ডেলটা প্ল্যান ২১০০ : সরকারের এ মহাপরিকল্পনায় যা থাকছে


ইউএনভি ডেস্ক:

ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা শতবর্ষী ডেলটা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’কে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে দেখছে সরকার। বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে আলোচিত ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পনি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্য নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন। এই ছয়টি হলো ডেলটা প্ল্যান-এর ছয় স্তম্ভ।

এরইমধ্যে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত ‘ডেলটা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল’। ২০২০ সালের ১ জুলাই ১২ সদস্যের এই কাউন্সিল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীকে ডেলটা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

গভর্ন্যান্স কাউন্সিল ও তহবিলের উৎস

ডেলটা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, পানি সম্পদমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্যকে এই কাউন্সিলের সদস্য সচিব করা হয়েছে।

ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য এই মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে ৮০টি প্রকল্প।

এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৩ হাজার ১৪৫ বিলিয়ন টাকারও বেশি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলো কখনও একক আবার কখনও যৌথভাবে কাজ করছে।

জানা গেছে, সরকারের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার প্রধাম ধাপে অর্থাৎ আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য ৮০টি প্রকল্প ব্যায়ের অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে প্রতিবছর জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ২ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। বাকি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটি তৈরিতে নেদারল্যান্ডস সরকার এরই মধ্যে ৮৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

এই মহাপরিকল্পনায় বাংলাদেশ ডেলটা তহবিল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল, বিশেষ করে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব পিপিপি পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হয়েছে।

অর্থায়নের ক্ষেত্রে ‘কস্ট রিকভারি’র জন্য ক্রমান্বয়ে বেনিফিশিয়ারি পে প্রিন্সিপাল নীতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বড় শহরগুলোতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতে পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওএন্ডএম) ব্যয় আদায়ের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা কার্যকর করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে এবং তা পর্যায়ক্রমে অনান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে।সরকারের শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় থেকে রক্ষার কৌশল খুঁজে বের করাকে। এরপর রয়েছে পানির নিরাপত্তা। এ ছাড়া টেকসই নদী-অঞ্চল, জলাভূমি সংরক্ষণ, আন্তঃদেশীয় নদীর পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে ডেলটা পরিকল্পনায়।

image2 (10)
ছয়টি হটস্পট
হটস্পট ও সমস্যা

ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও শেরপুর; এই জেলাগুলো সমুদ্র ও প্রবহমান নদী থেকে অবস্থানগত দূরত্বের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিমুক্ত।

বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ জেলা ১৮টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন উপকূলীয় জেলা ১৯টি। হাওর ও আকস্মিক বন্যাকবলিত জেলা সাতটি। নদী অঞ্চল ও মোহনাবেষ্টিত জেলা ২৯টি। নগর এলাকা সাতটি এবং পার্বত্য জেলা তিনটি। সরকার চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকা ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে।

চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ছয়টি হটস্পট। যেগুলো মূলত পানি ও জলবায়ু উদ্ভুত অভিন্ন সমস্যাবহুল অঞ্চল। এগুলো হচ্ছে-২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চল। ২২ হাজার ৮৪৮ বর্গ কিলোমিটারের বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল। ১৬ হাজার ৫৭৪ বর্গ কিলোমিটারের হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। ৩৫ হাজার ২০৪ বর্গ কিলোমিটারের নদী অঞ্চল এবং মোহনা এবং ১৯ হাজার ৮২৩ বর্গ কিলোমিটারের নগরাঞ্চল।

পরিকল্পনায় হটস্পট-ভিত্তিক সমস্যাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা। নদী ও উপকূলীয় এলাকায়- ভাঙন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া। বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ এলাকার সমস্যা-স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশের অবনমন। হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের সমস্যাগুলো হচ্ছে- স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, আকস্মিক বা মৌসুমি বন্যা, জলাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত নিস্কাশন, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিস্কাশন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যাগুলো হচ্ছে- স্বাদু পানির স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ও ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র সংরক্ষণ। নদী অঞ্চল ও মোহনার সমস্যা-বন্যা, পরিবেশের অবনমন, পানিদূষণ, পলিব্যবস্থাপনা ও নৌ-পরিবহন, নদীগর্ভের পরিবর্তন, ভাঙন ও নতুন চর জেগে ওঠা। এর মধ্যে যমুনায় ভাঙন ১৭৭০ হেক্টর, পদ্মায় ভাঙন ১২৯৮ হেক্টর, মেঘনার অববাহিকায় ২৯০০ হেক্টর।

১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সাল নাগাদ নতুন চর জেগে উঠেছে মোট ৫২ হাজার ৩১৩ হেক্টর জমি। এ ছাড়া নগরাঞ্চলের সমস্যা হচ্ছে-অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতা, স্বাদু পানির পর্যাপ্ততা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। মহাপরিকল্পনায় প্রত্যেকটি হটস্পটেই পরিবেশের অবনমনকে সাধারণ সমস্যা হিসেবে ধরা হয়েছে।

মিশন ও লক্ষ্য

সরকারের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার রূপকল্প, মিশন ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এই পরিকল্পনার রূপকল্প হচ্ছে-নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ্বীপ গড়ে তোলা। মহাপরিকল্পনার মিশন হচ্ছে- দৃঢ়, সমন্বিত ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল কার্যকরী কৌশল অবলম্বন, এবং পানি ব্যবস্থাপনা ন্যায়সঙ্গত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এবং অন্যান্য ব-দ্বীপ সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলা করে দীর্ঘমেয়াদী পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

পরিকল্পনায় জাতীয় পর্যায়ের লক্ষ্যগুলো হচ্ছে- ১। ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ। ২। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যদা অর্জন এবং ৩। ২০৪০ সাল নাগাদ একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যদা অর্জন।

‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’-এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হচ্ছে ৬টি। এগুলো হলো ১। বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২। পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা। ৩। সমন্বিত ও টেকসই নদী অঞ্চল এবং মোহনা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। ৪। জলবায়ু এবং বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং সেগুলোর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা। ৫। অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন গড়ে তোলা এবং ৬। ভূমি ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা।

পাঁচ বছর পর পর হালনাগাদ

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মূল কারিগর পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) শামসুল আলম জানিয়েছেন, ‘কয়েক ধাপে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়ন করা হবে। ২০৩১ সাল নাগাদ থাকবে প্রথম ধাপ। ২০৩১ থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ, এবং এরপর তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২১০০ সাল।’

পরিকল্পনা কমিশন পাঁচ বছর পর পর পুরো ব-দ্বীপ পরিকল্পনার তথ্য হালনাগাদ করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শামসুল আলম জানিয়েছেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কত টাকা খরচ হতে পারে, তারও একটি ধারণা দিয়েছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। এই মোতাবেক কাজ এগিয়ে নিলেই শতবর্ষী এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।


শর্টলিংকঃ