জামায়াত-হেফাজতের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য, উৎস এবং কোটি টাকার রাজনৈতিক ব্যবসা


সন্দেহ নাই এদেশে জঙ্গি আবাদের মুল কারণ তাদের (জঙ্গি) প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন এবং অর্থায়ন। যুগে যুগে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক দলের ছায়া খুঁজে বেড়ায়, তা পেয়ে গেলে খুব সহজেই নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে পারে।

যেহেতু ধর্মকে ব্যবহার করে জঙ্গি দলগুলো খুব সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, তাই রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সেই ধর্মভিত্তিক জঙ্গি দলগুলোকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের মুঠোয় রাখতে চায়। একসময় এদেরকে মুঠোয় নিতে এবং রাখতে অনেক বড়বড় রাজনৈতিক দলকে রীতিমত প্রতিযোগিতা করতেও দেখা গেছে।

ঠিক তাই এইদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিস্তারের কম বেশি দায় দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিতে হবে। কারণ কোন না কোনভাবে এই রাজনৈতিক দলগুলোই সেই উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বিস্তার করে এমন দলগুলোকে লালন-পালন বা প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, যা কি-না এখনও বর্তমান আছে।

বাংলাদেশে তেমনই ধর্মভিত্তিক একটি জঙ্গি দল হচ্ছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। এরা সাধারণ দলগুলোর মতো রাজনীতি করেনি, দলের পক্ষ থেকে গড়ে তুলেছে বিশাল এক আর্থিক জগৎ। দেশে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর নামে তৎপরতা চালানো হলেও এর নাটের গুরুরা এখনও প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের সংগঠন জামায়াত কিন্তু নিজস্ব অর্থের আয়ের পাকা-পোক্ত উৎসের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এমনকি দেশ-বিদেশে এদের এমন কিছু মাধ্যমও রয়েছে যেগুলো চিরস্থায়ী।

উল্লেখ্য যে – যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামের বর্তমানে এতো অর্থবিত্ত অথচ তাদের পূর্বের অবস্থা কিন্তু ছিল খুবই শোচনীয়, ধীরে ধীরে তাদের নেতাকর্মীরা দেশ-বিদেশের এমন কোন সেক্টর রাখেনি যেখান থেকে তারা অর্থ সংগ্রহ করছে না। জামাতের আত্মকথাভিত্তিক বিভিন্ন পুস্তক ও স্মরণিকা পাঠ করে জানা যায় – এক সময় যেসব জামায়াত নেতাদের পায়ে এক জোড়া জুতাও ছিল না অথচ তারা এখন কয়েকটা ব্যাংকের মালিক।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ জামায়াতকে প্রতিনিয়ত আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে। এছাড়াও ইউরোপের কয়েকটি দেশেও জামায়াতীরা সুযোগ সুবিধা ভোগ করে, তার মধ্যে লন্ডন অন্যতম। যে সব বিদেশী রাষ্ট্র জামায়াতে ইসলামকে সাহায্য করে, ঐ সব দেশ জামায়াতের সাথে যৌথ ব্যবসায়িক অংশীদার।

