Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

জামায়াত শিবিরের আদি-অন্ত (২য় পর্ব)


 জামায়াত – শিবিরের আদি-অন্ত (পর্ব-১) 

(১মপর্বের পর থেকে)…

প্রগতিবাদী চিন্তাবিদ ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক যতীন সরকার এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এখন নিজেদের পিঠ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধকেই ব্যবহার করছে, যা নিতান্তই হাস্যকর। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর আস্কারা পেয়েই তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিকে ঝুঁকে পরার ভান করছে”। এটা ঠেকাতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

জামায়াতের এইসব ভণ্ডামির তীব্র বিরোধিতা করে আরেক ইসলামিক সংগঠন তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব এম এ আউয়াল এমপি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা উপলক্ষে ছাত্র শিবিরের এই সব ফালতু কাজকর্ম দেখে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়ার নামে মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি অসম্মান করছে। সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দ্রুত কথা বলা। চিরতরে এসব নষ্টামি আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে শিবিরের র‌্যালি বন্ধ করে দেওয়া”।

আবার ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর সভাপতি কাঁকন বিশ্বাসও জামায়াত-শিবিরের এ ধরনের কর্মসূচির ঘোর বিরোধীতা করে বলেন, “ছাত্রশিবির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাব ধরে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে অথচ তারা ভালো করেই জানে – বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিসংগ্রাম, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মানুষের আত্মত্যাগের কথা বাদ দিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। তাঁরা এখন সূক্ষ্ম চতুরতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করে নানা কৌশলে নতুন প্রজন্মকে কাছে টানতে চাইছে। অতি দ্রুতই তাদের রুখে দেওয়া উচিত”।

ধর্ম ভীরু সাধারণ জনগণকে ব্রেন ওয়াস করার জন্য ওয়াজ মাহফিলকে তাঁরা আরেকটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যাবহার করে যাচ্ছে। ওয়াজ বলেই হয়তো সরকার এটাকে আমলে নেয় না। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওয়াজের মাধ্যমে এই জামায়াত-শিবির দেশের আনাচে কানাচে ও দেশের বাইরে গড়ে তুলেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী তার বাকপটুতা দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে টেনে আনছে ধর্মীয় রাজনীতির ময়দানে।

এই ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমে তাঁরা প্রতিনিয়ত তৈরি করে যাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির ভয়ঙ্কর জঙ্গি সহ আত্মঘাতী জঙ্গি। রক্তাক্ত করছে দেশের জনপদ, লিখে যাচ্ছে খুন ও লোমহর্ষকতার ইতিহাস। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে অসংখ্যবার সংবাদ হয়েছে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে। আদতে কোনো কার্যকর ফল হয়নি। কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি ও কিছুদিন পর পর কয়েকজন জঙ্গি গ্রেপ্তার করেই বিষয়টিতে সরকার তুষ্ট থাকছে মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাবিদার আওয়ামী লীগ সরকারও প্রত্যেকবার নির্বাচনের আগে জঙ্গি নির্মূলের ঘোষণা দেয়, কিন্তু সরকার গঠনের পর বছরের পর বছর পার হয়ে যায় অথচ জঙ্গি নিধনে তেমন কোন বলিষ্ঠ কার্যকারিতা দেখা যায় না। তেমন কোনো উদ্যোগও দেখা যায় না। বেশী না, এই সরকার শুধু শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে উঠে আশা চাঞ্চল্যকর তথ্যগুলো ধরে কাজ করলেই জঙ্গি দমনে অনেকদূর সফল হতে পারত।

বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির এক কালো অধ্যায়ের প্রসঙ্গে এই মুফতি হান্নান উল্লেখযোগ্য একটা জবানবন্দি দিয়েছিল। সেই জবানবন্ধি থেকেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা নিয়ে হাওয়া ভবনে মিটিংয় সহ এই হামলার সাথে জড়িতদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় । বিএনপি এসব অস্বীকার করলেও বিভিন্ন প্রমাণাদির মধ্য দিয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে আসার কারণে এখন তা আর শক্তভাবে অস্বীকার করতে পারছে না।

অবস্থাদৃষ্টে শুধু জোটের রাজনীতি ধরে রাখার জন্যই বিএনপি জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জড়িয়ে পরেছে বলে মনে হলেও সর্বোপরি এরা ফেঁসে গেছে জামায়াতেরই পেতে রাখা ফাঁদে। গত নির্বাচন গুলোতে ভোটারদের কাছ থেকে বিএনপি এর সমুচিত জবাব পেয়ে গেলেও তাতে তাদের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বরং বিএনপিতে প্রতিক্রিয়াশীলদের আধিপত্য বেড়েই চলছে, সেই সাথে তুলনামূলক ভাবে জামায়াতের উপর তাদের নির্ভরতা আরও বেড়ে গিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি হবে, তা এখনই তাদের ভেবে দেখা দরকার। জামায়াতী গ্রাস থেকে মুক্ত হতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বিএনপি-র নিজস্ব অস্তিত্বই নিশ্চিত ভাবে চরম হুমকির মুখে পরবে।

