ডিআইজির ভাই পরিচয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে উধাও


নিজস্ব প্রতিবেদক :
কখনো চাকুরি দেবার নামে, কখনো মোটরবাইকের লাইসেন্স ও রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেবার কথা আবার কখনো জমি-বাড়ী বিক্রির নামে বা ব্যাংক থেকে সিসি লোন করে দেবার নামে অথবা ভিসা-পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্নজনের কাছে অন্তত কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে লাপাত্তা রাজশাহীর জাবেদ ইকবাল। 

প্রতারক জাবেদ ইকবাল
 জাবেদ ইকবাল ওরফে মামুন

জাবেদ নিজের পরিচয় দেন পুলিশের একজন ডিআইজির ছোট ভাই হিসেবে, আবার কারো কাছে তিনি এসপির ভাগ্নে । নাম নিয়েও আছে বিভ্রান্তি। কখনো আল মামুন, কখনো এম,এ রাজ, কখনো জাবেদ, কখনো জাবেদ মাসুদ, কখনো বা হৃদয় নাম ব্যবহার কনে তিনি। কিন্তু প্রকৃত নাম হলো জাবেদ ইকবাল। রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানার ফিরোজাবাদ এলাকার বাসিন্দা মরহুম জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে তিনি।

কয়েক মাস পূর্বে ইয়াবাসহ নিজ বাড়িতে গ্রেফতারও হন তিনি। এ সংক্রান্ত আদালতে একটি মামলা চলমান। যার জি.আর মামলা নং – ৯৯/৬৩৯, তারিখ ২৯/৬/২০১৯ ইং।   প্রতারণার  অভিযোগে রাজশাহীর তানোরের মহসিন আলী নামে একব্যক্তির দায়ের করা মামলাও আদালতে চলমান। যার মামলা নং ৭৪সি/১৯ বিজ্ঞ মাজিস্ট্রেট আমলী আদালত, থানা চন্দ্রিমা, রাজশাহী। ধারা ৪০৬ ও ৪২০, তারিখ ২১/৮/১৯। এছাড়াও প্রেমের নামে প্রতারণার অভিযোগে নিয়ে নাটোরের তমালতলা বাগাদিপাড়া এলাকার আরব আলীর পরিবারের সাথেও নাটোর আদালতে একটি পুলিশবাদী মামলা চলমান রয়েছে।এই মামলাতে প্রতারক জাবেদ তিন মাস জেলও খেটেছেন।

জাবেদের বিরুদ্ধে আনীত অসংখ্য অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন রাসিক মেয়রের পিএস টিটো, উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শাহিনুর, নগরীর রাণীবাজারস্থ কে.আর বাইক সেন্টারের স্বত্বাধিকার কোয়েল , চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছত্রাশপুর এলাকার বাসিন্দা জাবেদের দ্বিতীয় স্ত্রীর বান্ধবি ভুক্তভোগী জান্নাতুন, উপশহর এলাকার জন, শাহমখদুম থানার সামনে কাপড় ব্যবসায়ি হাসিবুর, সপুরা মটপুকুর সংলগ্ন বীগ বস্ শোরুমের মালিক স্বাধীন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা স্টেডিয়াম সংলগ্ন মোস্তাক স্টোরের মালিক মোস্তাক, নাটোরের তমালতলা বাগাদিপাড়া এলাকার আরব আলী ও তার ছেলে রিগান, তানোর রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা মহসিন আলী, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড ও বক্ষ্যব্যাধী হাসপাতালে কর্মরত যথাক্রমে আওলাদ ও মনিসহ এলাকার বাসিন্দারা।

প্রতারক জাবেদ ইকবাল
জাবেদ ইকবাল ওরফে মামুন

তার প্রতারণার কাজে সে ব্যবহার করে একাধিক মোবাইল নাম্বার। জাবেদ মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় তার কন্ঠস্বর পরিবর্তন করতে পারদর্শী বলে জানান ভুক্তভোগীরা। জাবেদ ইকবাল মানুষকে তার প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে কখানো নিজেকে পরিচয় দিয়েছে রাসিক মেয়রের ‘পিএস’ টিটু হিসেবে, কখনো বা ডিআইজি বা এসপি’র ছোট ভাই কিংবা ভাগনে হিসেবে, আবার; স্থান ও কাল বিবেচনায় রেখে কখনো নিজেকে উপস্থাপন করেছে বিআরটিএ’র লাইসেন্স কর্মকর্তা। এভাবেই তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বহু মানুষ।

নগরীর অলকার মোড়স্থ ডাচ বাংলা ব্যাংকের নিচে সুমনের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তার একটি ভূয়া পরিচয় পত্র বানানোর জন্য গেলে দোকান মালিক সুমন সেটি করে দিতে অস্বীকার করলে জাবেদ তাকেও দেখে নেবার মতো হুমকি ধামকি প্রদর্শন করেন বলে জানান সুমন।

ভুক্তভোগীরা জানান, জাবেদ ইকবাল বাইরের মানুষের সাথে প্রতারণা করেই ক্ষান্ত হয়নি। জাবেদ ও তার মা নিলুফা বেগম নিজের আত্মীয় স্বজনদের সাথেও প্রত্যারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা। তানোর রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা মহসিন আলীর সাথে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা ছাড়াও স্বাক্ষর সম্বলিত দুটো ফাঁকা চেক ও অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক দুটো স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় বলেও অভিযোগ আছে।

