মূল্য এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। দেশের মোট জনসংখ্যা যদি ১৬ কোটি ধরা হয়, তাহলে ৩২ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে।

এই টিকার দাম কত পড়বে তা এখনও আমরা জানি না। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর বাইরে প্রয়োজন নেই এমন সামগ্রী ক্রয় না করে ওই অর্থও টিকার জন্য রাখা হয়েছে। সুতরাং টিকা ক্রয়ের অর্থ নিয়ে সংকট হবে না।


শর্টলিংকঃ