দেশে জঙ্গিবাদের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে গত জোট সরকারের আমলে। জামায়াত জঙ্গিবাদকে “মিডিয়ার সৃষ্টি” বলে দাবি করলেও পরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে সেই জামায়াতেরই সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। অল্প কিছু জঙ্গি হামলা পর্যালোচনা থেকেই উঠে আসে – শুধু জামায়াতই দেশের সিংহ ভাগ জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং তাঁরাই কলে কৌশলে জঙ্গিবাদকে এগিয়ে নিচ্ছে।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই হত্যা ও রগকাটা রাজনীতি, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এদেরকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে আখ্যায়িত করে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অধিভুক্ত ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর স্টাডি অব টেরোরিজম অ্যান্ড রেসপন্স টু টেরোরিজমের তৈরি ফাইলে ছাত্রশিবিরকে “ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন” হিসাবে বলা হয় । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতা চালানো ছাড়া শিবির আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গেও নিজেদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।

শিবির তার প্রতিষ্ঠালগ্নের আগে থেকেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির নাম ধারণ করে পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে পুনরায় এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে তারা তাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই রক্ত পিপাসু হায়েনারা সততা, ন্যায়, প্রজ্ঞা, প্রগতি, মননশীলতা, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে অসংখ্যবার হামলে পড়েছে। তাদের হাতে এ পর্যন্ত জাতির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনো তা বর্তমান।

শুধু ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এদের বোমা হামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করলেই তাঁদের হিংস্রতা, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা আর প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাওয়া যায়। ২০০১ নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ২১, আহত শতাধিক। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০১ বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের র্নির্বাচনী প্রচার সভায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৯, আহত শতাধিক। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলোচনা সভায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৪, আহত ১৫ জন।

২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২ সাতক্ষীরার গুরপুকুরের রক্সি সিনেমা হলে এবং সার্কাস প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৩, আহত ২ শতাধিক। ৭ ডিসেম্বর ২০০২ ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১৯, আহত ৪৫ জন। ১৭ জানুয়ারি ২০০৩ টাঙ্গাইলের সখীপুর ফালুচাঁদ ফকিরের মাজার মেলায় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত ৮ জন। ১ মার্চ ২০০৩ খুলনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা হামলা নিহত হয় ১ এবং কয়েক জন আহত হয়।

১২ জানুয়ারি ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালাল মাজারে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত ৭০ জন। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ খুলনায় সাংবাদিক মানিক সাহা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয়। ২১ মে ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালাল মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর আর্জেস গ্রেনেড হামলায় নিহত হয় ২ এবং হাইকমিশনারসহ আহত হয় ৭০ জন।

২৭ জুন ২০০৪ খুলনায় দৈনিক জন্মভূমির অফিসে বোমা বিস্ফোরণে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু নিহত হন। ৭ আগস্ট ২০০৪ সিলেটে গুলশান হোটেলে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়। ২১ আগস্ট ২০০৪ আওয়ামী লীগের জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড ও বোমা হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমান সহ নিহত হয় ২৪, শেখ হাসিনা সহ আহত হয় ৫ শতাধিক।

১৬ নবেম্বর ২০০৪ মৌলভীবাজারে যাত্রা প্রদর্শনীতে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ১০ জন। ১৭ জানুয়ারি ২০০৫ গোপালগঞ্জে ব্র্যাক-এর অফিসে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ২১ জন। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ খুলনা প্রেসক্লাবে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন ১ জন সাংবাদিক এবং আহত ৩ জন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণে আহত হয় ৮ জন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলোচনাসভায় বোমা বিস্ফোরণ ২০০৫-এর ১৭ আগস্ট জঙ্গিরা সারা দেশের তেষট্টিটি জেলায় একসঙ্গে পাঁচ শ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা কত শক্তিশালী। ৩ অক্টোবর ২০০৫ সালে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের কোর্টে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৩ জন, ১ জন বিচারক সহ আহত হন ৩৮ জন।

১৪ নবেম্বর ২০০৫ সালে ঝালকাঠি জেলা কোর্টে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ২ জন বিচারক এবং আহত ৩। এভাবে ২৯ নবেম্বর ২০০৫, ১ ডিসেম্বর ২০০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ এর তিনটি বোমা হামলায় নিহত হয় ১৯ জন আর আহত ১৫৮ জন।

প্রায় সূচনা লগ্নে ছাত্রশিবির ঢাকাতে নিজেদের কর্মকাণ্ড সাধ্যমত চালিয়ে তা আরও ব্যাপক আকারে বিস্তার করতে চট্টগ্রাম চলে যায়। এরা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে শুরু করে হত্যার রাজনীতি। ১৯৮১ সালে ছাত্রশিবিরের হাতে প্রথম খুন হয় চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেন।