বাংলাদেশে জামায়াতের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় তাদের বিভিন্ন সংস্থা। এ রকম বহু দাতা সংস্থা এনজিও, ফাউন্ডেশন, অর্গানাইজেশন, মানবাধিকার সংস্থা পরিচালিত হয় জামায়াতের অধীনেই। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও বিভিন্ন পুঁজিবাদী উন্নত রাষ্ট্রও জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন পরিচালনা, কর্মীদের অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ, সংগঠনের জন্য অস্ত্র কেনা, সংগঠন পরিচালনা ছাড়াও বিভিন্ন দেশদ্রোহী জঙ্গী গোষ্ঠিকে লালন পালন করার জন্য বিভিন্ন ভাবে আর্থিক সহায়তা করে থাকে।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর স্থায়ী ইনকাম সোর্স রয়েছে অসংখ্য। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত থেকেই সুস্পষ্ট তালিকায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি দেশে অসংখ্য কোচিং সেন্টার, বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ আছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস, আল মারকাজুল হাসপাতাল, দিগন্ত টেলিভিশন, ফোকাস বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং, রেটিনা মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং, মানারাত ইউনিভার্সিটি, ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স, বিডি ফুডস লিমিটেড, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ফুয়াদ আল খতিব মেডিক্যাল ট্রাস্ট, বুয়েট ভর্তি কোচিং কনক্রিট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ইনডেক্স, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং রেডিয়াম, ডুয়েট (গাজীপুর) ভর্তি কোচিং অপটিমাম, কেয়ারি লি., দৈনিক সংগ্রাম, কিশোরকণ্ঠ ফাউন্ডেশন, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, নর্দান ইউনিভার্সিটি ও ইষ্টার্ন ইউনিভার্সিটি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং ‘ফোকাস’, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য ‘কনক্রিট’, ‘কনসেপ্ট’ ও ‘এক্সিলেন্ট, ইয়ুথ গ্রুপ, ডেভেলপার কোরাল রীফ, মিশন ডেভেলপারস, এস.এ.এফ,এম.ডি.সি গ্রুপ, কেয়ারী, ইনটিমেট হাউজিং, সোনারগাঁ হাউজিং, লালমাটিয়া হাউজিং, সিলভার ভিলেজ হাউজিং, ওয়ান সিটি, পিংক সিটি, আবাসন সিটি।

যোগাযোগের বাহন, যেমন – বিভিন্ন আইটেমের গাড়ি, ট্রাক, বাস, লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ, রোলার, তিন চাকার তেল গ্যাস চালিত গাড়ি। ফুড প্রোডাকশান প্রতিষ্ঠান, কোমল পানীয় উৎপাদন কারখানা, শিশু খাদ্য উৎপাদন, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠানসমূহ। তাদের রয়েছে গণমাধ্যম, যেমন- নিজস্ব টেলিভিশন, দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা ছাড়াও রয়েছে অজস্র প্রিন্টিং প্রেস।

আছে সমাজসেবামূলক সংস্থা ও ঋণদান কর্মসূচী। জামায়াতে ইসলামের অর্থের উৎসের মধ্যে দেশীয় এমন কোন খাত নেই যেখানে তাদের দখলদারিত্ব নেই। এক কথায় বলতে গেলে জলে-স্থলে-আকাশ সীমায় জামায়াতে ইসলামের অর্থের উৎস আছে অসংখ্য।

সদস্যদের চাঁদা সংগ্রহ অন্যান্য দাতা, দানবীর, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের নিকট চাঁদা সংগ্রহ মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ এতিমদের জন্য যাকাত, ফিৎরা, দান-খয়রাত এটাও তাদের অর্থ সংগ্রহের অন্যতম উৎস। রমজানের সময় ফিৎরা সংগ্রহ একটা বিশাল বাজেট।

কোরবানির সময় ফি সাবিলিল্লাহ নামের চামড়াগুলোও তাদের বায়তুলমালে জমা হয়। এতিমদের নামের টাকা সংগ্রহে জামায়াত ও হেফাজত সাধারণত একই পদ্ধতি অনুসরণ করে। ব্যবধান কেবল জামাতীরা নিজেও খায় আবার বায়তুল মালেও দেয় কিন্তু হেফাজতীরা নিজেরাই খায়।

দীর্ঘ কয়েক বছরের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত একটু ঘাঁটলেই দেখা যাবে – বাংলাদেশের হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে এই জামায়াতেরই আরেকটা শক্ত অংশ। এরা একে অপরের পরিপূরক। একটু খেয়াল করলেই সাদা চোখেই বোঝা যায় – উভয়রই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এক ও অভিন্ন।

হেফাজতের নেতাদের রাজনৈতিক হাতে খড়ি কিন্তু সেই জামায়াত থেকেই। একটু আলাদা হওয়ার ভাব ধরে চারদিক থেকে জামায়াতের মূল উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করতেই তাদের এহেন চতুরতা। এর যথেষ্ট প্রমাণও আছে।

জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতের মত ধর্মভিত্তিক এই জঙ্গি দলগুলোর যে কোন একটির অর্থের উৎস বর্ণনা করতে গেলে রীতিমত হিমশিম খেতে হবে। কেননা তাদের এমন কোন মাধ্যম নেই যেখান থেকে অর্থের যোগান হয় না।

