টিকিট বুকিং বাতিলে বিমানের ১০০ কোটি টাকা লোপাট


ভুয়া টিকিট বুকিং এবং সেই বুকিং বাতিল করে চারটি গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (জিডিএস) কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে এক বছরে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

বিমানের একটি উচ্চপর্যায়ের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ এবং অসম চুক্তির ফায়দা নিয়ে এ টাকা হাতিয়ে নেয় অ্যামাডিউস, অ্যাবাকাস, গ্যালিলিও ও সাবরি নামের ৪টি জিডিএস কোম্পানি। ভয়াবহ এ লুটপাটের অন্যতম সহযোগী বিমানেরই তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক ট্রাভেল এজেন্ট।

বিনিময়ে তারাও মোটা অঙ্কের ভাগ পেয়েছে। সম্প্রতি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ লুটপাটের চিত্র উঠে এসেছে।

জিডিএস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিমানের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের কারণ উদ্ঘাটন, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি-এজেন্সি চিহ্নিতকরণ এবং আর্থিক ক্ষতি নিরূপণে সম্প্রতি ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আতিকুল ইসলাম। অন্য সদস্যরা হলেন- মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব যতন মার্মা ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (রেভিনিউ ইন্ট্রিগ্রিটি) আক্তারুজ্জামান মজুমদার।

বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) এনামুল বারী বলেন, চেষ্টা করছি, প্রতিটি শাখা যতটা সম্ভব ঠিক করা। কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। শুনেছি জিডিএস নিয়ে তদন্ত হয়েছে, তবে এখনও রিপোর্ট হাতে আসেনি। তার মতে, এটা কারও ব্যক্তিগত ব্যত্যয় হতে পারে আবার সমষ্টিগতও হতে পারে। তারা খতিয়ে দেখছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ১০ মাসে টিকিট বুকিং বাতিলের জন্য ৪টি জিডিএসকে ৯৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার ৮৮৮ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যার বেশির ভাগ বুকিং ছিল ভুয়া ও উদ্দেশ্যমূলক।

আলোচ্য সময়ে ৫টি দেশের ২২ জন এজেন্ট ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল করেছে এবং ৭টি দেশের ৩১ জন এজেন্ট ৭৫ শতাংশ টিকিট বুকিং বাতিল করেছে। অথচ চুক্তিতে যদি বুকিং বাতিলের জন্য বিল দেয়ার কথা উল্লেখ না থাকত, তাহলে এরকম ভুয়া বুকিং হতো না আর বিলও দেয়া লাগত না।

বিমানের প্ল্যানিং ও মার্কেটিং বিভাগ কৌশলে ৪ জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে এ চুক্তি করেছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে- বিশ্বের কোনো এয়ারলাইন্স কোম্পানির এ ধরনের আত্মঘাতী চুক্তি নেই।

তদন্ত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বিমানের রেভিনিউ ইন্ট্রিগ্রিটি শাখার মাধ্যমে টিকিট বুকিং, ব্লক, ডুপ্লিকেট বুকিং মনিটরিং করার কথা। কিন্তু বাস্তবে কখনোই এ কার্যক্রম সমন্বিতভাবে করা হয়নি।

তদন্ত কমিটি তাদের সুপারিশ হিসেবে বিমানের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম স্বচ্ছ করার জন্য সংস্থার নিয়োজিত অডিট ফার্মের কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়ী এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে। পাশাপাশি বিমানের আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য ৪টি জিডিএসের সঙ্গে করা চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে সংশোধন বা বাতিল করার জন্য বলেছে।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, টিকিট বুকিং দেয়ার জন্য জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা বিমানের স্বার্থবিরোধী। ৩০০ আসনের একটি ফ্লাইটের ২ থেকে ৩ হাজার টিকিট বুকিং রহস্যজনক। বেশির ভাগ বুকিং ভুয়া। যে কারণে এসব বুকিং বাতিলও হয়ে যায়।

প্রতিটি বুকিং ও বাতিলের জন্য জিডিএস কোম্পানিকে বিল গুনতে হয় বিমানকে। অভিযোগ আছে, শুধু জিডিএসের বিল বাড়াতে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি প্রচুর টিকিট বুকিং দেয় আবার তা বাতিলও করে। যার বিনিময়ে ওইসব এজেন্সি জিডিএস কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন পায়।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও এসেছে, জিডিএস কোম্পানিকে যাচাই ও প্রত্যয়ন ছাড়াই টিকিট বিক্রি, বুকিং ও বাতিল ফি দেয়ায় বছরে প্রায় শত কোটি টাকার অনিয়ম হচ্ছে বিমানে।

