দেবীর জন্য সব ঋতুই সমান


সমকাল ঢাকা:

কবি নির্মলেন্দু গুণ বেড়ে উঠেছেন নেত্রকোনার কাশতলা গ্রামে। বহমান নদী ও বিস্তৃত হাওরের জল-হাওয়া তার কবিতা ও গদ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা ভাষার উদার দিগন্তে। দুর্গাপূজা ঘিরে কবির স্মৃতি ও সঞ্চারণ নিয়ে কথা বলেছেন শেখ রোকন।


সমকাল: এবার দুর্গাপূজায় তো ঘুরতে বের হচ্ছেন না?
নির্মলেন্দু গুণ: দুর্গাপূজায় কী, গত আট মাস ধরেই আমি বাইরে যাচ্ছি না।
ঘর থেকে শুধু বারান্দায় যাই। নিচেও নামি না।
সমকাল: গ্রামের বাড়ির পূজা উদযাপন নিশ্চয়ই মিস করছেন।
নির্মলেন্দু গুণ: অবশ্যই করছি। দুর্গাপূজা উপলক্ষে গ্রামের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো। খাওয়াদাওয়া, গল্প-গুজব হতো। কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কাটে। বিশেষ করে দশমীর দিনটি কোন দিক দিয়ে কেটে যেত টের পেতাম না।
সমকাল: এবার তারাও আপনাকে মিস করার কথা।
নির্মলেন্দু গুণ: করছে না? সবাই ফোন দিচ্ছে, যেতে বলছে। করোনার যে পরিস্থিতি, আমি সাহস পাচ্ছি না। গ্রামের মানুষ করোনা মানতে চায় না। বলে কিছু হবে না। আমিও জানি, অনেকে করোনার ধাক্কা সামলে উঠছে। আমার পক্ষে সেই ধাক্কা হজম করা কঠিন। বয়স হয়েছে না!
সমকাল: ‘আমার ছেলেবেলা’ বইতে লিখেছেন পারিবারিক দুর্গাপূজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শৈশবে আপনার মন খারাপ হয়েছিল।
নির্মলেন্দু গুণ: আমার ঠাকুরদা রামসুন্দর গুণ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেজন্য বাড়িতে পূজা বন্ধ হয়েছিল। পরে অবশ্য তিনি গ্রামের প্রভাবশালী ব্রাহ্মণদের চাপে প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দু ধর্মে ফিরে এসেছিলেন।
সমকাল: বাড়িতে দুর্গাপূজা বন্ধ হওয়া নিয়ে বাঘে খাওয়ার গল্পের কথাও লিখেছিলেন।
নির্মলেন্দু গুণ: আমার ধারণা দুর্গাপূজা না করতে চাওয়ার জন্যই গল্পটা ছড়ানো হয়েছিল। আমাদের পূর্বপুরুষদের একজনকে নাকি দুর্গাপূজা চলার সময় বাঘে খেয়েছিল। সে অভিমান থেকে দুর্গাপূজা বন্ধ। আসল কারণ ছিল সম্ভবত, আমার ঠাকুরদার ধর্মান্তরের প্রভাব।
সমকাল: পূজা নিয়ে শৈশবের কোনো স্মৃতি?
নির্মলেন্দু গুণ: অনেক স্মৃতি। শুধু দুর্গাপূজা নয়, শৈশবে যে কোনো পূজাই ছিল উদযাপনের উপলক্ষ। গ্রামের সবার পূজা দেখতে যেতাম। আমাদের বাড়িতে সরস্বতী পূজা হতো। আমার মায়ের নামও ছিল ‘বীণাপাণি’। সরস্বতী পূজায় বাবা আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন।
সমকাল: আপনি পূজার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন?
নির্মলেন্দু গুণ: আমি ছোটবেলাতেই লক্ষ্মীর পাঁচালি, নারায়ণের পাঁচালি, শনির পাঁচালি পড়ার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলাম। পয়ার ছন্দে আমার যে দখল, সেটা পাঁচালি পাঠ থেকেই এসেছে। মেট্রিক পাস করার পর যখন কবিতার জগতে ঢুকে গেলাম, তখন থেকে পূজার আচার-অনুষ্ঠান থেকে ক্রমে দূরে সরে এলাম।
সমকাল: কিন্তু প্রতি বছর পূজার সময় বাড়ি যেতেন?
নির্মলেন্দু গুণ: শুধু একাত্তর সালে যাইনি। একাত্তরের পূজার সময় আমি কলকাতায়। সেই প্রথম আমার কলকাতা যাওয়া।
সমকাল: প্রথম কলকাতা গিয়ে এখানকার পূজার সঙ্গে সেখানকার পূজার কী পার্থক্য দেখলেন?
