ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা যা করণীয়


সম্প্রতি জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী রোগটির নাম ডেঙ্গু। এটি ভাইরাসজনিত একটি মারাত্মক রোগ। এই ভাইরাসের নাম ফ্লাডি ভাইরাস। এডিস মশার কামড়ে বিশেষ করে এডিস এজিপটাইয়ের মাধ্যমে এটা ছড়িয়ে পড়ে। এডিস এলবোপিকটাস মশাও ডেঙ্গুর ভাইরাস বহন করে। মশা দেখতে গাঢ় নীলাভ কালো রঙের, মশার সমস্ত শরীরে আছে সাদা সাদা ডোরা কাটা দাগ।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব প্রজাতির মশা পাওয়া যায় থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, ফিলিপাইন, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বিশেষ করে পোর্টেরিকা, কিউবা, মধ্য আমেরিকা ও আফ্রিকাতে। কেবল উষ্ণ আবাহওয়ায় এই মশা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর সুপ্তাবস্থায় থাকে ৩-১৫ দিন (সাধারণত ৭-১০ দিন)। ১৯৮৬ সালে আমেরিকার দক্ষিণ টেক্সাসে ডেঙ্গু রোগটি মহামারী আকারে দেখা দেয়। মহামারী ঘটে রেইনোসার মেক্সিকো সীমান্তে।

বাংলাদেশেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকবার। এডিস মশাবাহিত চার ধরনের ভাইরাসের যেকোনো একটি সংক্রমণে যে অসুস্থতা হয় সেটাই ডেঙ্গু। এর সাধারণত দুটো ধরন রয়েছে। এক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর; দুই. হেমোর‌্যাজিক ডেঙ্গু জ্বর বা ডেঙ্গু হেমোর‌্যাজিক ফিভার। শেষেরটাই সবচেয়ে ভয়াবহ।

সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হলে রোগীর প্রচণ্ড জ্বর (১০৩ থেকে ১০৬ ডিগ্রি), শরীর এবং গিরায় গিরায় ব্যথা, যাকে বলে হাড়ভাঙা জ্বর বা ব্রেকবোন ফিভার, চার থেকে পাঁচ দিন পরে জ্বর কমে যায় এবং গায়ে র্যাশ ওঠে। এই সময় জ্বর কমে যাওয়ার পরপরই রক্তের প্লাটিলেট কমে যায় ও রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে। আর বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের ধরন পালটে যাওয়ার কারণে দেখা যায়, জ্বর অল্প অল্প থাকে, শরীরে তেমন ব্যথাও হয় না, এমনকি অধিকাংশ রোগীর গায়ে র‌্যাশ হচ্ছে না।

আবার এমনও দেখা যায়, জ্বর হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পরই প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, আর এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। এ বছর যারা মারা গেছেন তারা কিন্তু সামান্য জ্বর মনে করে অবহেলা করেছেন এবং চিকিৎসকের পরামর্শও হয়ত বা নেননি। এ কারণে রোগীরা বুঝে উঠার আগেই প্লাটিলেট কমে রক্তক্ষরণ এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

ডেঙ্গু জ্বর প্রথমবার হলে বেশি জটিল হয় না। যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি। যাদের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তারা আগে সম্ভবত আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এ জন্য রোগীদের প্রতি পরামর্শ, যেহেতু বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, তাই যেকোনো ধরনের জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না।

সামান্য জ্বর হলেও তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডেঙ্গু হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। বিশেষ করে যারা প্রথমবার আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেই ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই এ ধরনের রোগীদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

রোগীদের প্রতি আরো পরামর্শ, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল এবং তরল জাতীয় খাদ্য যেমন পানি, শরবত ইত্যাদি বেশি খেতে হবে। প্রচণ্ড ব্যথা হলেও অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ দোকান থেকে কিনে খাওয়া যাবে না, এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়বে। মনে রাখতে হবে, শরীরের যে কোনো অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হলে, খেতে না পারলে বা প্রচণ্ড বমি হলে, গর্ভবতী কোনো মহিলা আক্রান্ত হলে এবং যারা অন্যান্য রোগে ভোগেন যেমন হূদেরাগ, লিভার বা কিডনির রোগ, তাদের অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়:
ডেঙ্গুর কোনো ভ্যাকসিন নেই। যেহেতু ডেঙ্গু ভাইরাস চার টাইপের, তাই এই চারটি ভাইরাসের প্রতিরোধে কাজ করে, এমন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো—অ্যাডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, অ্যাডিস একটি ভদ্র মশা, অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় এরা বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে।

ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে অ্যাডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একইসঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো—ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং অ্যাডিস মশা প্রতিরোধ।

সতর্কতা:
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সতর্কতার গুরুত্ব অপরিসীম। মনে রাখতে হবে:

* অ্যাডিস মশা মূলত দিনের বেলা, সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়, তবে রাত্রে উজ্জ্বল আলোতেও কামড়াতে পারে।

* দিনের বেলা যথাসম্ভব শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, প্রয়োজনে মোজা ব্যবহার করা উচিত। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।

* প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।

* বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট বা পায়জামা পরাতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, ডেঙ্গু জ্বর হয়তোবা নির্মূল করা যাবে না, এর কোনো ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী ঔষধও আবিষ্কৃত হয়নি। ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গু জ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।


শর্টলিংকঃ