‘দেশসেরা’ রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্টে ভয়ঙ্কর ফারাক!


জিয়াউল গনি সেলিম : 

গেল সাত বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থী বেড়েছে এক লাখেরও বেশি। কিন্তু কমেছে পাসের হার। স্কুলের সংখ্যা বেড়েছে এক হাজারের ওপরে। তবে শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যা কমেছে তিনগুণেরও বেশি। এরপরও চার বছর ধরে দেশসেরা রাজশাহী বোর্ড।  

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড

এর পেছনের কারণটা অবশ্য খোলামেলাই স্বীকার করলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি বলছেন, ‘কয়েক বছর  আগে বোর্ডগুলোতে পাসের হারের প্রতিযোগিতা চলতো। পরীক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হতো বেশি বেশি নাম্বার দিতে।যাতে বিভিন্নমহল থেকে ধন্যবাদ বেশি পাওয়া যায়। আর ফলাফলে পাসের হার বা জিপিএ-৫ কম হলে ওপর মহল বোর্ডের চেয়ারম্যান বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ফল কেন কম হলো-এনিয়ে জাবাবদিহি করতে হতো। একারণে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল’।

যদিও এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হারে দেশের সকল শিক্ষা বোর্ডকে পেছনে ফেলে এবারো শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। টানা চতুর্থবারের মতো  দেশসেরা বোর্ডের খেতাব অর্জন করেছে। বোর্ডে দেয়া তথ্যমতে, ২০১৪ সালে পাসের হার ছিল ৯৬ দশমিক ৩৪শতাংশ, ২০১৫ সালে খানিকটা কমে পাসের হার নেমে আসে ৯৪ দশমিক ৯৭ ভাগে।

তবে ২০১৬ সালে আবার সামান্য বেড়ে পাসের হার দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশে। এরপর থেকে প্রতি বছরই কমেছে পাসের হার। ২০১৭ সালে ৯০ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৮৬ দশমিক ০৭ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৯১ দশমিক ৬৪ শতাংশ ও ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার পাস করেছে ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশ  শিক্ষার্থী।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা

শিক্ষা বোর্ডের গেল সাত বছরের এসএসসি পরীক্ষার তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ২০১৪ সালে পরীক্ষায় অংশ নেয় এক লাখ ২২হাজার ১৬৮জন, ২০১৫ সালে  এক লাখ ২৭ হাজার ৫২০জন, ২০১৬ সালে এক লাখ ৫২হাজার ৫৬জন, ২০১৭ সালে  এক লাখ ৬৬হাজার ৯৩৮ জন, ২০১৮ সালে এক লাখ ৯৩হাজার ৮৬২জন, ২০১৯ সালে দুই লাখ ৩ হাজার ৮৮১জন ও সবশেষ ২০২০ সালে দুই লাখ ১৮৫জন।

এছাড়া, ২০১৪ সাল থেকে এবছর পর্যন্ত সময়ে কমেছে শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যাও। ২০১৪ সালে মোট দু’হাজার ৫৪২টি স্কুলের মধ্যে শতভাগ পাস করেছিল এক হাজার ৫৫টি স্কুলের পরীক্ষার্থী। ২০১৫ সালে স্কুল সংখ্যা ছিল দু’হাজার ৫৮৮টি। এরমধ্যে শতভাগের তালিকায় নাম ওঠে ৯৬৯টি স্কুলের। ২০১৬ সালে স্কুলসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায়  দু’ হাজার ৬১৩টিতে। কিন্তু শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যা কমে আসে ৮০০টিতে।

২০১৭ সালে দু’হাজার ৬৩২টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় এসএসসি পরীক্ষায়। কিন্তু শতভাগ পাস করে ৪২৯টি স্কুল। ২০১৮ সালে স্কুল ছিল দু’হাজার ৬৪৩টি। এরমধ্যে শতভাগ স্কুল পাস করেছিল আগের বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। এই সংখ্যা মাত্র ২০৬টি নেমে আসে। ২০১৯ সালে  স্কুলের সংখ্যা বেড়ে হয় দু’হাজার ৬৪৬টি। তবে ওই বছর শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩১টিতে। এবছর দু’হাজার ৬৫২টি স্কুলের পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। কিন্তু মাত্র ৩০৮টি স্কুলের শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে।

এসএসসি

অর্থাৎ গেল সাত বছরে স্কুল বেড়েছে এক হাজারেরও বেশি। পরীক্ষার্থীও বেড়েছে এক লাখের ওপরে। কিন্তু কমছে পাসের হার। আর শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যাও নেমেছে তলানিতে।

২০১৪সালে ছাত্রীদের পাসের হার ছিল ৯৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু এরপরের বছরগুলোতে কমতে কমতে সবশেষ চলতি বছরে নেমেছে ৯১ দশমিক ৪৫ শতাংশে। একইচিত্র ছাত্রদের পাসের হারেও। ২০১৪ সালে পাস করেছিল ৯১ দশমিক ১৯ ভাগ। কিন্তু প্রতি বছরই   কমে এ বছর ঠেকেছে ৮৯ দশমিক ৩৭ শতাংশে।

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোকবুল হোসেন মোবাইল ফোন রিসিভ করেন নি। চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায় নি বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক দেবাশিস রঞ্জন রায়েরও।

তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আরিফুল ইসলামকে এই প্রতিযোগিতাকে অবশ্য ভয়াবহ অপরাধ হিসেবেই দেখছেন। তিনি তুলনা করে বলেন, ‘নকল করলেও তিনি কষ্ট করে খাতায় লিখে নাম্বার পেতে হয়। কিন্তু এখানে এমনি নাম্বার পেয়ে যাচ্ছে। আমি মনে পাসের হার বাড়ানোর এই প্রতিযোগিতা নকলের চেয়েও খারাপ ছিল’।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান বলেন, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষাগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য সেন্ট্রাল কমিটি ছিল। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, তখন নির্দেশনা ছিল কোনো পরীক্ষার্থী ৭৮ নাম্বার পেলে তাকে ৮০নাম্বার দেয়া হতো। এ প্রবণতার কারণে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার মানের। তবে এখন অবশ্য এই ধরনের প্রান্তিক নাম্বার দেয়া হয় না। এ কারণে এমন ফারাক ধরা পড়ছে


শর্টলিংকঃ