Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ই–ভ্যালি


ইউএনভি ডেস্ক:

কিনলেই অর্থ ফেরতের অস্বাভাবিক ‘ক্যাশব্যাক’ অফার দিয়ে ব্যবসা করছে বাংলাদেশি ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি অর্থ ফেরত দেওয়ার লোভনীয় এই অফারে হাজার হাজার গ্রাহক আকৃষ্ট হচ্ছেন। লাভবানও হচ্ছেন অল্প কেউ, বেশির ভাগই আছেন লাভবান হওয়ার অপেক্ষায়।

কার্যক্রম শুরুর দুই বছর পার না হতেই এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ব্যবসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক বছর আট মাস বয়সী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে নানা অভিযোগও জমা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরাও আশঙ্কা করছেন, এতে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে।

অনলাইনে পণ্য কিনলে সময় বাঁচে, ঝক্কিও এড়ানো যায়। তাই ঘরের দুয়ারে প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে নিবন্ধন নেয় ই-ভ্যালি। মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোনসেট, টেলিভিশন ইত্যাদি পণ্য বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি গাড়ি বিক্রিতেও নেমেছে।

ই-ভ্যালি জানায়, তাদের নিবন্ধিত গ্রাহক ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মাসে লেনদেন হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকার পণ্য। ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রির বিপরীতে কর দেওয়া হয়েছে দেড় কোটি টাকা। গড়ে প্রতি মাসে পণ্য বিক্রির অর্ডার পাচ্ছে তারা ১০ লাখ করে। তাদের সঙ্গে এরই মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়েছে ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং তারা ৪ হাজার ধরনের পণ্য বিক্রি করে কমিশন পাচ্ছে।

মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন দিয়ে শুরু করা এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এখনো ৫০ হাজার টাকাই। ২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নেয় ই-ভ্যালি ডটকম লিমিটেড। এর অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা। ১০ টাকা মূল্যমানের এক হাজার শেয়ারের মালিক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল। আর চার হাজার শেয়ারের মালিক তাঁর স্ত্রী ও কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল আর শামীমা নাসরিন দিয়েছেন ৪০ হাজার টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রিধারী মোহাম্মদ রাসেল হচ্ছেন ই-ভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা। কর্মজীবন শুরু করেন তিনি ঢাকা ব্যাংক দিয়ে। পরে ছেড়ে দিয়ে ‘কিডস’ ব্র্যান্ডের ডায়াপার আমদানি শুরু করেন। পরে নিয়ে আসেন ই-ভ্যালি। শুরুর দিকে চালু করা হয় ‘ভাউচার’ নামক একটি পদ্ধতি, এতে দেওয়া হতো ৩০০ শতাংশ ও ২০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক। বর্তমানে ১৫০ শতাংশ, ১০০ শতাংশ এবং পরে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাকের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। শুরুর দিকে ১০ টাকায় একটি পেনড্রাইভ এবং ১৬ টাকায় টি-শার্ট বিক্রি করে সাড়া জাগায় ই-ভ্যালি।

দুর্নীতি দূর করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলার পরে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হওয়া অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর সম্প্রতি ই-ভ্যালি নিয়ে ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলেন, পণ্য আছে ৫টি, যেহেতু কেউ জানে না, তাই টাকা জমা দিলেন হয়তো ১০০ জন। পণ্য পাবেন ৫ জন। বাকি ৯৫ জনের টাকা ঝুলে থাকবে। আর সবার বোঝা উচিত যে বিক্রেতা বা কোম্পানি আপনাকে পণ্যের সঙ্গে ১০০ শতাংশ, ১৫০ শতাংশ টাকা ফেরত দিচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে বা পকেট থেকে দেবেন না। দেবেন নিশ্চয়ই অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা অন্য কোনো অনৈতিক উপায়ে।

ই-ভ্যালি একটি পারিবারিক কোম্পানি।

আরজেএসএসি থেকে নিবন্ধন ২০১৮ সালের ১৪ মে।আনুষ্ঠানিক যাত্রা ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা, পরিশোধিত মূলধন ৫০ হাজার টাকা।