১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রী শান্তিপূর্ণ একটি মিছিল বের করে। এই শান্তিপূর্ণ মিছিলটি ছিল মৌলবাদ মুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে। শুরু হয় মিছিলের উপর ছাত্রশিবিরের গুলিবর্ষণ, নিহত হন ছাত্রমৈত্রী নেতা ফারুক। আর এর মধ্য দিয়েই মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির খুনের রাজনীতি শুরু করে।

১৯৯৩ সালে ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনামুল হকের ছেলে ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২২ আগস্ট ১৯৯৮ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সঞ্জয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রশিবির ক্যাডাররা।

এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের পর থেকেই ওখানকার খ্যাতনামা কলেজগুলো ছাত্রশিবিরের টার্গেটে পরিণত হয়। প্রথম চট্টগ্রাম কলেজ, দ্বিতীয় সরকারি মহসীন কলেজ ও তৃতীয় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট তাদের টার্গেটে ছিল।

কয়েকটি হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি মহসীন কলেজ পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং নিয়মিত মিছিল-মিটিং করে কলেজে সর্বদাই আতঙ্কের সৃষ্টি করে রাখত। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ জমির ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদউদ্দিনকে গুলি করার পর তাদের হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর চট্টগ্রামের সবচাইতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল “বহদ্দারহাট ট্যাজেডি”। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে একটি মাইক্রোবাসে থাকা ছাত্রলীগের আটজন নেতা-কর্মীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় এই ছাত্রশিবির। এরপর ২০০১ সালে ২৯ ডিসেম্বর ফতেয়াবাদের ছড়ারকুল এলাকায় তাঁরা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজাকে। ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাসে নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে কুপিয়ে হত্যা করে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এএম মহিউদ্দিনকে।

এ ছাড়া চট্টগ্রামের ইতিহাসে আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল গোপালকৃষ্ণ মুহুরী হত্যার মধ্য দিয়ে। ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর ছাত্রশিবির ক্যাডাররা গোপালকৃষ্ণ মুহুরীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দুর্গম এলাকা ফটিকছড়িতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগেরও বেশ ক’জন নেতা-কর্মীকেও হত্যা করে।

এদিকে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়েও ছাত্রশিবির নৃশংসতার পথ বেছে নেয়। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ প্রথমবারের মতো শিবির ক্যাডাররা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বাসভর্তি বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনার পর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৮৮ সালের ৩ মে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষার্থীদের সামনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের কাছে ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে।

১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই ভোররাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা যখন ঘুমিয়ে, ঠিক তখন ছাত্রশিবিরের বহিরাগত ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ুব আলী খান, সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল এবং হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। একই বছরের আগস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো. ইউনুসের বাসভবনে শিবির বোমাহামলা করে।

১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির সন্ত্রাসীদের হাতে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াসির আরাফাত খুন হন। ঐদিন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

১৯৯২ সালের ১৯ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে রাজাকারদের অন্যতম প্রধান গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের হরতাল কর্মসূচী সমর্থনে জাসদের মিছিলে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়।

হামলায় সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে জাসদ নেতা মুকিম মারাত্মক আহত হন এবং ২৪ জুন মারা যান। একই বছরের আগস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত নতুন বুধপাড়া গ্রামে তাঁদেরই ক্যাডার মোজাম্মেলের বাড়িতে বোমা বানানোর সময় অসাবধানতার কারণে তা বিস্ফোরিত হয়ে ছাত্রশিবির ক্যাডার আজিবর সহ অজ্ঞাতনামা অন্তত আরো তিনজন নিহত হয়।

১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা সবচেয়ে বড় তাণ্ডবলীলাটি চালায়। ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর ছাত্রশিবিরের এই হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র নতুন ও ছাত্র ইউনিয়নের তপন সহ ৫ জন ছাত্র নিহত হন।

একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বহিরাগত সশস্ত্র ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের সদস্য জুবায়ের চৌধুরী রিমুকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবিরের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে বাসের যাত্রীদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে।

১৯৯৬ সালে জাসাস বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আমানউল্লাহ আমানকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা। ২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো. ইউনুসকে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা।

২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থি শিক্ষক মহিউদ্দিন এবং ছাত্রশিবির সভাপতি মাহবুব আলম সালেহী সহ আরো দু’শিবির ক্যাডার একযোগে হামলা চালিয়ে রাবির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু তাহেরকে হত্যা করে। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির অন্ধকার রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে তার লাশ ম্যানহোলে ফেলে রাখে শিবিরের ক্যাডাররা।
(চলবে…)

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে …

জামায়াত – শিবিরের আদি-অন্ত (পর্ব-১)


Exit mobile version