Site icon ইউনিভার্সাল ২৪ নিউজ

ঢিমেতালে নজরদারি, বিতর্কিতরা প্রকাশ্যে


ইউএনভি ডেস্ক: 

দেশজুড়ে আলোচিত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের এক বছর পূর্ণ আজ শুক্রবার। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই অভিযানের পর অনেক দুর্নীতিবাজের সাম্রাজ্যের পতন হয়। ওই শুদ্ধি অভিযানকালে গ্রেপ্তার এড়াতে অনেক রাঘববোয়াল গা-ঢাকা দেন। কেউ কেউ দেশও ছাড়েন। সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ে অভিযানের গতি।

এতে আবার অনেক বিতর্কিত লোকজন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন। গ্রেপ্তার হওয়া কেউ কেউ জামিনে রয়েছেন। ঢাকার ক্লাবপাড়াকেন্দ্রিক ক্যাসিনো খেলা পুরোপুরি বন্ধ হলেও অনেকে অনলাইনে নিত্যনতুন কৌশলে জুয়ার আসর বসাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ক্যাসিনোবিরোধী ৪৯টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ৩২টি র‌্যাব ও ১৭টি অভিযান চালায় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় অন্তত ২৮০ জনকে। ক্যাসিনোবিরোধী এসব অভিযানের ঘটনায় ৩২ মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০টি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ-র‌্যাব। অন্যান্য মামলার তদন্ত চলমান।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর দলের যৌথ সভায় দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেন। এরপর দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। ওই সভায় যুবলীগের দুই নেতার সমালোচনা করা হয়। এর পাঁচ দিনের মাথায় ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম গ্রেপ্তার হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। খালেদকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান।

এরপর একে একে অনেক রাঘববোয়াল ধরা পড়েন। এর মধ্যদিয়ে ক্লাবপাড়া ঘিরে সংঘবদ্ধ দুষ্টু চক্রের নানা অনিয়মের তথ্য সামনে আসতে থাকে। একে একে অনেকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার হতে থাকেন। পুলিশ ও র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব ও বারে অভিযান চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতার বাসায়ও তল্লাশি করা হয়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলেন যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট।

তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ঘিরে নানা নাটকীয় ঘটনাও ঘটে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর চাঁদাবাজি, টেন্ডারিবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে আলোচনায় আসে সম্রাটের নাম। যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তারের পর কয়েকদিন শত শত নেতাকর্মীকে নিয়ে কাকরাইলের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের ১৯ দিনের মাথায় গ্রেপ্তার হন সম্রাট। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন ঠিকাদার মোগল জিকে শামীম, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের এনামুল হক আরমান, অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধান, কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান রাজীব, ময়নুল হক মনজু, ক্যাসিনো কারবারি আক্তারুজ্জামান, রোকন মিয়া, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সাইফুল ইসলাম, তুহিন মুন্সী, নবীর হোসেন এবং পুরান ঢাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা দুই ভাই এনু ও রুপন। এসব অভিযানে অনেকের বাসা থেকে কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করা হয়।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাবেক দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমানসহ আরও অনেকের ব্যাংক হিসাব তলব করে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিন সংসদ সদস্যসহ ২৩ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

একাধিক সূত্র জানায়, অভিযানের পর গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন- এমন অনেককে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের জুয়ার আসরের ইজারাদার আলী আহমেদ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস এম রবিউল ইসলামসহ আরও অনেকে। কেউ কেউ জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছেন। সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজু জামিন পেয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জামিনে আছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারাবাহিক তৎপরতায় বন্ধ হয়েছিল অবৈধ ক্যাসিনো, ক্লাব ও জুয়ার কার্যকলাপ। বিভিন্ন মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এ অভিযান। তবে মানুষের প্রত্যাশার পারদ যতটা চড়েছিল, তা পূরণের আগেই আস্তে আস্তে অভিযানের গতি কমতে শুরু করে। র‌্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযান পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে যে কোনো সময় আবারও অভিযান চলবে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের সদ্য সাবেক ডিআইজি ও র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, সিআইডিতে তদন্তাধীন বেশ কিছু মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তারকৃতদের সম্পদের হিসাব জানতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সমকালকে বলেন, সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এক বছর আগে শুরু করা র‌্যাবের অভিযান সব মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এ পর্যন্ত মোট ১১টি ক্যাসিনো ও ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। এর মধ্যে ঢাকায় আটটি ও তিনটি চট্টগ্রামে। অভিযানে ৯ জন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি গ্রেপ্তার ছাড়াও বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ২২টি অস্ত্র এবং নগদ-এফডিআর মিলিয়ে ১৭২ কোটি টাকা জব্দ করা হয়।

এসব ঘটনায় দায়ের ৩২টি মামলার মধ্যে ১৪টির তদন্ত করে র‌্যাব। এরই মধ্যে ১৩টি মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ফু-ওয়াং ক্লাবের মামলাটির তদন্ত আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২০১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছে।

র‌্যাবের এই মুখপাত্র বলেন, অভিযান ঝিমিয়ে পড়েনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অভিযান চালানো হবে।


Exit mobile version