ক্ষতিগ্রস্থ মহসিন আলী হলেন জাবেদের মায়ের ফুপা। ভুক্তভোগী মহসিন ও তার পরিবার জানান, জাবেদ ও তার মা নিলুফা নগরীর ফিরোজাবাদ এলাকায় তাদের নিজস্ব দোতলা বাড়ীটি আমাকে ক্রয় করার জন্য প্রস্তাব দেয়। তাদের দেওয়া লোভনীয় প্রস্তাবে পড়ে তড়িঘড়ি করে নিজের বাপ-দাদার গ্রামের ফসলি জমি বিক্রি করে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে দিয়েছি।

তাদের বাড়ীতে দুটো চেকের পাতা নিয়ে গেলে ঐদিন রাতেই জাবেদ ও তার অন্যান্য সহযোগিরা আমার সামনে চারটি সোনালী রংয়ের গুলি পিস্তলে লোড করে এবং বলে চেকের পাতাসহ দলিলে স্বাক্ষর কর। তার কথা শেষ হবার আগেই পিস্তলের বাট দিয়ে আমার কাঁধে বেশ কয়েকটা আঘাত করে। আমি প্রাণ ভয়ে চেক  ও দলিলে স্বাক্ষর করি।

বিষয়টি পরবর্তীতে ১৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে জানালে জাবেদ দুটি চেক ফেরত দিলেও স্বাক্ষরিত দলিলটি আমি এখনো ফেরত পায়নি। এছাড়াও তানোরের পারিসো দূর্গাপুর ইউনিয়নের মোসলেম চেয়ারম্যানের জামাই এর কাছ থেকে সরকারি চাকুরি দেবার নামে সাত লাখ টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারক জাবেদ।

জাবেদ তার প্রথম স্ত্রীর বান্ধবী চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছত্রাশপুর এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুনকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে সরকারি চাকুরি দেবার নামে তার কাছ থেকেও সাড়ে ছয় লাখ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে নিজেকে আত্মগোপনে রাখেন অনেকদিন। জান্নাতুনকে চাকুরির প্রতিশ্রুতি দেয়ার সময় নিজেকে রাসিক মেয়রের পিএস টিটু বলে পরিচয় দেয়।

এ বিষয়ে রাসিক মেয়রের পিএস টিটো বলেন, জাবেদ রাসিক ও আমার ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি প্রতারণার আশ্রয় নেওয়াতে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়েছে।

পবা নতুন পাড়ার বাসিন্দা শাহমুখদুম থানার সামনে কাপড় ব্যবসায়ী হাসিবুর রহমানকে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা সিসি লোন করিয়ে দেবার নামে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পন্থায় নগদ এক লাখ টাকা ও স্বাক্ষর সম্বলিত ফাঁকা চেক হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক জাবেদ ইকবাল। পরিচয়ের পাল্লা ভারি করার জন্য নিজেকে পুলিশ সুপার রবিউল ইসলামের ভাগ্নে পরিচয় দেন।

হাসিবুর রহমান বলেন, একজন ব্যক্তিকে অগ্রণী ব্যাংকের লোন অফিসার হিসেবে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন জাবেদ। টাকা ও চেকের পাতা হাতিয়ে নেবার পর থেকে সে আর আমার সাথে দেখা করে না। মোবাইল করলেও সে ফোন ধরে না। শেষমেশ তার বাসায় গেলে সে উল্টো আমাকে পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখায়।

নাটোরের তমালতলা বাগাদিপাড়া এলাকার আরব আলীর মেয়েকে বিয়ের জন্য অনৈতিক চাপ  দেন জাভেদ। সুমি ও তার পরিবার জাবেদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে  প্রতারক জাবেদ ঐ মেয়ের পরিবারের বিরুদ্ধে  মিথ্যা খুনের মামলা করানো। তবে এই মিথ্যে মামলার পর জাবেদ ইকবাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মিথ্যা অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশবাদী একটি মামলাও হয় প্রতারক জাবেদ ইকবালের বিরুদ্ধে। যার প্রেক্ষিতে নাটোর জেলহাজতে তিন মাস জেল খাটেন জাবেদ। মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে বলে নিশ্চিত করেন সুমির ভাই রিগান।

সিঙ্গাপুরে লোক পাঠানোর কথা বলে তানোর উপজেলার কামারগা ইউনিয়নের ছাওর গ্রামের মৃত পিয়া মন্ডলের ছেলে মোজাম্মেলকে প্রতারক জাবেদ ইকবাল রাজশাহীর নিজ বাসভবনে কৌশলে ঢেকে এনে নিজের বাড়ীর নিচতলায় আটকিয়ে রেখে পিস্তলের বাট দিয়ে মোজাম্মেলকে একাধিকবার আঘাত করার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে শারিরীক নির্যাতন করে এবং মুক্তিপন হিসেবে দুই লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি ধামকি দেয়। ভুক্তভোগী মোজাম্মেল কোন উপায়ন্তর না দেখে মোজাম্মেলের স্ত্রী এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করে জাবেদের বাড়ীতে এসে দিয়ে যায়।

নগরীর সাগরপাড়া এলাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে ডিআইজির ভাই পরিচয়ে পিস্তুলের লাইসেন্স পাইয়ে দেয়ার  প্রতিশ্রতি দিয়ে ৯৪হাজার টাকা হাতিয়ে গা ঢাকা দেন জাবেদ।

অবিলম্বে জাবেদকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন প্রতারিতরা ।


শর্টলিংকঃ