Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

জননী, তোমায় পড়ে মনে


ইউএনভি ডেস্ক :

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছেলে হারানোর শোক কিংবা মরণব্যাধি ক্যানসার যার দেশপ্রেমের কাছে হার মেনেছে। নিজের মেধাবী সন্তান শহীদ রুমিকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলে তিনি। এমন কি নিজেও যুদ্ধ করেছেন কলম হাতে। ১৯৮৬ সালে তিনি রচনা করেন একাত্তরের স্মৃতি-বিস্মৃতি বিজড়িত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’। তিনি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।

সেই শহীদ জননী ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক জাহানারা ইমামের ৯১তম জন্মদিন আজ। ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন জাহানারা ইমাম। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযোদ্ধার গর্বিত মা ও এই মহীয়সী নারীর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে করা সেই আন্দোলন আজ ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চলছে মানবতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই ঘৃণ্য অপরাধীদের দায়ে ইতোমধ্যে অনেকেরই কার্যকর হয়েছে ফাঁসির দণ্ড।

জাহানারা ইমামের এই জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে দেশ ব্যাপী নানা তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালন করা হবে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে একইসঙ্গে স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছিলেন তিনি। এই শহীদ জননী জাহানারার পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। তখন তার ১৯ বছর বয়সী বড় সন্তান শাফী ইমাম রুমি যুক্তরাষ্ট্রে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ ত্যাগ করে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দেশের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

এ সময় প্রিয়জনকে হারানোর সেই বেদনা তাঁর অন্তরে জ্বেলে দিয়েছিল তীব্র দ্রোহের আগুন। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তার নেতৃত্বেই গঠন করা গণআদালতের মাধ্যমে একাত্তরের শীর্ষ নরঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। মূলত এরপর আমৃত্যু সেই সংগ্রামী নারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে নানা সময়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় তিনি নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে তার রচিত ডায়রি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ হচ্ছে এক অনন্য সৃষ্টি।

এদিকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দল তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশব্যাপী সকল জনগণ এর বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভে প্রদর্শন করেন। ১৯৯২ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রায় ৭০টি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন একজোট হয়ে গঠন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি সংগঠন।

যা পরবর্তীতে আরও বিস্তৃত কলেবরে পরের বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। যেখানে সর্বসম্মতিক্রমে কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচন করা হয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও সন্তানহারা, দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত সেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গোলাম আযম এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠে তীব্র গণআন্দোলন।

পরে সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনগণের দাবিতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসানো হয় ঐতিহাসিক গণআদালত। শহীদ জননীর সভাপতিত্বে প্রায় লক্ষাধিক বিচার প্রার্থীর উপস্থিতিতে শুরু হয় ঘাতকদের হোতা গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার। আদালতে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নির্দিষ্ট ১০টি অভিযোগের প্রতিটিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গোলাম আযমকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

এর আগে ১৯২৯ সালে মুর্শিদাবাদে জন্ম নেওয়া জাহানারা ইমাম ছোটবেলাতেই পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। স্বামী প্রকৌশলী শরীফ ইমামও তাকে লেখাপড়ায় বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। এ সময় শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তিনি ফুল ব্রাইট স্কলার হিসেবে আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে তা ছেড়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেন।

এদিকে ১৯৭১ সালে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে তিনি তার ছেলে রুমী ও স্বামীকে হারান। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধের সেই নয় মাস তার ভীষণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে কাটে। এ সময় তার মনের মধ্যে ছিল তীব্র দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। তিনি এই দুঃসময়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

স্বাধীনতার পর জাহানারা ইমাম নিজের লেখালেখি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীর সন্তান রুমীর আত্মত্যাগ ও নিজের অবদানের কারণে দেশব্যাপী সকলের কাছে আখ্যায়িত হন শহীদ জননী হিসেবে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট শহরের একটি হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাংলার এই মহীয়সী নারী।

দেশের স্বনামধন্য একজন সু-সাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন এই জাহানারা ইমাম। তার রচনা করা ‘একাত্তরের দিনগুলি‘ মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম দলিল। তার রচিত অন্য সব গ্রন্থগুলো হলো ‘জীবন মৃত্যু, অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, চিরায়ত সাহিত্য, নাটকের অবসান, বুকের ভিতরে আগুন, দুই মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস এবং প্রবাসের দিনলিপি উল্লেখ যোগ্য।


Exit mobile version