বিমানেরই একটি সূত্র বলছে, এমিরেটসের মতো বিমান সংস্থা সাশ্রয়ের জন্য এখন আর জিডিএস ব্যবহার না করে ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন ব্যবহার করছে। বিমানেরও ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন আছে; কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এটি ব্যবহার করলে বিপুল অঙ্কের আর্থিক সাশ্রয় হতো। কিন্তু এ নিয়ে বিমানের কোনো উদ্যোগ নেই। আবার কেবল যে টিকিট বিক্রি হয়েছে (ফ্লোন প্যাসেঞ্জারের), শুধু তার ওপর মাশুল নির্ধারণ করে চুক্তি করলেও বিমান লাভবান হতো।

২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন সংস্থার একাধিক তদন্ত রিপোর্টে জিডিএস কোম্পানির ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র উঠে এলেও এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। বিমানের অপসারিত সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদের আমলে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে এ খাতে।

২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক তদন্ত রিপোর্টে এই ৪ জিডিএস কোম্পানি ও ৩০০ ট্রাভেল এজেন্টের ভুয়া টিকিট বুকিং ও বুকিং বাতিলের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য পেয়েছিল মন্ত্রণালয়। অথচ এ সময়ে ট্রাভেল এজেন্টগুলোকে কমিশন বাবদ দিয়েছিল আরও ৩৯ কোটি টাকা।

ওই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে- এ দুই বছরে বুকিং করা যত টিকিট বিক্রি হয়েছে, তার ৮ গুণ বেশি ছিল ভুয়া বুকিং। এসব টিকিট পরবর্তী সময়ে বাতিল করা হলেও সেজন্য বিমানকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। সেই তদন্ত রিপোর্টে অবিলম্বে ৪ জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করে বিমানের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহারের সুপারিশ এলেও সিন্ডিকেট তা করেনি।

বর্তমান তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে- এয়ারলাইন্সে সাধারণত দুইভাবে টিকিট বুকিং বাতিল হয়। একটি- সাধারণ বাতিল বা জেনারেল ক্যানসেলেশন, দ্বিতীয়ত- চুর্নিং। যুক্তিসঙ্গত কারণে টিকিট বুকিং বাতিলকে জেনারেল ক্যানসেলেশন বলা হয়।

যেমন একজন যাত্রী টিকিটের কম দাম ও বেশি কমিশন পাওয়ার জন্য একাধিক এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকিটের প্রাথমিক বুকিং দেন। পরবর্তী সময়ে যাত্রীর সুবিধা অনুযায়ী এবং ভিসা প্রাপ্তির পর যাত্রী টিকিট চূড়ান্ত করেন।

অনেক সময় ভিসা প্রাপ্তি বিলম্ব হলেও টিকিটের বুকিং বাতিল হয়। আর চুর্নিং হচ্ছে- যখন কোনো এজেন্ট একই পিএনআরের (পেসেঞ্জার নেম রেকর্ড) আওতায় কোনো বুকিং চারবারের বেশি বাতিল হওয়া।

অনেক ক্ষেত্রে এজেন্টরা অনৈতিকভাবে ভুয়া নামে টিকিট বুকিং করে রাখে এবং তা বারবার বাতিল করে। বিমান নিয়োজিত এয়ারলজিকার অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমানের সাধারণ টিকিট বাতিল হয় ৬০ শতাংশের নিচে। আর অনৈতিকভাবে বাতিল করা টিকিট বুকিংয়ের হার ৮০-৯০ শতাংশ।

বিমানের সঙ্গে জিডিএসের অসম চুক্তির কারণে প্রতিটি বাতিল বুকিং বাবদ জিডিএসকে বিমান দশমিক তিন পাঁচ থেকে দশমিক চার শূন্য (০.৩৫-০.৪০) ডলার পরিশোধ করছে। এ অসম চুক্তির সুযোগ নিয়ে কিছু এজেন্টের সহযোগিতায় জিডিএসগুলো বিমান থেকে কোটি কোটি টাকা বিল নিয়ে যাচ্ছে।

এসব জিডিএসের সঙ্গে বিমানের চুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। চুক্তিতে সই করেছেন তৎকালীন মার্কেটিং ও সেলসের পরিচালকরা। এক্ষেত্রে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি, যা অযৌক্তিক বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।