বিদেশ থেকে মাদ্রাসা, মসজিদ নির্মাণ ও এতিমদের ভরণ-পোষণের নামে হেফাজতে ইসলামের নেতারা যে টাকা সংগ্রহ করে, তার কোন সঠিক হিসাব নেই। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ওমান, জর্ডান, আরব-আমিরাত, মিশর, তুরস্ক, মালেয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে হেফাজত নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। তবে এতে আছে কিছুটা বিচিত্রতা।

তাদের বিভিন্ন প্রতিনিধি কিংবা নেতা একেক নিয়মে অর্থ সংগ্রহ করে। তারা সারা বছর যেমন ঐসব দেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে, ঠিক বিশেষ বিশেষ উৎসব পার্বণে তার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনকি সরাসরি অর্থ সংগ্রহের জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতা ও তাদের প্রতিনিধিরা উগ্র ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করে দাতা সংস্থা ও ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।

কওমি মাদ্রাসা থেকে পাশ করে যারা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করে, তারাই এতে বেশি সহযোগিতা করে। মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমদের কথা বললে আরবরা যাকাত-ফিৎরা-দান-খয়রাত দু হাতে দেয়, তার উপর ইসলাম ও ঈমান রক্ষার আন্দোলনের কথা বললে তারা আরো বেশি অর্থের যোগান দিয়ে থাকে। এমন কোন আরব দাতা সংস্থা নেই যেখান থেকে ইসলাম রক্ষার নামে, নাস্তিক-মুরতাদদের হটানোর নামে, ইসলামী সমাবেশের নামে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতারা অর্থ ও টাকা সংগ্রহ করেনি।

কিন্তু সেই সব অর্থের খোঁজ-খবর রেখেছে কয়জন। বিভিন্ন সময় ঈমান ও ধর্ম রক্ষার নামে আওয়াজ তুলে হেফাজত নেতারা যে সব আন্দোলন সংগঠিত করে, তার আসল লক্ষ্যই হচ্ছে আরব দাতাসংস্থা ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা।

হেফাজতে ইসলামের নেতারা তাদের কওমি মাদ্রাসার নামে চাঁদা সংগ্রহ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের যাকাত ফিৎরা বার্ষিক চাঁদাসহ রমজান মাসের এককালীন চাঁদা, বিভিন্ন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিল্পপতিদের নিকট মাদ্রাসা নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ ও এতিমদের নামে প্রতিনিয়ত চাঁদা সংগ্রহ করে। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের প্রত্যেকের কোন না কোনভাবে একটা মাদ্রাসা কিংবা একটা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ততা আছে।

সেই মাদ্রাসা ও মসজিদই চাঁদা সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম। আবার অনেক নেতা রয়েছে যারা এক বা তারও অধিক মসজিদ মাদ্রাসা ও এতিম খানার পরিচালক। যাদের যত বেশি প্রতিষ্ঠান তাদের তত বেশি অর্থ-সংগ্রহের সুযোগ। দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক ও বার্ষিক চাঁদা ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমী চাঁদা সংগ্রহের বিশাল একটা অংশ হেফাজত নেতাদের পকেটে চলে আসে।

কোরবানির চামড়ার ব্যবসার জন্য হেফাজত নেতারা কোটি কোটি টাকার বাজেট করে থাকে, যা কিনা তারা পূর্বেই এতিমদের সহায়তার নামে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে। সেইসব আয়ের টাকা দিয়ে নিজেদের আরাম-আয়েশ সহ দেশদ্রোহী জ্বালাও পোড়াও কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয়। মজার ব্যাপার কওমীপন্থী হেফাজত নেতারা আগের মতো যে শুধু পুরনো ঐতিহ্য ধরে বসে আছে তা নয়।

নিজেরা যতই গোঁড়ামি শিক্ষার অধিকারি হোক কিন্তু অন্যদেরকে আধুনিক শিক্ষার নামে বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন কিন্ডারগার্টেন, ইসলামী মহিলা মাদ্রাসা, ইসলামী ক্যাডেট মাদ্রাসার নামে আরেক অর্থের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা কারখানা খুলে বসে ঠিকই সুবিধা ভোগ করছে। আবার সমবায় সমিতির নামে মাল্টিলেভেল অনুকরণে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলেও অর্থ সংগ্রহ করছে। ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, বিভিন্ন রিয়েল স্টেট, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও এর আওতাভুক্ত।