প্রতি মাসে লেনদেন এখন ৩০০ কোটি টাকা।

এ পর্যন্ত পণ্য বিক্রি ১,৫০০ কোটি টাকার।

৩৫ লাখ গ্রাহক নিবন্ধিত।

 

অভিনব বিক্রয় পদ্ধতি

গত ২৪ জুন ই-ভ্যালি থেকে দুটি ফ্যান কেনার অর্ডার দিয়েছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা কামরুল আহসান। দাম ৫ হাজার ৮০০ টাকা। তিনি জানান, ই-ভ্যালি তাঁকে বলেছিল ৭ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ফ্যান পৌঁছে দেবে বাসায়। অর্ডারের সঙ্গে ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ২২০ টাকা ক্যাশব্যাক পান কামরুল। এই টাকা ই-ভ্যালির সরবরাহ করা কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে শেষ করেন। কিন্তু দুই মাস হতে চললেও ফ্যান আর পাননি তিনি।

কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যান আমার দরকার ছিল বলেই অর্ডার দিয়েছিলাম। অপেক্ষা করতে করতে একপর্যায়ে বাজার থেকে ফ্যান কিনে ফেলি। ই-ভ্যালি যদি কোনো সময় ফ্যান দেয়ও, তা দিয়ে কী করব, এখন আছি সেই দুশ্চিন্তায়।’

প্রচলিত পদ্ধতিতে পণ্য কেনার সঙ্গে সঙ্গে দাম পরিশোধ করতে হয়। দেশে কিস্তিতে ও বাকিতে পণ্য কেনার সুযোগও তৈরি হয়েছে এখন। আর কয়েক বছরের প্রবণতা হচ্ছে অনলাইনে কেনাকাটা। সে ক্ষেত্রে পণ্য সরবরাহ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম পরিশোধ করতে হয়, যাকে বলা হয় ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’। কিন্তু ই-ভ্যালি এসব পথে হাঁটছে না। ই-ভ্যালি থেকে পণ্য কিনতে গেলেই দাম পরিশোধ করতে হয় আগে।

শুরুতে যে বলা হলো এক লাখ টাকার পণ্য কিনে এক থেকে দেড় লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়, ই-ভ্যালি এই ফেরতের নামই দিয়েছে ‘ক্যাশব্যাক’। ক্যাশব্যাক জমা হয় ই-ভ্যালি ব্যালান্সে। তা–ও আবার তিন দিন পর। এই টাকায় ই-ভ্যালি থেকেই অন্য পণ্য কিনতে হয়। সে ক্ষেত্রে পণ্যের ৬০ শতাংশ দাম গ্রাহক পরিশোধ করতে পারেন ব্যালান্স থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ পকেট থেকে টাকা দিতে হয়।

ই-ভ্যালির রয়েছে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ‘ভাউচার অফার’। আরও রয়েছে ‘ক্যাম্পেইন’ নামক একটি বিকল্প কর্মসূচি। ক্যাম্পেইনভেদে পণ্য সরবরাহ করা হয় ৭ থেকে ৪৫ দিনে। ই-ভ্যালি এ–ও বলছে, অনিবার্য কারণবশত ক্যাম্পেইনে যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পরিমার্জনের সম্পূর্ণ অধিকার ই-ভ্যালি কর্তৃপক্ষের রয়েছে। তবে কিছু গ্রাহকের অভিযোগ হচ্ছে, বেঁধে দেওয়া সময়ে তাঁরা পণ্য পাচ্ছেন না। আর ই-ভ্যালির জবাব হচ্ছে, স্টক থাকা সাপেক্ষে পণ্য দেওয়া হয়, এমনকি চাইলেই গ্রাহকেরা টাকা ফেরত নিয়ে যেতে পারেন।

ঢাকার মিরপুর ডিওএইচএসের বাসিন্দা আমানউল্লাহ চৌধুরী গত ১৪ জুলাই দুদক চেয়ারম্যান বরাবর এক আবেদনে ই-ভ্যালি নিয়ে তদন্ত করার অনুরোধ জানান। যোগাযোগ করলে আমানউল্লাহ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ই-ভ্যালি হচ্ছে ডিজিটাল এমএলএম কোম্পানি। দেশের ই-কমার্স প্ল্যাটফরমকে বাঁচাতে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, অনেক অভিযোগ আসে। এ ব্যাপারেও হয়তো এসেছে। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ই-ভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে ই-ভ্যালিও তাই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে।

