Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

চোখের সামনেই মরছে একের পর এক করোনা রোগী


জিয়াউল গনি সেলিম :
বুধবার করোনা আক্রান্ত বোনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার আমজোয়ান গ্রামের আব্দুর রহমান।  অক্সিজেন লেভেল বিপদজনক। অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছে হাসপাতালে। তিনি বলছিলেন, ‘আমার বোনকে বাঁচাতে হলে আইসিইউ প্রয়োজন। কিন্তু আইসিইউ ফাঁকা নেই। বোনের আইসইউ’র সিরিয়াল পড়েছে ৬৭ নম্বরে। বহু ছোটাছুটি করেও আইসিইউ ম্যানেজ করতে পারি নি। এখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই’!

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য ক্রমেই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠছে। গেল ১০দিনে অন্তত ৬৯জন মারা গেছেন। যারা এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সুস্থ হয়ে আর বাসায় ফিরতে পারেন নি। করোনা ওয়ার্ডে মৃত্যুর ঘটনা এখন স্বাভাবিক।

হাসপাতালে ৩০ নম্বর করোনা ওয়ার্ডে গত কয়েকদিন ধরে থাকছেন একই উপজেলার আশরাফুল। পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে নিজের মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই দিনরাত তিনি সেখানে থাকেন। আশরাফুল বলেন, প্রতিদিন এতো মৃত্যু হচ্ছে, আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, কারো মৃত্যুতে কেউ কাঁদে না। থাকে না হা-হুতাশ অথবা কান্নার রোল। হয়তো মন খারাপ হয়। চোখের কোনে হয়তো এক চিলতে পানি জমে, এই এতটুকুই।

কেন এরকম পরিস্থিতি জানতে চাইলে আশরাফুল বলেন, এখানে সবাই নিজেকে নিয়ে শংকায় থাকে। কখন কি হয়। আর যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যু দেখতে দেখতে সকলেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন আশেপাশের মৃত্যুর মিছিল কাউকে উদ্বেলিত করেনা। বরং আমার নিজের মনে হয়, মৃত্যু নয় এ যেন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাচ্ছে সবাই।

হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ আগেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন করোনা ও উপসর্গে রোগী ভর্তি হতো ১৫ জন। এখন সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ জনে। তাদের বেশীরভাগই ইউসুফ আলীর মতো শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা যখন প্রকট হয় তখন হাসপাতালের দ্বারস্থ হন।

 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, শরীরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৭ ভাগ এর নীচে নেমে আসলে শ্বাসকষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক লক্ষণ। সে বিষয়ে সর্তক হওয়া খুবই জরুরী। কিন্তু বেশীরভাগ ভর্তি রোগী হননি।যখন শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতার প্রকট হয় তখন হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসকদের শত চেষ্টা থাকলেও অবস্থা বেগতিক হওয়ায় আমাদের বলতে গেলে কিছুই করার থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে। সেটি হচ্ছে স্যাচুরেশনের মাত্রা কমে গেলেও বুঝতে না পারা। কে বলা হয় হ্যাপি হাইপোক্সিয়ার।

হ্যাপি হাইপোক্সিয়ার এর বৈশিষ্ট এমন যে, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৭০ থেকে ৫০ ভাগে নেমে গেলেও আক্রান্ত ব্যক্তি কোনও সমস্যাই টের পান না।সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল কোনও সমস্যাই দেখা না যাওয়ায় সময় মতো চিকিৎসাও শুরু করতে পারেন না আক্রান্তরা।ফলে অনেক ক্ষেত্রেই হ্যাপি হাইপোক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।

শামীম ইয়াজদানী বলেন, অক্সিজেন স্বল্পতায় বা শরীরে অক্সিজেন এর মাত্রা হঠাৎ করে নেমে যাওয়ায় হাসপাতালে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, চাঁপাইনবাববগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে মৃত্যুর হার কম। এর কারণ রাজশাহীতে কারো শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে সে দ্রুত হাসপাতালে আসতে পারছে, এবং চিকিৎসা নিয়ে অনেকাংশে জীবন রক্ষা করতে পারছে। কিন্তু চাঁপাইনবাববগঞ্জ থেকে আসতে সময় লাগে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি উপসর্গ বুঝে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেও দেরীতে চিকিৎসা শুরু হওয়ায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে।

হাসপাতালের হিসেব মতে, গত ১১ দিনে হাসপাতালে মারা গেছেন অন্তত ৭৮ রোগী। বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২৪ রোগী ভর্তি আছেন। বর্তমানে কোনো আইসিইউ খালি নেই।


Exit mobile version