ইসলাম ধর্মের হেফাজতকারী বললেও মূলত তারা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের অর্থ এবং ব্যাক্তিগত স্বার্থ হেফাজত করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই এই ধর্ম ব্যবসায়ী উগ্রবাদী হেফাজতী ও জামাতীদের। কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয় আমেরিকা, কানাডা, লন্ডন ও ইউরোপ থেকেও তারা নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করে।

হেফাজতের ঢাকা অবরোধের সময় রাতে শাপলা চত্বরে অভিযানতো তাদের জন্য অর্থ উপার্জনের আরেক ্রসৌভাগ্যগ্ধ হিসাবে দেখা দিয়েছে। তাদের জীবনে অর্থ উপার্জনের এমন একটা মোক্ষম সুযোগ যে আসবে, তা তারা কখন কল্পনাও করতে পারেনি। তাদের দাতা গোষ্ঠীদের কাছে হাজার হাজার নেতাকর্মী নিহতের বার্তা পৌঁছে দিয়ে আগের চাইতে বহুগুণ বেশি সমীহ যেমন আদায় করেছে, ঠিক তেমনি আদায় করেছে অর্থ, যা কি-না নিহত প্রত্যেকের পরিবারের পুনর্বাসনের নামে এখনও বর্তমান আছে।

অবশ্য বাস্তবে আহত কয়েকজন হেফাজতকর্মীদের সাথে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায় – হেফাজতে ইসলামের বহু নেতা তাদেরকে টাকা দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাক্ষাৎকার নেয়ার পর তাদের আর কোন খোঁজ খবর নিতে আসেনি। যেসব কর্মীরা হেফাজতের সমাবেশে গিয়ে আহত হয়েছে তাদের নামেও বিভিন্ন সময় টাকা সংগ্রহ করে নিজেদের পকেট ভরার কাজটাও খুব নিঁখুতভাবে এরা করে যাচ্ছে।

৫ মে, ২০১৩-তে শহীদ (!) হওয়া কক্সবাজারের মতিউর রহমানের পরিবার আক্ষেপের করে বলেন, ঘটনার প্রথম দিকে অনেকে এসে আমাদের সাহস দিয়ে বলেছিল, আপনাদের জন্য বিদেশ থেকে টাকা এসেছে, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা এসে দিয়ে যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোন বাস্তবতা নাই। ৬ মে, ২০১৩-তে নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে রফিক উদ্দীন নামে হেফাজতের এক কর্মী আহত হয়েছিল।

দিনমজুর সেই রফিক সমস্ত সহায় সম্বল হারিয়ে এখন পথের ভিখারী। বৌ-ছেলে নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছে, ধুঁকছে বিনা চিকিৎসায়। তখন পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকা এবং অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পারায় এক পর্যায়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। ৬ তারিখ ছুটে গিয়েছিলো হেফাজতের অবরোধে।

সংঘর্ষের সময় অনেক চেয়েছিলো নিজেকে বাঁচাতে, কিন্তু হেফাজতের কর্মীদের বেপরোয়া আচরণের কারণে আঘাত প্রাপ্ত হয় রফিকের পা। আর আঘাত লাগে তার শরীরের বিভিন্ন অংশে। রফিক বলেছিল – সব ধোঁকাবাজ। আমি গরীব মানুষ, আহত হয়ে বাসা ছাড়তে হয়েছে গ্রেপ্তারের ভয়ে, টাকার অভাবে বউ-বাচ্চাকে দুবেলা খেতে দেয়া তো দুরের কথা, নিজের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছি না।

এমনই ভাবে ৫ ও ৬ মে হেফাজতের নেতাদের আহবানে ঢাকায় এসে আহত হয়েছেন অনেকে। সেই নেতারা তাদের আর কোন খবর নেয়নি। ইসলামের নামে শহীদের নামে টাকা মেরে খাচ্ছে মাওলানা আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাছ মাদানী, খাদেম শফি, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মঈনুদ্দীন রুহি, জুনাইদ আল-হাবিব, কাতেব ইলিয়াছ ওসমানী, হাফেজ তৈয়ব, আব্দুল মালেক হালিম ও মুফতি ওয়াক্কাছ।

