ঢাকাকে বেইজিংয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার দুশ্চিন্তা বিজেপিতে


ইউএনভি ডেস্ক:

যে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ভারতব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ চলছে, সেই আইনটি প্রতিবেশী বাংলাদেশকে আরও বেশি করে চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করবে বলে ক্ষমতাসীন বিজেপির ভেতর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দলীয় নেতৃত্বের একটা অংশ খোলাখুলি সে কথা বলতেও শুরু করেছেন।

আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক এবং বর্তমানে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য শেষাদ্রি চারি এ বিষয়ে এ সপ্তাহেই একটি নিবন্ধ লিখে দলকে খোলাখুলি বিষয়টি নিয়ে সাবধান করে দিয়েছেন।

‘দ্য প্রিন্ট’ পোর্টালে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে শেষাদ্রি চারি লিখেছেন, ‘নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে যে ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা চলছে তাতে বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠানবিরোধী শক্তিগুলো এই ধরনের ভুয়া প্রচার চালানোর সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। এর ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার ঢল নামবে।’

‘যদিও বাস্তবে সেই (এক্সোডাসের) সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরেও বাংলাদেশে গুজব তৈরির কারখানাগুলো কিন্তু এর মাধ্যমে বহু বছর ধরে দু’দেশের মধ্যে গড়ে তোলা বন্ধুত্বকে মাত্র কয়েক মিনিটে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে’, সরাসরি এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিজেপির ওই তাত্ত্বিক নেতা।

গোটা বিষয়টি যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ‘রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ফেলার মতো’, সে কথাও জানিয়েছেন শেষাদ্রি চারি। আর এরই মাঝে খবর এসেছে, ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রথমবারের মতো মুখ খুলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধ্যপ্রাচ্যের ‘গালফ নিউজ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভারত যে কেন এই নাগরিকত্ব আইনটি আনতে গেল, তা আমার মাথাতেই ঢুকছে না। এর কোনও প্রয়োজনই ছিল না!’বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া যে আসতে পারে, এই আশঙ্কা কিন্তু বিজেপির ভেতরেও ছিল।

বিজেপির একাধিক প্রথম সারির নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কূটনৈতিকভাবে এই নাগরিকত্ব আইনের অস্বস্তিকর বিষয়টি বাংলাদেশ বা আফগানিস্তানের মতো মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে কীভাবে সামলানো হবে তা নিয়ে দলের ভেতরেও বিস্তর চর্চা চলছে। বিজেপির ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সেলের প্রধান ড. বিজয় চৌথাইওয়ালে এই বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করছেন।

এই বৈঠকগুলোর কয়েকটিতে হাজির ছিলেন এমন এক বিজেপি নেতার কথায়, ‘মুশকিল হল ঘরোয়া রাজনীতি আর কূটনীতির স্বার্থ সব সময় মেলে না। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেটা আমাদের সুবিধা দেবে বলে মনে করছি, ঠিক সেটাই আবার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কাজটা কঠিন করে তুলতে পারে – আর এখানেও ঠিক সে জিনিসই ঘটছে!’

সে কারণেই একদিকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি ও এমপি দিলীপ ঘোষ প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছেন ‘এক কোটি অবৈধ বাংলাদেশিকে আমরা ফেরত পাঠাবো’ – তখনই আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বারে বারে ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে নাগরিকত্ব আইন বা এনআরসি পুরোপুরি ভারতের ‘নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়’।ভারতের এই বিচিত্র স্ববিরোধিতার মধ্যেই এখন আবার দিল্লি বাংলাদেশে নতুন বিপদের ছায়া দেখছে – আর সেটা চীনা ড্রাগনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের।

বিজেপি নেতা শেষাদ্রি চারি তার নিবন্ধে এটাকেই বর্ণনা করেছেন ‘চাইনিজ পাজল’ বা ‘চীনা ধাঁধা’ হিসেবে। তিনি বলছেন যে চীন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাবকে খুব স্বস্তির চোখে দেখেইনি, তারাই কিন্তু আজ সে দেশে ঢালাও বিনিয়োগ করছে।

দু‘দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে তারা উন্নীত করেছে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপেও, বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে তারা জোগাচ্ছে মিং-ক্লাস সাবমেরিন। বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগ ছাপিয়ে গেছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।ঘটনাচক্রে ঠিক এই সময়েই বাংলাদেশে বৃহত্তম বিদেশি লগ্নিকারী দেশ হিসেবেও আমেরিকাকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে চীন। আর এই তথ্য প্রমাণিত বাংলাদেশের সরকারি ডেটাতেই।

রেডিও ফ্রি এশিয়ার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের (প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ) পরিমাণে ২০১৮ সালে শীর্ষস্থানটি দখল করে নিয়েছে চীন।

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) মহাপরিচালক শামস আল-মুজাহিদকে উদ্ধৃত করেই ওই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমটি এই তথ্য দিয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশের চীনা লগ্নির বেশিটাই এসেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে।

বাংলাদেশে ব্যবসা ও লগ্নি বাড়াতে মরিয়া ভারতের জন্য এটা যে কোনও সুখবর নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র জোড়া ফলা দু’দেশের সম্পর্কে অস্বস্তিকেই আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির অনেক নেতাই ভেবে কুল পাচ্ছেন না, নিজেদের হিন্দুত্বর রাজনীতি বহাল রেখেও কীভাবে সেই অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

উৎস: বাংলা ট্রিবিউন


শর্টলিংকঃ