ট্রাম্প কতটা ‘মহান’ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে


ইউএনভি ডেস্ক:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পুনর্গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জার্মানি এখন বিশ্বের এক বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাত দশক পর বিশ্ব আবার আরেক ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। এ সংকটের কারণ করোনাভাইরাস মহামারি। তবে এবার আর কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার দিকে তাকিয়ে নেই।


অন্যকে সহায়তা দেওয়া তো দূরের কথা, করোনা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই হাবুডুবু খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র চার ভাগ। অথচ দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের মোট সংক্রমণ ও প্রাণহানির প্রায় ২৩ ভাগ। করোনা সংকটে দিশাহীন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির দুই লাখ মাস্ক ছিনতাই করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।

শুধু করোনা মহামারি নয়, বিশ্বে বড় বড় কোনো সংকটেই এখন কেউ আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব আশা করছে না। এক সময় হোয়াইট হাউসের সবুজ সংকেত ছাড়া অনেক স্বৈরশাসকের টিকে থাকা সম্ভব হতো না। এখন কোনো স্বৈরশাসকই হোয়াইট হাউসের কৃপা আশা করে না। বরং রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্টরাই এখন বহুলাংশে বিশ্বের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যেমন- প্রবল গণআন্দোলনের মুখেও বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো রাশিয়ার আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় টিকে আছেন। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বিশ্নেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে মোটেই মহান করতে পারেননি। করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান বর্ণবাদসহ অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র এখন হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দ্রুত ক্ষয়িষুষ্ণ। সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে এক প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র একটি তাৎপর্যহীন দেশের সমর্থন পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্যরাও ওয়াশিংটনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন কার্যত একঘরে।

অথচ একশ’ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের যে কোনো বড় সংকটে সবার দৃষ্টি থাকত হোয়াইট হাউসের দিকে। শুধু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংকটই নয়, অনেক সময় বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায়ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই দিন এখন কার্যত অতীত।
যুক্তরাষ্ট্রের পতনশীল ক্ষমতার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর তাদের সঙ্গেই চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ইরাক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র সেনা কমাচ্ছে, যার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরও প্রভাব বাড়বে ইরানের। বিশ্নেষকরা বলছেন, করোনা সংকটের জেরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে নেতৃত্বের আসন হারাচ্ছে। ভবিষ্যতে তার জায়গা দখল করতে পারে এশিয়া।

অবশ্য অনেকে বিদ্রূপ করে বলে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্র আজও শীর্ষে আছে। সেটা ভিন্নভাবে। কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় দেশটি এখন সবার ওপরে।
ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেই ‘যুক্তরাষ্ট্র ফার্স্ট’ বা যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম নীতির বাস্তবায়ন শুরু করেন। ইউরোপীয়রা দেখেছেন যে তিনি তাদের সঙ্গে কয়েক দশকের মৈত্রীর বন্ধন রাখতে আর আগ্রহী নন। আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে সরে যাচ্ছেন তিনি। ট্রাম্প ন্যাটোকে বলেছেন, সেকেলে এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছেন। ফলে সম্ভবত এক শতাব্দীর মধ্যে এই প্রথম কোনো বৈশ্বিক সংকটে কেউই আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে নেই।

২০১৮ সালের অক্টোবরে খ্যাতনামা গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে বলা হয়, ট্রাম্পের শাসনে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ঐতিহাসিক তলানিতে ঠেকেছে। ট্রাম্পের চেয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বকে বেশি যোগ্য বলে মনে করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। ২৫টি দেশের ২৬ হাজার মানুষের ওপর জরিপটি চালানো হয়। এতে বেশিরভাগ দেশের মানুষই বলেছেন, ট্রাম্পের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই। সে বছর জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি দুই বছরে যা অর্জন করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো প্রেসিডেন্টই পারেননি। এতে বিশ্বনেতারা হেসে ওঠেন।