আহমদ শফীর ছেলে হিসেবে আনাছের একক কর্তৃত্বের কারনে হেফাজতের অনেক শীর্ষ নেতা আহমদ শফীর উপর নাখোশ। কিন্তু মুরুব্বির সামনে কেউ মুখ খুলতে পারছে না, কেননা আহমদ শফীর সাথে যাদের সুসম্পর্ক তাো সুবিধাও বেশী পায়। তিনি একজন কিন্তু সবসময় খাদেম থাকে ২০ জন। এমন কি দেশের শীর্ষ নেতাদের পেছনে ফেলে এসব খাদেম ও আত্মীয় স্বজনরা মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়ায়।

নিহত ও আহত নেতা কর্মীদের নামে সংগ্রহ করা তহবিল থেকেই হেফাজতে ইসলামের আমীর ও নেতৃবৃন্দ বর্তমানে বিলাসবহুল জীবন যাপন করে। ২০১৩-র ৫ই মে লক্ষ লোকের খাদ্য ও পানীয় সংগ্রহ সহ কোটি টাকার গাড়ী ভাড়া এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে অর্থ তারা ব্যয় করে, তার উৎস অনুসন্ধানে জানা যায় – হেফাজতে ইসলাম তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে গঠন করেছে বিষয় ভিত্তিক সাংগঠনিক সেল।

নির্ধারিত বিষয়ের উপর পারদর্শীদের করা হয়েছে এসব সেলের প্রধান বা আহবায়কদেরকে। এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ শাখার অর্থ বিষয়ের সেলের প্রধান করা হয়েছে ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরীকে এবং সহকারী করা হয়েছে সাবেক হরকাতুল জিহাদের নেতা কাতেব ইলিয়াছ ওসমানীকে। এছাড়াও অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে, ঢাকার মুফতি নুরুল্লাহ, জুনাইদ আল-হাবিব, মীর ইদ্রিছ প্রমুখ।

এদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিত্তশালী লোকদের সাথে যোগাযোগ করে গত ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হাজার হাজার লোক শহীদ হয়েছে দেখিয়ে তাদের পরিবারকে সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার নামে নতুন করে বড় অংকের তহবিল সংগ্রহ করা। বিশেষ করে দেশের বাহিরে অবস্থানরত প্রবাসীদের মাঝে ৫ মে’র ঘটনায় মৃতের সংখ্যা হাজারেরও অধিকগ্ধ এমন বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ও আবেগ তাড়িত করে অর্থ আদায় করার চমৎকার একটা সুযোগ নিয়েছে এবং সফলও হয়েছে।

৫ মে’র ঘটনায় অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সফল হয়ে হেফাজত এই তহবিল নিয়ে করেছে হরিলুটের খেলা। কথিত শহীদ পরিবার ও আহতদের কাছে সেই অর্থ পৌছেনি, এমনকি এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ৫ মে’র আগে ফরিদপুরের সমাবেশ থেকে সাভার ট্রাজেডির নামে ফান্ড কালেকশন করলেও তা আত্মসাৎ করেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ন সম্পাদক ও ঢাকা মহানগরীর সদস্য সচিব মাওলানা জুনাইদ আল-হাবিব সহ অন্যান্য নেতারা।

এ নিয়ে জুনাইদ আল-হাবিবকে প্রধান আসামী করে ফরিদপুর জেলা হেফাজত নেতা মামলা দায়ের করেছিল। মামলার কারণে জুনাইদ আল-হাবিব কিছুদিন পালিয়ে বেড়ায় পরে তা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে নেয়। তবে এর কোন প্রতিবাদ তিনি করেননি, তার মানে ঘটনাটি সত্য।

