দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে ঝড়ের ঘনঘটা


আফ্রাসিয়াব খটক, করাচি :

পাকিস্তান-ভারতের বৈরিতায় সব সময় উদ্বেগের মোড়কে বিপদ থাকে। দুই দেশ এখন চোখে চোখ রেখে যে লড়াইতে নেমেছে, তার শুরুটা হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে।

পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জইশ-ই-মুহাম্মদের পরিচালিত ওই হামলা পরিস্থিতিকে খারাপ থেকে আরও খারাপ হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘটেছে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের মানশেহরা জেলায় বোমা ফেলেছে। যদিও এলাকাটা কাশ্মীরের বিরোধপূর্ণ এলাকার বাইরে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আর সামরিক নেতৃত্ব নিজেদের পছন্দের সময় ও স্থানে হামলার অঙ্গীকার করেছিলেন।

ভারতের হামলার ২৪ ঘণ্টার মাথায় পাকিস্তান তাদের অংশের নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলওসি) দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। পরিস্থিতি নাজুক হলেও শান্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের অঙ্গীকার আশা জাগায়।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে অতীতে রাষ্ট্রের বহির্ভূত শক্তিগুলো ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে হামলা চালিয়ে সে দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সরকারের শান্তি প্রক্রিয়ার উদ্যোগের বাঁক পরিবর্তনে বাধ্য করত।

এবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া যখন দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন তা নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়েছে ওই শক্তি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতের নীতিনির্ধারকেরা সন্ত্রাসীদের সর্বশেষ উসকানিকে ভালোভাবে নেননি।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রথমত, বিরোধী দল কংগ্রেস ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে সব সময় নরম থেকেছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বরাবরই এই অভিযোগ করে আসছে মোদির দল। মোদি এটা পরিবর্তনের শপথ নিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন সামনে রেখে মোদির দলের বিজয়ের সম্ভাবনা ততটা উজ্জ্বল নয়। অন্তত গত নির্বাচনের তুলনায়। তাঁর ভোটারদের উপস্থিতি মূলত ভারতের উত্তর আর মধ্যাঞ্চলে। সেখানে হিন্দুত্ববাদ উসকে দিতে হলে তাঁকে তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পেশির জোরটা দেখাতেই হবে।

তৃতীয়ত, কাশ্মীরের অস্থিরতা আর বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে চলেছে। কাশ্মীরের এখনকার প্রতিরোধটা মূলত আদি বাসিন্দারা করলেও পাকিস্তানভিত্তিক জিহাদি আর জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডকে ভারতকে বিষয়টির আন্তর্জাতিক মাত্রা দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

অন্যদিকে, ২০১৮ সালের জুলাইতে কারচুপির ভোটে নির্বাচিত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল, সেটা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কারণ, একটি সাজানো সেনা অভ্যুত্থানে নওয়াজ শরিফের বিদায়ের পর ইমরানের আবির্ভাব।

ইমরানের সরকারের বৈধতার প্রশ্নের পাশাপাশি সুশাসন, আর্থিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাও আছে। ভারতের সঙ্গে সংঘাত ‘জাতীয়তাবাদের ঢেউ’ তুলে আসল চ্যালেঞ্জ থেকে লোকজনের দৃষ্টি সরিয়ে দেবে, যা রাজনৈতিকভাবে ইমরানের জন্য লাভজনক।

এটাও মনে রাখতে হবে, আশির দশকে আফগান যুদ্ধের উৎসস্থল ছিল পাকিস্তান। কারণ, সোভিয়েতের পাল্টা হামলা রুখে দেওয়ার দায়িত্বটা তখন নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে ‘পারমাণবিক ছাতা’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরনের বৈরী পদক্ষেপকে নিরুৎসাহিত করেছে।

যদিও এ ধরনের যুক্তি যে কাজ করে না,১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সামরিক সংঘাত সেটা প্রমাণ করেছে। এবং আবারও সেই যুক্তি ভয়াবহ পরীক্ষার মুখে পড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোকেও অতীতের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের উত্তেজনা প্রশমনে সেভাবে প্রভাব খাটাতে দেখা যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো, তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাও ২৬ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতীয় বিমান হামলার নিন্দা জানায়নি। সন্ত্রাসবাদের সমস্যার কারণে পাকিস্তানের ভাবমূর্তির সংকট থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পাকিস্তানকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। পাকিস্তানকে এটা করতে হবে নিজের স্বার্থেই।- সূত্র: প্রথম আলো

লেখক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক সম্পর্ক বিশ্লেষক


শর্টলিংকঃ