শীতলযুদ্ধের অবসানের প্রায় তিন দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের গল্প এখন ভিন্ন ধরনের। যে দেশটি ৭৫ বছর আগে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সহায়তা করেছিল এবং পরবর্তী দশকগুলোতে এ মহাদেশে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিল, সে এখন নিজ নাগরিকদের সুরক্ষায় অনেক স্বৈরতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় ঢের পিছিয়ে। আরও দুঃখের ব্যাপার আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছা জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চমৎকার দৃষ্টান্ত রেখেছে। সমালোচকরা বলছেন, করোনা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেই ব্যর্থ হয়নি, বরং নিজ জনগণের পাশেও দাঁড়াতে পারেনি।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রিকার্ডো হাউজমান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেই ব্যর্থ হয়নি, এ সংকটে সে দেশেই জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও চোখে পড়েনি। এক অর্থে এটা খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ব্যর্থতা।

অবশ্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এখনও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আশাবাদী। ফরাসি গবেষক বেঞ্জামিন হাদিদ বলেন, এ মহামারি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের পরীক্ষা নিচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এতে দেশটির কতটা ক্ষতি হবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে হয়তো দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য তৈরি হতেও পারে।

প্যারিসের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ডমিনিক মইসি বলেন, নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইতিহাসের গতিধারা বদলেও যেতে পারে। যেমন ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার জেরে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ঘটেছিল। হয়তো করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও সহজে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার উপযোগী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

অভ্যন্তরীণভাবেও ভালো নেই যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের বড় একটি অর্জন ছিল অর্থনৈতিক সাফল্য। করোনা তাও ম্লান করে দিয়েছে। বেকারত্ব রেকর্ড ভেঙেছে দেশটিতে। সরকারের ঋণ সাত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মোট ঋণ দেশটির জিডিপির প্রায় সমান হবে চলতি বছরের শেষ নাগাদ। গত বছরের চেয়ে সরকারের ঋণ বাড়বে ৭৯ শতাংশ। আগামী বছর জিডিপির চেয়ে বেশি হবে সরকারের ঋণ। এবার সরকার ঋণ নেবে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার। গত বছরের চেয়ে যা তিনগুণ বেশি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বছরে প্রায় চার লাখ কোটি ডলার ব্যয় করে থাকে। এবার করোনার কারণে তিন লাখ কোটি ডলার জরুরি বরাদ্দ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ গত নভেম্বর পর্যন্ত ২৩ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরই বেড়েছে এক লাখ কোটি ডলার। চলতি দশক শেষে সরকারের ঋণ ৩৩ লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

এত ঋণ নিয়ে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র চলছে কীভাবে? তারই এক বিষাদময় চিত্র তুলে ধরেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ। তিনি লিখেছেন, প্রকাশিতব্য সামাজিক উন্নয়ন সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের পতন অব্যাহত রয়েছে। এবার ১৬৩টি দেশের মধ্যে এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ২৮তম। অমিত সম্পদ, অতুলনীয় সামরিক শক্তি ও বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকা দেশটি ২০১১ সালেও ছিল ১৯তম স্থানে। নাগরিক কল্যাণ, পুষ্টি, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করা হয়।

নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষে, তবে মানসম্মত শিক্ষায় প্রবেশগম্যতার দিক থেকে দেশটির অবস্থান ৯১তম। চিকিৎসা প্রযুক্তি তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে সবার ওপরে। অথচ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে দেশটির অবস্থান ৯৭তম। যুক্তরাষ্ট্রে বাল্যবিয়ের হার বেশ উঁচু। সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বৈষম্যে দেশটির অবস্থান শততম।

সিএনএনের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্নেষক পেটার বার্গেন এক নিবন্ধে লিখেছেন, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বারবার বলতেন, অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে উপহাস করে। তখন তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু উপহাসই করে না, তারা আমেরিকানদের সঙ্গে কুষ্ঠরোগীর মতো আচরণ করেন।

ফরাসি রাজনৈতিক পণ্ডিত ডমিনিক মইসি খুব সম্ভবত যথার্থই বলেছেন, ‘২০২১ সালের কোনো এক সময় আমরা করোনা সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। সময়ের বিবর্তনের এরপর আসবে ২০৩০ সাল। তখন বিশ্বে আমরা দেখব এশিয়ার আধিপত্য আর পাশ্চাত্যের ক্ষয়।’


শর্টলিংকঃ