নির্মলেন্দু গুণ: দুর্গাপূজা হলো বাঙালি হিন্দুর প্রধান উৎসব। কলকাতা হচ্ছে বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত নগরী। বাঙালি হিন্দুর বৈশ্বিক কেন্দ্র বলা চলে। সেখানে একটা পাড়ায় যত পূজা হয়, গোটা ঢাকা শহরে তত পূজা নেই। আর সে কি আয়োজন ও উৎসব!
সমকাল: ঘরে যেহেতু থাকবেন, পূজার কোনো বিশেষ খাবার মিস করছেন?
নির্মলেন্দু গুণ: আম ছাড়া অন্য কোনো খাবার আমি মিস করি না। আমের সঙ্গে পূজার কোনো সম্পর্ক নেই। আম পাকে গ্রীষ্ফ্মকালে। দুর্গাপূজা হলো শরৎকালের।
সমকাল: এবার তো পূজা হেমন্তকালে হচ্ছে।
নির্মলেন্দু গুণ: বিষয়টি তো খেয়াল করিনি! এখন তো শরৎ আর হেমন্তর পার্থক্য বোঝা যায় না। সব যেন একই ঋতু। দেবীর জন্য সব ঋতুই সমান। কোনো ঋতুতেই দুর্গাপূজা উদযাপনে সমস্যা নেই।
সমকাল: বর্ষা ঋতু হলে উদযাপনে সমস্যা হতে পারে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বর্ষাঋতু সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।
নির্মলেন্দু গুণ: হাঁ, বর্ষা ও বসন্ত ঋতু আলাদা। বর্ষা মানে প্রকৃতির চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। বসন্তেও আলাদা হয়। রবীন্দ্রনাথ এই দুই ঋতু নিয়েই অনেক লিখেছেন। যদিও জীবনানন্দ দাশ পছন্দ করতেন হেমন্ত ঋতু। আমার আছে ষড়ঋতুর কবিতা। বইয়ের নাম ‘ঋতুসমগ্র :নির্মলেন্দু গুণের ষড়ঋতুর কবিতা’।
সমকাল: আপনার জন্মও তো বর্ষাকালে।
নির্মলেন্দু গুণ: আমার কবিতা পড়েছেন? সেখানে আছে- ‘আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ণ বর্ষায়/কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত’। বঙ্গে ষড়ঋতুর মধ্যে বর্ষা হচ্ছে একমাত্র স্ত্রীবাচক নাম। বাকি পাঁচ ঋতু পুরুষবাচক। আমি বলে থাকি, পঞ্চপাণ্ডবের এক দ্রৌপদী। একমাত্র নারী ঋতু।
সমকাল: আপনার ‘বিসর্জনের আগে’ কবিতাটি আমার পড়া আছে। সেখানে দেবী দুর্গাকে যেভাবে অসুরের নৈকট্যের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেটা ভিন্নমাত্রিক। আপনি কি দুর্গা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম লিখেছেন?
নির্মলেন্দু গুণ: কম না, আবার বেশিও না। দুর্গাপূজা নিয়ে আমার আরও চার-পাঁচটা কবিতা আছে।
সমকাল: কয়েক বছর আগে এক বর্ষায় এভাবে টেলিফোনে আপনার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বর্ষা উদযাপন প্রসঙ্গে। তখন বলেছিলেন, বর্ষাই আপনাকে উদযাপন করে।
নির্মলেন্দু গুণ: হাঁ, বর্ষার একটা ভালো দিক হলো, তখনও কিছু কিছু আম পাওয়া যায়। নারী ঋতু হিসেবেও চিত্রকল্প আনন্দদায়ক।
সমকাল: তাহলে আপনি এবার ঘরবন্দি থেকে যতটা না পূজার উৎসব, তার চেয়ে বেশি আম মিস করছেন?
নির্মলেন্দু গুণ: সেরকম নয়। পূজার উৎসবে যেতে পারা মানে শৈশবের কাছে ফিরে যেতে পারা। তবে আমার কবিতায় আছে- ‘পুনর্জন্ম দাও যদি মা/ আম কাঁঠালের সঙ্গে/ আমায় তুমি বর্ষাকালে/ জন্ম দিও বঙ্গে।’
সমকাল: আমরা চাই, আপনার প্রত্যাশা পূরণ হোক। আপনি বঙ্গে পুনর্জন্ম গ্রহণ করুন। শৈশবের মতো উৎসবময় পরিবেশে আবারও দুর্গাপূজা উদযাপন করুন। হেমন্তে দাঁড়িয়ে আপনাকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
নির্মলেন্দু গুণ: সমকালের জন্যও শুভেচ্ছা।


শর্টলিংকঃ