দুর্লভ জীবনীগ্রন্থে বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি


এস এম রশিদ:

‘আমার বড় আদরের কল্যাণ—১১ বৎসর বয়সে পিতৃহীন হইয়া নিজের মনের দৃঢ়তায়, যত্ন ও পরিশ্রমে লেখাপড়া শিখিয়া এখানে সকল পরীক্ষায় মাথায় মাথায় পাশ করিয়া—নিজের উদ্যম ও চেষ্টায় বিলাত গিয়া—সেখানে সংযতভাবে থাকিয়া এডিনবরা ও কেমব্রিজ এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যথাযথ ডিগ্রী পাইয়া—সুকঠিন ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে ঢুকিয়া—ক্যাপ্টেনের বড় পদ পাইয়া—বড়লোক হইয়া—বীরত্বের সহিত যুদ্ধ ক্ষেত্রে আপন প্রাণকে তুচ্ছ জ্ঞানে কর্ত্তব্য পালন করিয়া এবং সেই কাজে গৌরবান্বিত হইয়া ৩৪ বৎসর ৬ মাস বয়সে বিদেশে জ্বর বিকারে রোগে প্রাণ হারাইল—ইহা ভাবিলে আমি অধীর হইয়া পড়ি।

আমি তার অশীতি বৎসরের বৃদ্ধা দিদিমা। আমার পরপারে যাইবার সময় সন্নিকট বলিয়াই মনে হয়। সে বাঁচিয়া থাকিলে আমার মৃত্যুর সময়ে আমার পার্শ্বে সে যে থাকিত তাহা নিশ্চয়। সে সুখ হইতে আমি বঞ্চিত হইয়াছি। তার আদরের চিহ্নটুকুও মুছিয়া গেছে—তার সেই মেয়েটিকেও ভগবান নিজ ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। তার মৃত্যুর ভীষণ শোক সহ্য করিয়া—আমাকে তার জীবনী লিখিতে হইল—ইহা কি একটা কম দুঃখের কথা। কিন্তু আমি না লিখিয়া গেলে তার আশৈশব জীবনের মধুরতা, যৌবনের উদ্যম, প্রেরণা, উচ্চ আকাঙ্ক্ষা—বড় হইবার, কর্ম্মী হইবার, কৃতী হইবার অদম্য উৎসাহ—তার মা ছাড়া কে জানিত, আর কেই বা যত্ন করিয়া লিখিত?’

শ্রীমতী মোক্ষদা দেবী এ প্রশ্ন করেছিলেন প্রায় শত বছর আগে—২০২১ সালের জুলাইয়ে তার এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাবের সঙ্গে এটাও বলতে হয়, নয়তো বাঙালির এমন কীর্তির কথাই বা কে মনে রাখত। কীভাবেই বা এত স্পষ্টভাবে জানা যেত সেকালের বাঙালির চিন্তা, জীবনভাবনার গতিপথকে। এবার মূল ঘটনা অল্প কথায় শোনানো যাক।