দেশব্যাপী হেফাজতের সকল কমিটি অভ্যন্তরীণ ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে মাসিক বা বার্ষিক নির্ধারিত চাঁদা দিয়ে থাকে। ফান্ড কালেকশনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে দেশ-বিদেশের মসজিদ মাদ্রাসা শিক্ষক, ঈমাম, মাদ্রাসার ছাত্র ও দেশ-বিদেশের ধর্মীয় অনুভূতিশীল ব্যক্তিরাই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য। তবে হেফাজতের শীর্ষ নেতারা কখনো চাঁদা দিয়েছে এমন নজির পাওয়া যায়নি। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে নিয়ম করে নির্ধারিত মাসিক বা এককালীন চাঁদা নিয়ে থাকে।

আহমদ শফির ছেলে মাওলানা আনাছ মাদানী বিদেশ থেকে ফান্ড কালেকশনের মুল দায়িত্বে আছে, আর সহযোগীরা হচ্ছে – বাবুনগর মাদ্রাসার শিক্ষক, হেফাজতের অর্থ সম্পাদক মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী, সহকারী অর্থ সম্পাদক মাওলানা কাতেব ইলিয়াছ ওসমানী, ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী ও সেক্রেটারী মাওলানা জুনাইদ আল- হাবিব, মাওলানা আব্দুল মালেক হালিম, চট্টগ্রাম মজাহেরুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা লোকমান হাকিম, মুফতি ইজাহারুল ইসলাম চৌধুরী, নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা সেলিমুল্লাহ ও চট্টগ্রাম সেগুনবাগান মাদ্রাসা ও শিক্ষা কমপ্লেক্স-এর পরিচালক হাফেজ তৈয়ব প্রমুখ। এরা মৌসুম অনুযায়ী বিদেশে গিয়ে সংগঠনের জন্য অর্থ জোগাড় করে আনে। যার নাই কোন হিসাব, যে যার মত করে ওই টাকার ভাগবাটোয়ারা করে লুটেপুটে খায়।

বিভিন্ন তথ্য মতে ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় নিহত ও আহতদের নাম করে পাকিস্থান, লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে কোটি কোটি টাকা হেফাজতের নেতারা সংগ্রহ করেছে। তাদের নিজস্ব নেতারা স্বীকার করেছে – এ টাকার কোন সুনির্দিষ্ট হিসাব কারো কাছে নেই। হেফাজতের কাতার শাখার দায়িত্বশীল সালেহ আহমদ বলেন হেফাজত গঠন করার পর থেকে সর্বাধিক অর্থ পাঠানো হয়েছে কাতার থেকে।

সৌদি আরব শাখার দায়িত্বশীল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানিয়েছিলেন – সেখান থেকে সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছিল প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। ওমান শাখার হাবিবুল্লাহ জানান, ওমান প্রবাসী বাঙ্গালীরা পাঠিয়েছিল প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। আর দুবাই শাখার সভাপতি মাঃ রফিকুল ইসলাম বলেছিল – আরব আমিরাত থেকে তারা পাঠিয়েছিল প্রায় কোটি টাকা। বছরের প্রায় সারা সময়টা জুড়েই শীর্ষস্থানীয় এই নেতারা পালা করে দুবাই, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, পাকিস্থান, আমেরিকা, লন্ডন ও কানাডায় অর্থ সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়ায়।

গত ৪০ বছের বাংলাদেশের জঙ্গিদের অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে ড. আবুল বারকাত মনে করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের মৌলবাদী জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন – গত ৪০ বছের মৌলবাদীদের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নিট মুনাফা হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। এর প্রায় ২০ শতাংশ বা ৮০ হাজার কোটি টাকা সরাসরি ব্যয় হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি কর্মকাণ্ডে। এর একটা বড় অংশই ব্যয় হয়েছে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণে। এছাড়া কর্মীদের বেতন ভাতা ও দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও একই অর্থ ব্যয় হয়েছে।

আর সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা রিফিউজিরা জামায়াত-হেফাজত জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য বয়ে এনেছে অর্থ উপার্জন ও পেশিশক্তি বৃদ্ধি করার আরেক সুবর্ণ সুজোগ। সেই সুযোগটাও এই জঙ্গিরা এখন মহাসমরোহেই কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে।

লেখক: সাইদুল ইসলাম সাউথ ওজন পার্ক ১১৪২০ – নিউ ইয়র্ক


শর্টলিংকঃ