তাছাড়া ৪টি জিডিএসের সঙ্গে অনেক আগে চুক্তি করা হয়েছে। যেমন অ্যামাডিউসের সঙ্গে ২০১০ সালে, অ্যাবাকাসের সঙ্গে ১৯৯২ সালে, গ্যালিলিওর সঙ্গে ১৯৯৩ সালে এবং সাবরির সঙ্গে ২০১৩ সালে চুক্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পরও এসব অসম চুক্তি রিভিউ করা হয়নি কিংবা বাতিল করা হয়নি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- চুক্তি অনুযায়ী জিডিএসগুলো একতরফাভাবে শুধু বিমানকে অবহিত করে (৩০ দিন আগে নোটিশ করে) চুক্তিতে বর্ণিত বুকিং ও বাতিল বাবদ প্রাপ্য অর্থের হার বৃদ্ধি করতে পারবে।

ফলে বিভিন্ন জিডিএস একতরফাভাবে বিমানের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই প্রাপ্য অর্থের হার বৃদ্ধি করছে। অ্যামাডিউসের সঙ্গে ২০১০ সালে চুক্তির পর ২০১৫, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে চার্জ বাড়িয়েছে।

১৯৯২ সালে অ্যাবাকাসের সঙ্গে চুক্তির পর তারা ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর চার্জ বাড়িয়েছে। একই অবস্থা গ্যালিলিওর। ১৯৯৩ সালে চুক্তির পর তারা চারবার চার্জ বাড়িয়েছে। সাবরির সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৩ সালে।

তারাও ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চার্জ বাড়িয়েছে। এভাবে প্রতিবছর চার্জ বাড়ানোয় বিমান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিমানের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া হওয়া এসব চুক্তির বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। লোকসান এড়াতে এসব চুক্তি পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপন করে নতুনভাবে সম্পাদনা বা বাতিল করা প্রয়োজন বলেও প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

বর্তমানে বিমানের টিকিট বিক্রির জন্য ৩ হাজার ৫৯৯ জন এজেন্ট আছে, যাদের বিলিং সেটেলমেন্ট প্ল্যান (বিএসপি) লিংক দেয়া হয়েছে। টিকিট বিক্রির জন্য এজেন্ট হিসেবে আবেদন করলে আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠান আইএটিএ’র (ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) তালিকাভুক্ত কিনা এবং আর্থিক সামর্থ্য আছে কি না, তা যাচাই করে এজেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশে এজেন্টের জন্য ঢাকা অফিসের জেনারেল ম্যানেজার ও বিদেশের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কান্ট্রি ম্যানেজার এজেন্ট নিয়োগের অনুমতি দিয়ে থাকেন।

চুক্তি অনুসারে জিডিএসের ওয়েবসাইটে যে কোনো ধরনের লিংক (বুকিং বা বাতিল) হওয়া মাত্র তা একটি একক ইউনিট হিসেবে গণ্য হচ্ছে এবং এর বিপরীতে বিমানকে অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

চুক্তির এ দুর্বলতার কারণে কোনো কোনো এজেন্ট অসাধুভাবে ইচ্ছেমতো টিকিট বুকিং বাতিল করে জিডিএসের সঙ্গে অবৈধ যোগাযোগ রেখে বিমানের আর্থিক ক্ষতি করছে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকিট বুকিং বাতিলের হার ৯৫ শতাংশও হয়ে যায়। চুক্তির এ বিষয়টি বাতিল করে শুধু চূড়ান্ত টিকিটের ক্ষেত্রে চার্জ দেয়ার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির ৮ সুপারিশ : টিকিট বুকিং কারসাজি বন্ধে জিডিএসগুলোর সঙ্গে চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করে সংশোধন বা বাতিল এবং বিমানের রেভিনিউ ইন্ট্রিগ্রিটি শাখার জনবল বৃদ্ধিসহ ৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া জিডিএসের নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইট বা রিজারভেশন পদ্ধতি অথবা মোবাইল লিংকের মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করতে বলা হয়েছে।

একই সঙ্গে ৫টি দেশের ২২ এজেন্ট যারা ৮০ শতাংশের বেশি বুকিং বাতিল করেছে, তাদের বিএসপি লিংক স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করা এবং ৭টি দেশের ৩১ এজেন্টের (যারা ৭৫-৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল করেছে) বিএসপি সাময়িকভাবে স্থগিত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশি এজেন্টদের ট্রাভেল এজেন্ট লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা-যুগান্তর


শর্টলিংকঃ