ক্যাপ্টেন কল্যাণকুমার মুখোপাধ্যায় আইএমএস ছিলেন শ্রীমতী মোক্ষদা দেবীর আদরের জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কল্যাণকুমার ইরাকে তুরস্ক-ব্রিটেনের মধ্যকার যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। যুদ্ধেক্ষেত্রে ডাক্তার হিসেবে তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছিল। তাকে ব্রিটিশ মেডিকেল সার্ভিসের গৌরব হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার প্রণীত মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধগ্রন্থেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে টাইগ্রিসের তীরে কুতে এল আমারায় ব্রিটিশ সেনাদল তুর্কি বাহিনীর হাতে পর্যদুস্ত হয়। ব্রিটিশ জেনারেল টাউনশেন্ড ও তার বাহিনীর অনেক সদস্য তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়। বাহিনীর সঙ্গে এক বছর কল্যাণকুমার ‘রাসেল-আইন’ নামক স্থানে বন্দি ছিলেন। এ সময় তিনি ভারতীয় বন্দি সেনাদের চিকিৎসা করেছেন। একসময় নিজেই আক্রান্ত হন টাইফাসে এবং এর পরিণতিতে ৩৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার ‘মিলিটারি ক্রস’ পদকটি কল্যাণের স্ত্রীর কাছে সরকারের পক্ষ থেকে পৌঁছে দেয়া হয়। কল্যাণের মৃত্যুর শোক তার দাদি মোক্ষদা দেবী কাটিয়ে রচনা করেছিলেন দৌহিত্রের এ জীবনী। এ গ্রন্থে পাওয়া যায় রণাঙ্গন থেকে কল্যাণের পাঠানো বেশ কয়েকটি চিঠি, যার মাধ্যমে সরাসরি ইরাক ফ্রন্টের যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। মোক্ষদা দেবী এ জীবনীগ্রন্থের নাম দেন ‘কল্যাণ প্রদীপ’, বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে। গ্রন্থটির মূল্য ছিল ৩ টাকা। উল্লেখ্য, মোক্ষদা দেবী নিজে আগে থেকেই সাহিত্যচর্চা করতেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে তার কাব্যগ্রন্থ বন-প্রসূনে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘সফল-স্বপ্ন’। ‘কল্যাণ প্রদীপ’ বইটি প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেন লেখিকার জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্যারিস্টার সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

‘কল্যাণ প্রদীপ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কল্যাণকুমার মুখোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৮২ সালের ২৪ অক্টোবর। ১৯০৬ সালে তিনি ডাক্তারি পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তবে এতে কল্যাণ সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিলেত থেকে ডিগ্রি নেয়ার ইচ্ছা ছিল তার। ১৯০৭ সালে এক জাহাজে ডাক্তারের চাকরি জুটিয়ে রওনা হন বিলেতের পথে। ১৯১০ সালে আইএমএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সেনাবাহিনীর চিকিৎসক হন। সঙ্গে পেয়েছিলেন ৫০ পাউন্ডের বৃত্তি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কল্যাণ স্বেচ্ছায় যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯১৫ সালের জুলাইয়ে নাসিরিয়া থেকে মায়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে কল্যাণ লেখেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই কাগজে আগেই খবর পাবে যে মেসোপটেমিয়ায় আবার মস্ত যুদ্ধ হয়েছে। ইংরাজের খুব জিত হয়েছে। এবার জিতের আর ভুল নেই। গোড়া থেকে শেষ পর্য্যন্ত আমার সামনে হয়েছে।…রাত ১০ টা নাগাত গুলি বৃষ্টি আরম্ভ হল। ঠিক শিলাবৃষ্টি! অবিকল! এক বর্ণও বাড়ান নয়! খেজুর বাগানে দেয়ালের আড়ালে আশ্রয়! ঠকাম্ ঠকাম্! সাঁই! সাঁই! গুলি চলেইছে—আধ ঘণ্টা ধরে।’ বোঝাই যায় যুদ্ধের রূপ ভালোভাবেই দেখেছিলেন কল্যাণ। কুত এল আমারার যুদ্ধেও ছিলেন তিনি। সে যুদ্ধের বিবরণ লিখেছেন অক্টোবরে পাঠানো চিঠিতে।

১৯১৫ সালের নভেম্বরে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘নভেম্বর মাস তো এল। এখনও কাইসারের কথামত অক্টোবরে যুদ্ধ থামিবার কোনও লক্ষণ ত দেখি না। ব্যাপার ক্রমশ বেশী জটিল হয়ে আসছে।…’

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো চিঠিতে কল্যাণ জানান, সেখানে খুব মহামারী চলছে। লেখার শেষ টানা যায় মোক্ষদা দেবীর কলম থেকে, ‘তারপর কল্যাণের আর কোন খবর এপ্রিল মাসে আসিল না। একেবারে মে মাসের ২১ তারিখে খবরের কাগজে প্রকাশিত হইল যে ক্যাপ্টেন কল্যাণ কুমার মুখার্জি দারুণ মহামারী রোগে আক্রান্ত হইয়া ১৮ মার্চ (১৯১৭) মারা গিয়াছেন।’

 

এস এম রশিদ: লেখক


শর্টলিংকঃ