‘তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর’


হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘একজন সুখী মানুষ” গল্পটা পড়েছেন হয়তো অনেকেই।

গল্পটা খুব অদ্ভুত একটা প্রেমের গল্প। খুবই ইউনিক গল্পের প্লটঃ একটা মানুষের সাথে একটা পুরাতন মূর্তির প্রেম। প্রেম মানে “প্যাশন” বা ওই টাইপের কোনো বিষয় নয়, সত্যি সত্যিই প্রেম। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি করে বিদেশিদের কাছে বিক্রির কাজ করে এক লোক। ঘটনাচক্রে চুরি করে আনা একটা পুরাতন নারীমূর্তির সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। বিশদ জানতে হলে গল্পটা পড়তে হবে। ছোট্ট একটা গল্প, তবে মনে প্রভাব রেখে যাবে বেশ ভালোভাবেই।

তো এই অদ্ভুত ধরনের প্রেমের গল্পের “ইউনিক” কনসেপ্ট আসলে খুব একটা ইউনিক না। এই ধরনের অদ্ভুত প্রেমের গল্প খোঁজ করলে পাওয়া যাবে আরও।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়ঃ ২০১৩ সালে অস্কারে ফাইট দেয়া ছবি “Her” – এইটার প্লট আরও সাংঘাতিক। মানুষের সাথে একটা অপারেটিং সিস্টেমের প্রেম। মোরশেদুল ইসলামের ছবি “চাকা” একই ধরনের টপিকের সাথে বেশ ক্লোজলি রিলেটেড, মানুষের সাথে একটা মৃতদেহের সম্পর্ক।

এছাড়াও ঋত্বিক ঘটক বানিয়েছিলেন “অযান্ত্রিক”, একটা মানুষের সাথে একটা গাড়ির প্রেম, এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। তবে এই পর্যন্ত আমার পড়া আর দেখা মিলিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রেমের গল্প যেটা পেয়েছি, সেটার নাম হচ্ছে  “The Theory of Everything.”

এই লেখাটা সেই অদ্ভুত প্রেমের গল্প “থিওরি অফ এভরিথিং” বিষয়ে।

থিওরি অফ এভরিথিং, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর জীবন কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটা হলিউডি ছবি। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে স্টিফেনের হকিং চরিত্রে অভিনয় করে অস্কার পেয়েছিলেন অভিনেতা এডি রেডমেইন।

স্টিফেন হকিং-কে আপনারা সবাই চেনেন, তার মোটর নিউরন রোগটার ব্যাপারেও সবাই জানেন। স্টিফেন যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিলো, তখন এই রোগ তার মধ্যে ডেভেলপ করে। সহপাঠী “জেন”-এর সাথে স্টিফেনের প্রেম হবে হবে – এমন একটা ভাব ছিলো, তবে কেউ কাউকে প্রপোজ করেনি।

যে মুহুর্তে জেন জানতে পারলো যে স্টিফেন আর বাঁচবে না, ঠিক সেই মুহুর্তেই জেন স্টিফেনকে প্রপোজ করে। এই জেনই হচ্ছেন মহীয়সী নারী জেন বেরিল ওয়াইল্ড। স্টিফেন হকিং-এর স্ত্রী জেন হকিং নামে যাকে সবাই চেনেন।

এই যে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে যাকে এখন বিবেচনা করা হয়, তিনি পুরোপুরি পঙ্গু একজন মানুষ। কথাও বলতে পারেন না, নড়াচড়াও করতে পারেন না, কিছুই পারেন না তিনি। শুধুমাত্র তার শরীরের সাথে কানেক্টেড একটা কম্পিউটারের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে তিনি সামান্য কিছু ভাব বিনিময় করতে পারেন।

স্টিফেন হয় মারাই যেতেন, নয়তো পর্যাপ্ত পার্সোনাল সাপোর্টের অভাবে জীবনে কিছুই করতে পারতেন না। সেই স্টিফেন হকিং-কে একটা শিশুর মতো লালন-পালন করে, হাত ধরে ধরে, কাঁধে ভর দিয়ে, এক জীবন পার করিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য তার স্ত্রী জেন হকিং-এর অবদানকে অসামান্য বললেও কম বলা হয়ে যাবে।

উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন জেন, তিরিশটা বছর ছায়ার মতো ছিলেন স্টিফেনের সাথে, তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে।

পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে এসে জেনের জীবনে প্রবেশ ঘটে জোনাথন জোন্স নামে এক ভদ্রলোকের। তারা পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে স্টিফেনের সাথে ডিভোর্স হয়ে যায় জেনের। স্টিফেনের সংসার ছেড়ে যাওয়ার আগে জেন শেষ যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা মহা গুরুত্বপূর্ণঃ

“আমি হয়তো তোমার জন্য সবকিছু করে যেতে পারলাম না, কিন্তু আমি আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটা করেছিলাম।”

পৃথিবীতে যে কোনো বিষয়ের সারাংশ বা সারমর্ম এই সামান্য কথাটাঃ “আমরা সবাই হয়তো সবকিছু পারি না, কিন্তু নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ করতে পারাটাই হচ্ছে থিওরি অফ এভরিথিং।”

বাইরের মানুষ ভাবছে, “পঞ্চাশ বছর বয়সে মহিলার কী এমন ভীমরতি ধরলো যে পরকীয়া করে চলে যেতে হলো আরেক জনের সাথে ?”

কিন্তু গল্পের ভেতরটা যদি আমরা দেখতে যাই, তাহলে বিবেচনা করতেই হবে, দুই চোখে স্বপ্নের পাহাড় নিয়ে বেড়ে ওঠা একটা উনিশ বছর বয়সী মেয়ে বিয়ের পর থেকে তার জীবনে অলমোস্ট কিছুই পায়নি। জীবিত এবং মৃত অবস্থার মাঝামাঝি একটা বেঁচে থাকা লাশের সাথে তাকে কাটিয়ে দিতে হয়েছে একটা জীবন। সে ভালোবেসেছিলো একটা বেঁচে থাকা লাশকে।

নিজের সবটুকু উজাড় করে সেই মেয়ে যতোটুকু সম্ভব একটা মানুষের পক্ষে দেয়া, সবটুকুই দিয়েছে। মেয়েটারও হয়তো জীবনে অনেক কিছু করার ইচ্ছা ছিলো, যেগুলোর কোনোটাই পূরণ হয়নি। স্টিফেন হয়তো সঙ্গী হিসাবে ভালোই ছিলেন, কিন্তু এক জীবনে কিছুই না পাওয়া একটা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার কি কোনো মূল্য নেই ?

ঠিক এই জায়গাটা থেকে আমাদের জেন হকিং-এর পরকীয়ার অপরাধটা ক্ষমা করে দিতে হয়, তার নতুন সম্পর্ককে স্বাগত জানাতে হয়। ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে হয়, অভিনন্দন জেন হকিং, যথেষ্ট করেছো তুমি। স্টিফেনের জীবনে তোমার অবদান আমরা কেউ ভুলবো না। আগামী জীবনের জন্য শুভকামনা জেন হকিং।

তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।

শুভজিৎ ভৌমিক, সংস্কৃতিকর্মী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


শর্টলিংকঃ