পণ্য সরবরাহে ঘাটতি

ই-কমার্সের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সঠিক পণ্য সময়মতো পৌঁছানো। কিন্তু ই-ভ্যালি অনেক ক্ষেত্রেই কাজটি করতে পারছে না। টাকা আটকে রেখে ই-ভ্যালি গ্রাহককে জানিয়ে দিচ্ছে, পণ্যের সরবরাহ নেই (স্টক আউট) বলে অর্ডার বাতিল করা হলো।

‘গিফট কার্ড’ নাম দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছে ই-ভ্যালি। যাঁরা গিফট কার্ড কিনছেন, তাঁরা তাঁদের টাকা ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।

ই-ভ্যালির আরেকটি বিষয় হচ্ছে ‘ই-ওয়ালেট’। ই-ভ্যালিতে পণ্য না পেয়ে অনেক সময় ক্রেতা যখন বিরক্ত হয়ে অর্ডার বাতিল করে দেন, তখন তাঁর টাকা জমা হয় ই-ওয়ালেটে। পণ্যের সরবরাহ না থাকায় ই-ভ্যালি নিজেও বাতিল করে দেয় অর্ডার। তখনো গ্রাহকের টাকা ই-ওয়ালেটে জমা হয়। টাকা আর ফেরত পান না গ্রাহক, বরং অন্য পণ্য কিনে উশুল করতে হয়।

উদাহরণ দিয়ে ই-ভ্যালির বঞ্চিত একজন গ্রাহক জানান, কেউ একজন আসুসের ল্যাপটপ কিনবেন বলে অর্ডার দিলেন। টাকাও জমা দিলেন। এক থেকে দুই মাস পর ই-ভ্যালি তাঁকে জানাল যে পণ্যটির সরবরাহ নেই। সরবরাহ আছে বেশি বেশি দরের অন্য ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ। গ্রাহক সেটাই নিতে বাধ্য হন।

ই-ভ্যালির ওয়েবসাইটে ‘সাপোর্ট’ নামক একটি অপশন রয়েছে। এখানে ফোন করার ও ই-মেইলের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ফোন করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জবাব আসে, ‘আপনার বিষয়টি আমাদের টিম দেখছে। খুব শিগগির আপনাকে কল-ব্যাক করা হবে।’ অথবা বলা হয়, ‘একটু ধৈর্য ধরুন। খুব শিগগির আপনার পণ্যটি পেয়ে যাবেন।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪৫ ধারায় বলা হয়েছে, প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ করা না হলে অনূর্ধ্ব এক বছরের সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ আসছে। প্রতিকারও নিচ্ছি। তবে অনেকে যথাযথভাবে অভিযোগ করতে পারছেন না বলে প্রতিকার পাচ্ছেন না।’

ঢাকার সোবহানবাগ মসজিদের পাশের গলির শেষ মাথায় অবস্থিত ই–ভ্যালি কার্যালয়ে ১৬ আগস্ট কোম্পানিটির এমডি মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। পরে আবার মুঠোফোনে কথা হয় ২০ আগস্ট।

মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ই-ভ্যালির পণ্য বিক্রির পদ্ধতি ঠিকই আছে। ভিন্ন বিপণন পদ্ধতি অনুসরণ করলেও তিনি আইন লঙ্ঘন করছেন না। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘১০০ টাকার যে পণ্যে ১০০ টাকার ক্যাশব্যাক দেওয়া হয়, তার ৬০ শতাংশ ই-ভ্যালির ব্যালান্সে যোগ হয়। ৪০ শতাংশ নতুন করে টাকা দিয়ে গ্রাহককে নতুন পণ্য কিনতে হয়। এতে ই-ভ্যালির লোকসান দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। তবে ওই গ্রাহক যখন অন্য পণ্য কেনেন, তার লাভ থেকে আমরা লোকসান পুষিয়ে নিই।’

