দুই শহীদ ছেলের পিতার নামও রাজাকারের তালিকায়


জিয়াউল গনি সেলিম/ এম এ আমিন রিংকু :

রাজশাহীতে রাজাকারদের তালিকায় এসেছে খোদ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠকদের নাম। বাদ যায় নি পাকসেনাদের হাতে শহীদ দুই ছেলের বাবা ও খোদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। রাজাকার হিসেবে নাম এসেছে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসৈনিকেরও। আছে-  জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির নামও! 

 অ্যাড.  গোলাম আরিফ টিপু, অ্যাড. মহসিন মিয়া ও অ্যাড. আব্দুস সালাম

কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয়েছিল রাজশাহীর অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের। তারা দুজনেই থাকতেন বেকার হোস্টেলে। তখন থেকেই গভীর ঘনিষ্ঠতা। এরপর গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে দু’জনের।

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু রাজশাহীতে যতবারই এসেছিলেন, থাকতেন অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের এই বাড়িতেই। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি মোড়ানো সেই বাড়িটি এখনো আছে আগের মতোই। সোমবার বিকেলে এ দুই প্রতিবেদক যান অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের সিপাইপাড়ার সেই বাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন তার নাতি অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান বাবু। তিনতলা বাড়িটিতে গিয়ে দেখা মিললো কেয়ারটেকারের। তিনি বললেন, এখানে এখন কেউ আর থাকেন না। পরিবারের সদস্যরা এখন দেশের বাইরে। তবে জানালেন, ঢাকা থেকে এসেছেন আব্দুস সালামের জামাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ দৌলা বাবুল। একটু পর তার সঙ্গেও দেখা হয়।

অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের সেই বাড়ি

মুক্তিযোদ্ধা রফিক উদ দৌলা বাবুল বলছিলেন, ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জানাশোনা হয় অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের। বঙ্গবন্ধু বয়সে খানিকটা ছোট ছিলেন। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২সালে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে সময় রাজশাহী এসে তিনি এই বাড়ির দ্বিতীয়তলায় সিঁড়ির পাশে পশ্চিম দিকে ঘরটায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতা অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানেরও বিশ্বস্ত ছিলেন তিনি। কামারুজ্জামানের ধানমণ্ডির বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল আব্দুস সালামের।

আব্দুস সালামের এই ঘরেই থাকতেন বঙ্গবন্ধু

রফিক উদ দৌলা বাবুল তখন তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি বললেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫মার্চ রাতেই রাজশাহীতে  আব্দুস সালামের বাড়িতেই প্রথম অপারেশন চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁকে না পেয়ে দুই ছেলে ওয়াসিমুজ্জামান ও সেলিম এবং ভাগ্নি জামাই নজমুল হকসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন।সারাজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। তিনি মারা গেছেন ২০০৬সালের ২১ ডিসেম্বর। অথচ কারা কীভাবে রাজাকারের তালিকায় স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের নাম জুড়ে দিলো তদন্ত করা প্রয়োজন’।

বর্তমানে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নাম রয়েছে ওই তালিকায়। অথচ ১৯৫২ সালে রাজশাহীতে বাংলা ভাষা আন্দোলন মূলত তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়।তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য সরকার তাকে ২০১৯ সালে একুশে পদক প্রদান করে। তিনি একাধিকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিতও হন।বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত নীহারবানু হত্যা মামলায় তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি লাভ করেন।

অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের দুই ছেলে শহীদ ওয়াসিম ও শহীদ সেলিম

একই তালিকায় নাম রয়েছে অ্যাডভোকেট মহসিনেরও নাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মুর্শিদাবাদের পানিপিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন তিনি। ছিলেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। কিন্তু সরকারী তালিকায় তিনি রাজাকার!

মহান স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর প্রথমধাপে রোববার প্রকাশ করা হয় ১০হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা। প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় রাজশাহী বিভাগের ১ থেকে ১৫৪টি তালিকা আছে। এ তালিকায় রাজশাহী বিভাগের রাজাকারদের তালিকায় ৮৯ নম্বরে রয়েছে তৎকালীন জেলা প্রশাসক জেলা প্রশাসক আবদুর রউফ, পুলিশ কর্মকর্তা এস এস আবু তালেব, অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম ও অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া। যদিও এই ৮৯ নম্বর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লেখা আছে তাদের অব্যাহতি দিতে জেলা কমিটি আবেদন করেছিল।

তবে এই তালিকা দ্রুত সংশোধন করে প্রকৃত রাজাকারদের নাম অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী মহানগর শাখার কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, যে তালিকায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের রাজাকার হিসেবে নাম এসেছে, সে তালিকা আমরা মানতে চাই না।অ্যাড.  গোলাম আরিফ টিপু, অ্যাড. মহসিন মিয়া ও অ্যাড. আব্দুস সালাম-তিনজনই আমাদের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রুহুল আমি প্রমাণিক বলেন, সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই তালিকা করেছে। সরকারও যেনতেনভাবে তালিকা প্রকাশ করেছে। এটি যাচাইবাছাই করে প্রকাশ করা উচিত ছিল। তালিকা দ্রুত সংশোধনেরও দাবি জানান তিনি।


শর্টলিংকঃ