মোহাম্মদ রাসেল আরও বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মোবাইল ও মোটরসাইকেলসহ কিছু পণ্য সরবরাহে জটিলতা হয়েছে। তবে পণ্য পাবেন না, এমন অবস্থা হওয়ার সুযোগই নেই।

 

কেন্দ্রীয় সেল এখনো হয়নি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা; স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা; বেচাকেনায় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আস্থা স্থাপন করা; ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করাই নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য।

নীতিমালা প্রতিপালনের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের আওতায় কেন্দ্রীয় সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই সেল ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে। দুই বছরেও সেই সেল গঠিত হয়নি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নোটিশ বোর্ডে এক হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা রয়েছে, যাতে ই-ভ্যালির নাম রয়েছে।

পণ্য বেচাকেনার উঠতি পদ্ধতি ই-কমার্সকে আমরা সমর্থন করছি। সামনে বিপুল সম্ভাবনা। তবে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা মেনে নেওয়া হবে না। ই-ভ্যালি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। খোঁজ নিচ্ছি।

নীতিমালায় ভোক্তা অধিকারের প্রশ্নে বলা হয়েছে, বিক্রীত পণ্য ফেরত, মূল্য ফেরত ও প্রতিস্থাপনের শর্ত ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করবে। কিন্তু ই-ভ্যালির ওয়েবসাইটে তা নেই। আবার নীতিমালায় পণ্য পেয়েই পরিশোধ বা ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হয়েছে, যৌথভাবে যা বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অথচ ই-ভ্যালির ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ পদ্ধতিই নেই।

বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পণ্য বেচাকেনার উঠতি পদ্ধতি ই-কমার্সকে আমরা সমর্থন করছি। সামনে বিপুল সম্ভাবনা। তবে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা মেনে নেওয়া হবে না। ই-ভ্যালি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। খোঁজ নিচ্ছি।’

কেন্দ্রীয় সেল গঠন না করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিজের প্রণীত নীতিমালাই মানছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, কাজটি শুরু হয়েছে। সেল গঠনের কার্যক্রম চলমান।

জানা গেছে, নীতিমালায় সেলের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিনিধি রাখার কথা বলা হয়েছে, আর এ শর্তই হচ্ছে এখন পর্যন্ত সেল গঠিত না হওয়ার পথে অন্যতম বাধা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ শর্ত সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

২০১৩ সালে এমএলএম আইন পাস হওয়ার সময় বাণিজ্যসচিব ছিলেন মাহবুব আহমেদ। গতকাল ই-ভ্যালির বিপণন পদ্ধতি সম্পর্কে জানালে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এর কার্যক্রম তো অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতোই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

ই-ওয়ালেটের লাইসেন্স প্রসঙ্গ

ই-ভ্যালি যে ওয়ালেট পদ্ধতিতে টাকা রাখছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সবিহীন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ৫ মার্চ দেশের সব তফসিলি ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) সেবাদাতা, পেমেন্ট সার্ভিস সেবাদাতা (পিএসপি) এবং পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটরের (পিএসও) উদ্দেশে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বলেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়েই পিএসপি ও পিএসওর মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে, যা আইনসিদ্ধ নয়। কেউ প্রতারিত হলে গ্রাহকদের আস্থা নষ্ট হবে এবং অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো ধরনের ওয়ালেটসেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ই–ভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘শুধু আমরা নই, পুরো ই-কমার্সই এখন উঠতির দিকে। ই-ভ্যালিতে বিদেশি বিনিয়োগ আনারও চেষ্টা করছি। কিছু ভুল থাকতে পারে। তবে ভালো ব্যবসা করছি, ভালো সাড়াও পাচ্ছি। আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে ওয়ালেটের কথা বলছে, আমাদের সে ধরনের ওয়ালেট নেই। তাই লাইসেন্স নেওয়ার দরকার নেই।’

যোগাযোগ করলে কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-ভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটা এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ই-ভ্যালিও তাই করছে। ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। কোম্পানির পরিচালকেরা সক্ষম হলে পরিশোধিত মূলধন বাড়াতে পারতেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে দেখতে পারে।’- প্রথম আলো


Exit mobile version